কম দামে ইতালিয়ান স্ট্যান্ডার্ডের সিরামিকস বানাচ্ছে প-ওয়াং সিরামিকস
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র (মার্কিন) ও বাংলাদেশের যৌথ অংশীদারিত্বের প্রতিষ্ঠান প-ওয়াং সিরামিক ইন্ডাস্ট্রি লিমিটেড পরিবেশ-বান্ধব অথচ অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে মানসম্পন্ন পণ্য উৎপাদন করে আসছে।
গতকাল (২৬ মার্চ) ছিল প্রতিষ্ঠানটির ৭ম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী।
এ উপলক্ষকে কেন্দ্র করে প-ওয়াং সিরামিক ইন্ডাস্ট্রি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এস এম মাহবুব আলম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের সাথে আলাপচারিতায় প্রতিষ্ঠানটির ব্যবসায়িক নানা দিক এবং দেশের সিরামিক শিল্পের বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আব্বাস উদ্দিন নয়ন।
একসময় বিদেশ নির্ভর সিরামিকসের চাহিদার ৮৫ শতাংশই এখন স্থানীয় কোম্পানিগুলোর দখলে। দেশের চাহিদার যোগান দিয়ে বিদেশেও রপ্তানি করছে কেউ কেউ। স্থানীয় পণ্যের মান নিয়ে কেউ কেউ সন্দেহ করলেও সে শঙ্কা অমূলক বলে দাবি করছেন এস এম মাহবুব আলম।
"বাংলাদেশের ব্র্যান্ডগুলো সিরামিকস উৎপাদনের ক্ষেত্রে কাঁচামাল আমদানি, ফ্যাক্টরিতে গ্রহণ, প্রসেসে ইনপুট, ইন প্রসেসিংসহ সবক্ষেত্রে গুণগত মান নিয়ন্ত্রণ করছে। সুপারভাইজারি, মেইনটেনেন্স, সিস্টেম লসসহ মাল্টিপেজ স্টেজ অব সুপারভাইজরি এর ক্ষেত্রে বৈশ্বিক মান মেনে চলছে। ফলে আমাদের এখানে যে পণ্যের উৎপাদন হচ্ছে তা ইতালির মতই হচ্ছে। কিছু ক্ষেত্রে আমরা চীন ও তাইওয়ান থেকে ভালো পণ্য উৎপাদন করছি।"
"আমাদের নিজেদের কোম্পানির সিরামিকের মান যদি বলি, আমরাই দেশে একমাত্র ডায়মন্ড গ্লেস টাইলস উৎপাদন করি। এটি হলো টাইলসের সর্বশেষ প্রযুক্তি। এটা টাইলসের উপরিতলকে ডায়মন্ডের মতো দৃঢ়তা এনে দেয়"।
"দেশের অন্য কোম্পানির টাইলসের উপরিতলের গ্লেসের দৃঢ়তা সর্বোচ্চ ৪.৫ শতাংশ। রোমা টাইলস ৬ শতাংশ পর্যন্ত। সাধারণ টাইলসে ৬০-৭০ শতাংশ গ্লেস থাকলেও রোমাতে তা ১০০ শতাংশ। আমাদের আরেকটি বিশেষত্ব হলো আমাদের স্নো হোয়াইট টাইলস। ফলে গুণগত মানে যেকোনো ব্র্যান্ডের চেয়ে আমাদের টাইলস সেরা"।
তবে নিজেদের উৎপাদিত টাইলসের গুণগত মান ভালো হলেও মূল্য সুলভ বলে জানাচ্ছেন এস এম মাহবুব আলম।
"আমাদের ইন্ডাস্ট্রিতে সিস্টেম লস সবচেয়ে কম। আমাদের কারখানা গড়ে ২৩ ঘণ্টা উৎপাদন প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত থাকে। যদিও দেশে শিল্প কারখানার স্ট্যান্ডার্ড ২২ ঘণ্টা। ফলে সময়ের সর্বোচ্চ ব্যবহারের মাধ্যমে ভালো মানের পণ্য উৎপাদন করতে পারছি। তবে ছোট কোম্পানি বলে দামে কিছুটা ছাড় দিতে হয়। ব্র্যান্ড পরিচিতির জন্য ব্যবসা কম রেখে এগোতে হয়। আমাদের মতো আরো দুই-একটি ছোট কোম্পানির টাইলসের দাম কিছুটা কম কিন্তু মান কোনোভাবেই কম নয়।"
