কমছে কীটনাশক ব্যবহার
নিরাপদ খাদ্য প্রচারণার জনপ্রিয়তা, কৃষিকাজে নিয়ন্ত্রিত কীটনাশক ব্যবহারে সরকারের সমর্থন এবং চাষিদের মাঝে স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধির কারণে দেশে কীটনাশক ব্যবহার দিন দিন কমছে বলে জানিয়েছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর।
উদাহরণ হিসেবে আশুলিয়ার কৃষি উদ্যোক্তা রাজিয়া সুলতানার কথা ধরা যেতে পারে। ৩৫ বিঘা (১১.৫৭ একর) জমিতে তিনি ক্যাপসিকাম, ব্রুকলি, বিট রুট, চেরির মতো দামি শস্য উৎপাদন করেন। গোবর, ভার্মি কম্পোস্ট-সহ বিভিন্ন প্রকারের জৈব সার দিয়ে চাষাবাদ করে ফসল উৎপাদনে কীটনাশকের ব্যবহার কমিয়ে এনেছেন রাজিয়া।
তিনি বলেন, 'দামি শস্য ও সাধারণ শস্যের জন্য একই পরিমাণ কীটনাশক ব্যবহার করতে হয়। আবশ্যক না হলে ফসলে কীটনাশকের ব্যবহার করতে হয় না। করলেও সেটা থাকে পরিমিত মাত্রায়।'
শুধু এই উদ্যোক্তাই নন, কৃষি উদ্যোক্তাদের অনেকেই এখন কীটনাশকের নিয়ন্ত্রিত ব্যবহারে ঝুঁকছেন। অনেকে আবার জৈব কৃষি ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বালাইনাশকের ব্যবহার একেবারেই কমিয়ে দিয়েছেন। অনেক কৃষক ব্যবহার করছে ভেষজ বালাইনাশক। এ কারণে ধীরে ধীরে কমতে শুরু করেছে রাসায়নিক কীটনাশক ব্যবহার, যা নিরাপদ ফসল উৎপাদনের একটি নতুন ক্ষেত্র তৈরি করছে বলে মনে করছেন কৃষি সংশ্লিষ্টরা।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উদ্ভিদ সংরক্ষণ উইং কাজ করে কীটনাশকের লাইসেন্সিং ও মনিটরিং নিয়ে। এই উইং থেকে প্রাপ্ত ১০ বছরের কীটনাশক ব্যবহারের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে, মোটা দাগে কীটনাশকের ব্যবহার প্রতিনিয়ত কমছে।
সুপারিশকৃত মাত্রায় সার ও কীটনাশক ব্যবহারে উপকারভোগী কৃষকদের ধান চাষে হেক্টরপ্রতি ১১ শতাংশ, সবজি চাষে হেক্টর প্রতি ২৩ শতাংশ এবং ফল চাষে ১৪ শতাংশ খরচ কমেছে।
তথ্য বলছে, ২০১১ সালে সারা দেশে কীটনাশকের ব্যবহার হয়েছে ৪৪,৪২৩ টন, যার আর্থিক মূল্য ছিল ৭৫৫ কোটি টাকা। ২০২০ সালে এসে কীটনাশকের ব্যবহার নেমেছে ৩৭,৪২২ টনে, যার আর্থিক মূল্য ৬৭৩ কোটি টাকা।
উদ্ভিদ সংরক্ষণ উইং দাবি করছে, সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা কৌশল, সুষম সার ব্যবহার, বালাইনাশকের ব্যবহারে সচেতনতা বৃদ্ধি, প্রশিক্ষণসহ বিভিন্ন কারণেই রাসায়নিক বালাইনাশকের ব্যবহার দিন দিন কমছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা (আইপিএম) কৌশলের মাধ্যমে নিরাপদ ফসল উৎপাদন (১ম সংশোধিত) শীর্ষক একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে, যার বাস্তবায়নকাল ছিল ২০১৮ সাল পর্যন্ত। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের আইএমইডি বিভাগ এই প্রকল্পের মূল্যয়ন প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে চলতি বছরের জুন মাসে।
প্রতিবেদনে কীটনাশকের ব্যবহার নিয়ে বেশ কিছু তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। এই তথ্যে দেখা গেছে, প্রকল্প গ্রহণের পূর্বের তুলনায় বর্তমানে কীটনাশক ব্যবহারের পরিমাণ প্রায় ১৪.২৬ শতাংশ কমেছে এবং কীটনাশক ব্যবহারের পরিমাণ ২৯.৮৪ শতাংশ কমেছে।
সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা পদ্ধতির মাধ্যমে নিরাপদ ফসল উৎপাদনে সরাসরি দেড় লাখের বেশি কৃষক অংশগ্রহণ করেছেন, যার মধ্যে কমপক্ষে ২৫ শতাংশ নারী। এদের বালাইনাশক ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম দেখে প্রকল্প এলাকার অন্তত ৩০-৩৫ জন করে নতুন কৃষক এই পদ্ধতিতে চাষাবাদে উৎসাহিত হয়েছেন। ফলে প্রকল্প এলাকা ২৫৬১ হেক্টর জমি হলেও বর্তমানে এই পদ্ধতিতে চাষাবাদে জমির পরিমাণ বেড়ে ৯০০৫ হেক্টরে দাঁড়িয়েছে।