দেশে সিরামিকসের বর্তমান বাজার ও সম্ভাবনা
টাইলসের দেশীয় বাজার ভবিষ্যতে কয়েকগুণ বড় হওয়া সম্ভব বলে মনে করছেন তিনি।
"এটি স্পষ্ট যে গত দশ বছরে সিরামিক খাতে প্রবৃদ্ধি গড়ে ২০ শতাংশের বেশি। বিশ শতকের শুরুর দিকেও বিদেশ নির্ভর সিরামিক খাত এখন স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে রপ্তানি বাজারে বড় অবস্থান তৈরি করেছে। টেবিলওয়্যার, টাইলস এবং স্যানিটারি ওয়্যার মিলিয়ে দেশে গড়ে উঠেছে ৬৬টি ব্র্যান্ড। প্রতিবছর প্রায় ৬০০০ কোটি টাকার পণ্য বিক্রি হচ্ছে স্থানীয় বাজারে।"
"দেশের বাজারের সম্ভাবনা এবং সম্প্রসারণের সুযোগ কেমন রয়েছে তা আমরা নিজেদের অন্যান্য দেশের সঙ্গে মেলালেই বুঝতে পারবো। উন্নত দেশগুলোতে বহু আগে থেকেই সব ধরনের স্থাপনায় টাইলস ব্যবহার হচ্ছে। আমাদের দেশে মাত্র শুরু হলো।"
"আমাদের গ্রাম এখন শহরে রূপান্তরিত হচ্ছে। দালান-কোঠা বানানোর হার অনেক বেড়েছে। টাইলসের ব্যবহার মাত্র শুরু হয়েছে। আমাদের পার ক্যাপিটাল টাইলসের ব্যবহার আধা স্কয়ার ফিট। অন্যদিকে চীনে পার ক্যাপিটাল টাইলসের ব্যবহার ৬৫ স্কয়ার ফিট। আমরা এখন সেদিকে যাচ্ছি। সুতরাং আমাদের সম্ভাবনা বিপুল।"
"আমাদের লক্ষ্য হলো জীবনযাত্রার মান পরিবর্তন। আমাদের চিন্তা হলো- মানুষ যে টাকা খরচ করছে, তার যথাযথ বিনিময় মূল্য যেন তারা পায়। আপনি একটি টাকা খরচ করলেও এক টাকার টাইলস যেন পান তা আমরা নিশ্চিত করছি। আমরা টাকার তুলনায় প্রোডাক্ট অনেক ভালো দিচ্ছি। একই মানের টাইলস ইতালি থেকে আনতে গেলে আপনাকে কয়েকগুণ বেশি দাম দিতে হবে।"
টাইলস রপ্তানি করা যাচ্ছে না কেন
বাংলাদেশ থেকে শুধু টেবিল ওয়্যার রপ্তানি হয়, টাইলস কিংবা স্যানিটারি ওয়্যার নয় কেন-এমন প্রশ্নের জবার রয়েছে মাহবুব আলমের কাছে।
"আমাদের সব সিরামিক প্রোডাক্টই গুণগত মানে সেরা। তবে পরিবহন ব্যয়ের কারণে টাইলস কিংবা স্যানিটারি ওয়্যার রপ্তানি করা যাচ্ছে না"।
"একটি হিসাব দিয়ে বললে, এক কন্টেইনারে টাইলসের ভ্যালুয়েশন হয় ৫০০০ ডলার। যেখানে একটি কন্টেইনারের সর্বনিম্ন ভাড়া ১০০০ ডলার। এটি ইউরোপ, আমেরিকার বাজারে পাঠাতে গেলে কন্টেইনার ভাড়াই ৫০০০ ডলারের বেশি হবে।
অন্যদিকে টেবিল ওয়্যারের ক্ষেত্রে এক কন্টেইনারে ৬০-৭০ হাজার ডলার পর্যন্ত হয়। তবে এর লজিস্টিক ব্যয়ও টাইলসের মতোই হবে। এ কারণেই টেবিল ওয়্যার রফতানি করে লাভ পাওয়া গেলেও টাইলস রপ্তানি করে তা সম্ভব নয়। কোন প্রতিষ্ঠান চাইলেও আমাদের দেশ থেকে টাইলস রপ্তানি করে মুনাফা করতে পারবে না।"
সম্পূর্ণ আমদানি নির্ভর কাঁচামাল ও উচ্চমূল্যের এলএনজি গ্যাস ব্যবহার করে কিভাবে এগোবে বাংলাদেশি সিরামিকস পণ্য
"কাঁচামালই আমাদের জন্য মূল চ্যালেঞ্জ। কাঁচামাল আমদানি নির্ভর হওয়ায় চীন, ভিয়েতনাম ও ভারতের তুলনায় আমরা কিছুটা পিছিয়ে পড়ছি। তবে রপ্তানিতে সরকারের ১০ শতাংশ প্রণোদনা ও শুল্কমুক্ত কাঁচামাল আমদানির সুবিধা আমাদের কিছুটা সুযোগ করে দিচ্ছে"।
এস এম মাহবুব আলম বলেন, "আমাদের জন্য সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো প্রতিবেশী ভারতের তুলনায় বাংলাদেশে গ্যাসের দাম তুলনামূলক কম। এর সঙ্গে সহজলভ্য ও কম খরচে শ্রমিক পাওয়ার সুযোগও আমাদের সিরামিকস ইন্ডাস্ট্রিজকে এগিয়ে রাখছে। এসব কারণেই আমরা প্রতিযোগীদের তুলনায় ভালো করার সুযোগ দেখছি। তবে গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করা খুবই জরুরি"।
গ্যাস ও কাঁচামাল ছাড়া আর যা চ্যালেঞ্জ রয়েছে এ শিল্পের জন্য
"গ্যাস ও কাঁচামাল ছাড়াও মূল্য সমন্বয় করা আমাদের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। বারবার গ্যাসের দাম বৃদ্ধির কারণে স্থানীয় বাজারে পণ্যের দাম বাড়াতে হয়। বিষয়টি মানুষ ভালোভাবে নেয় না। ফলে কম দামের চীনের পণ্য চলছে। দ্বিতীয়ত, আমরা ডিউটি স্ট্রাকচার নিয়ে অসুবিধায় আছি। সরকারের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করার পরও আমরা এটাকে জিরো লেভেলে আনতে পারিনি", বলেন এস এম মাহবুব আলম।
"সিরামিক পণ্য এখন আর বিলাসবহুল পণ্য না হলেও এটির ওপর ১৫ শতাংশ সাপ্লিমেন্টারি ডিউটি দিতে হয়। পাশাপাশি ভ্যাটের খড়গ রয়েছে। এছাড়া দক্ষ জনবলের ঘাটতিও রয়েছে আমাদের ইন্ডাস্ট্রিতে। এ বিষয়গুলো সমাধান করতে পারলে আমাদের সম্ভাবনা বিপুল"।
রোমা টাইলসের উৎপাদন ও ভবিষ্যত পরিকল্পনা
এস এম মাহবুব আলম বলেন, "রোমা টাইলস দেশের বাজারে খুব পরিচিত নাম নয়। আমাদের পরিকল্পনা ধীরে ধীরে এগোনোর। আমরা বর্তমানে দৈনিক ১ লাখ স্কয়ার ফিটের মতো উৎপাদন করছি। দেশে অনেক কোম্পানিই রয়েছে যারা দৈনিক ৫ লাখও উৎপাদন করছে। তবে তাদের সঙ্গে আমাদের পার্থক্য হলো ওসব কোম্পানি ভালো এবং সাধারণ মান- উভয় ধরণের পণ্য উৎপাদন করছে। আমরা শুধু ভালো গুণগত মানের টাইলসই বানাই। বড় কোম্পানিগুলো সংখ্যা দেখে। আমরা দেখি গুণগতমান"।
"আমাদের পরিকল্পনা হলো- স্বল্প পরিসরে হলেও সেরা মানের পণ্য বাজারজাত করা। একটি প্রিমিয়াম ব্র্যান্ড তৈরি করা"।