তবে আইএমইডি'র এই প্রকল্পের প্রভাব মূল্যায়ন প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, ৬৭০০টি কৃষক মাঠ স্কুল তৈরি করা হলেও রেজিস্ট্রেশন জটিলতা এবং ধারাবাহিক মনিটরিংয়ের অভাবে ২০ শতাংশ স্কুল বন্ধ হয়ে গেছে।
সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা পদ্ধতিতে সাধারণত কীটপতঙ্গ দমনে 'সেক্স ফেরোমন' ফাঁদ ব্যবহার করা হয়। এই ফাঁদ তৈরি করতে 'লিউর' নামক এক ধরনের উপাদান ব্যবহার করা হয়, যা পুরুষ পোকাকে আকৃষ্ট করতে স্ত্রী পোকা কর্তৃক নিংসৃত এক ধরনের রাসায়নিক পদার্থ। এছাড়া বালাই ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে পোকামকড়, রোগ জীবাণু, কৃমি, ছত্রাক, আগাছাকে বোঝায়, যা সাধারণত ফসলের ক্ষতি করে।
তবে আইপিএম ব্যবস্থার মাধ্যমে পরিবেশকে দূষণমুক্ত রেখে এক বা একাধিক ব্যবস্থাপনা, যেমন জৈবিক ব্যবস্থাপনা, বালাই সহনশীল জাতের চাষ, উত্তম চাষাবাদ পদ্ধতি ব্যবহার, যান্ত্রিক ব্যবস্থাপনা এবং রাসায়নিকের নিয়ন্ত্রিত ব্যবহার।
কীটনাশক আমদানিকারক ও বাজারজাতকারীরা বলছেন, জৈব কৃষি ব্যবস্থার মাধ্যমে কোনো কোনো ক্ষেত্রে রাসায়নিক সার ও বালাইনাশক ব্যবহার না করে জৈব পদার্থের পুনঃচক্রায়ন ঠিক রেখে বিষমুক্ত পণ্য উৎপাদনে কাজ করছেন কৃষকরা। অনেক ক্ষেত্রে রাসায়নিকের ব্যবহার বন্ধ করে নিমের পাতা, বাকল, বীজ, মেহগনির বীজ, তামাক পাতা, নিশিন্দা পাতার তৈরি ভেষজ বালাইনাশক ব্যবহার করা হচ্ছে।
উদ্ভিদ সংরক্ষণ উইংয়ের উপ-পরিচালক ড. মো. জয়নুল আবেদীন টিবিএসকে বলেন, অনেক কৃষি উদ্যোক্তা এবং কৃষকই এখন পরিমিত মাত্রায় বালাইনাশক ব্যবহার করছেন। অনেকে আবার ভেষজ বালাই ব্যবহারে ঝুঁকছেন। যে কারণে রাসায়নিক পেস্টিসাইডের ব্যবহার দিন দিন কমছে।
জানা গেছে, মোটা দাগে বালাইনাশকের ব্যবহার কমে এলেও কিছু কিছু সেগমেন্টে, যেমন তরল, পাউডার, আগাছানাশক হিসেবে কীটনাশকের ব্যবহার পরিমাণে কম হলেও ধীরে ধীরে বাড়ছে। ২০১১ সালে দানাদার কীটনাশক ব্যবহার হয়েছে ২০ হাজার মেট্রিক টনের বেশি, যা ২০২০ সালে নেমে এসেছে ৬ হাজার টনে।
অন্যদিকে, তরল বালাইনাশকের ব্যবহার সাড়ে তিন হাজার টন থেকে বেড়ে ৫১০০ টনে দাঁড়িয়েছে। বেড়েছে আগাছানাশকের ব্যবহারও। একই সময়ে প্রায় চার হাজার মেট্রিক টন থেকে বেড়ে ৭২৫০ টনে দাঁড়িয়েছে।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ক্রপ প্রটেকশন অ্যাসোসিয়েশনের ম্যানেজার ও কৃষিবিদ দেবাশিষ চ্যাটার্জি টিবিএসকে বলেন, 'কিছু কিছু ক্ষেত্রে কীটনাশকের ব্যবহার কমেছে, এটা ঠিক। তবে আগের একটি নির্দিষ্ট এরিয়ার জন্য যে পরিমাণ বালাইনাশক ব্যবহার করতে হতো, এখনকার যে কীটনাশক, তার হয়তো ১০ ভাগের একভাগেই সেই এরিয়া কাভার করছে।'
তিনি বলেন, 'এখনকার কীটনাশকগুলো পরিবেশ বান্ধব। পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে এগুলোর ছাড়পত্র নিতে হয়। পরিবেশ অধিদপ্তর মাঠের আশপাশের পরিবেশ ও পানিতে এর প্রভাব বিচার বিশ্লেষণ করে তবেই ছাড়পত্র দেয়।'
উদ্ভিদ সংরক্ষণ উইংয়ের তথ্য বলছে, বাংলাদেশে প্রায় ৪০০টি নিবন্ধিত আমদানিকারক ও বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যারা চীন, ভারত, জার্মানিসহ বিভিন্ন দেশ থেকে বালাইনাশক আমদানি করছে। এদের অনেকেই আমদানি করে রি-প্যাকিংয়ের মাধ্যমে বাজারজাত করছে; আবার ২০-২২টি প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যারা কাঁচামাল আমদানি করে নিজেরা কীটনাশক উৎপাদন করছে।