কুমিরের চামড়া বৈদেশিক মুদ্রা আনছে
ভালুকা সদর উপজেলা থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে শালবনের ভেতর উথুরা ইউনিয়নের হাতিবের গ্রাম। গ্রামটি এখন পরিচিত কুমির গ্রাম হিসেবে। এখানেই গড়ে তোলা হয়েছে কুমিরের বিশাল খামার। এ প্রকল্পের উদ্যোক্তা 'রেপটাইলস ফার্ম লিমিটেড। ২০০৪ সালে মালয়েশিয়া থেকে ৭৫টি কুমির এনে এই খামারের শুরু। এখন পর্যন্ত এক হাজার ৫০৭টি কুমিরের চামড়া জাপানে রপ্তানি করেছে প্রতিষ্ঠানটি। প্রতিটি চামড়ার বিক্রয় মূল্য ৫শ ডলার। সে হিসেবে প্রায় ৬ কোটি টাকার কুমিরের চামড়া রপ্তানি করেছে ফার্মটি।
১৫ একর জায়গা নিয়ে এ খামারের যাত্রা শুরু করে রেপটাইলস ফার্ম। ছোট-বড় মিলিয়ে কুমির এখানে এখন রয়েছে প্রায় তিন হাজার। প্রজনন মৌসুমে মা কুমিরের দেয়া ডিম থেকে প্রতি বছর কৃত্রিম উপায়ে প্রায় এক হাজার কুমিরের বাচ্চা উৎপাদন হয়। বর্ষাকালে একটি কুমির ৫০-৬০টি ডিম দেয়। এই ডিম থেকে বাচ্চা ফুটিয়ে, ধাপে ধাপে নিবিড় পরিচর্যার মাধ্যমে হ্যাচারিতে স্থানান্তর করা হয় ছোট কুমিরদের। এখান থেকে রপ্তানিযোগ্য কুমিরগুলো হ্যাচারি থেকে তুলে এনে আলাদা শেডে রাখা হয়। ছয় থেকে আট মাস সেখানে রেখে নানা প্রক্রিয়ার পর কুমির থেকে চামড়া আলাদা করে বিদেশে রপ্তানি করা হয়। বর্তমানে প্রতি বছর প্রায় চারশো কুমিরের চামড়া রপ্তানি হচ্ছে বিদেশে।
কুমিরের প্রজনন ও বাসযোগ্য করে খামারটি গড়ে তুলতে প্রথম দিকে নানা সমস্যায় পড়তে হয়েছে বল জানান 'রেপটাইলস ফার্ম লিমিটেডে'র কুমিরের খামার ম্যানেজার আবু সাইম মোহাম্মদ আরিফ। প্রকল্পের শুরু থেকেই তিনি খামারটিতে কাজ করছেন।
তিনি বলেন, 'প্রথম দিকে আমরা খামারে কাজের জন্য লোক খুঁজে পাচ্ছিলাম না। ভয়ে কোন শ্রমিক আসতো না। এটা শুরুতে বড় সমস্যা ছিল। পরবর্তিতে শ্র্রমিক পাওয়া গেলেও তারা গ্রামের সাধারণ মানুষ। কুমির পালনে কোন দক্ষতা নেই তাদের। তবে এই শ্রমিকদের অস্ট্রেলিয়া থেকে ট্রেইনার এনে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। এখন সব মিলিয়ে ২৫ জন কর্মচারি রয়েছে।'
আবু সাইম মোহাম্মদ আরিফ আরও জানান, একেকটি কুমির রপ্তানিযোগ্য করে তৈরি করতে দেড় থেকে দুই বছর প্রতিপালনে প্রায় ২০ হাজার টাকা খরচ হয়। রপ্তানির পর্যায়ে এলে একটি কুমিরের বিক্রয় মূল্য দাঁড়ায় প্রায় ৫শ ডলার। জাপানের হরইউচি ট্রেডিং কোম্পানি আমাদের কাছ থেকে নিয়মিত চামড়া কিনছে। এসব চামড়া থেকে ব্যাগ, বেল্ট, জুতা ইত্যাদি তৈরি হয়।
এখানে শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন আব্দুর রহিম। কুমিরকে খাওয়ান তিনি। কথা হয় তার সাথে। তিনি বলেন, প্রথমে ভয় করতো, এখন ভয় কেটে গেছে। কুমিরকে নিয়মিত খাবার দিচ্ছি। ব্রয়লার মুরগী ও গরুর মাংস দেয়া হয় খাবার হিসেবে। যখন ডিম দেয় তখন ডিম সংগ্রহ করি। এই কাজটি করতে এখনো ভয় করে আমার। মা কুমির তার ডিমকে সবসময় পাহারা দেয়। এসময় কুমির খুবই উত্তেজিত থাকে। এখন অভ্যাস হয়ে গেছে, তাই সমস্যা হয় না।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ বিভাগের উপপরিচালক কৃষিবিদ দীন মোহাম্মদ দীনু কাজ করেছেন কুমিরের খামার ও এর রপ্তানি আয়ের সম্ভাবনা নিয়ে। তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, 'কুমিরের খামার একটি সম্ভাবনাময় ও অর্থনৈতিকভাবে খুবই লাভজনক একটি খাত হতে পারে। বিদেশে এর চাহিদা রয়েছে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করা গ্রাজুয়েটদের অনেকেই তাদের নিজস্ব দক্ষতায় এদেশে একাধিক কুমিরের খামার গড়ে তুলেছে এবং বিদেশে রপ্তানি করে আয়ও করছে।'
তিনি আরও বলেন, 'রপ্তানির জন্য তৈরি হওয়া কুমিরের চামড়া, হাড়, দাঁত অত্যন্ত চড়া দামে বিক্রি হয় আন্তজাতিক বাজারে। কুমিরের প্রতি কেজি মাংস ৪০-৫০ ডলারে বিক্রি হয় বিদেশে। প্রায় ১৫ ডলারে বিক্রি হয় ১ বর্গ সেন্টিমিটার চামড়া। চামড়া দিয়ে বেল্ট, মহিলাদের ভ্যানেটি ব্যাগ, জুতাসহ অনেক দামি জিনিস তৈরি করা হয়। এ ছাড়াও কুমিরের হাড় থেকে তৈরি হয় পারফিউম, দাঁত থেকে গয়না ও নানা রকম সৌখিন জিনিস, এক কথায়, কুমিরের কোনো কিছুই ফেলনা নয়।'
রেপটাইলস ফার্ম লিমিটেড এর কুমিরের খামার প্রকল্পের উপদেষ্টা ড. এস এম এ রশিদ বলেন, 'প্রথমত পৃষ্ঠপোষকতা দরকার। আমরা যখন শুরু করি তখন এই বিষয়ে সরকারেরও ধারনা কম ছিলো। কোনো নীতিমালা ছিলো না। এখন নীতিমালা হয়েছে। তবে এই ব্যাবসাটি একটি সময়সাপেক্ষ ব্যবসা। হুট করে এসে চাষ করে কোটিপতি হয়ে গেলাম এম না। শুরু করার পর এখানে সময় ব্যয় করতে হবে। একটি কুমির ৮০ থেকে ১০০ বছরেরও বেশ সময় বাঁচে, ডিম দেয়। এই ব্যাবসাটি জেনারেশনের পর জেনারেশন করতে পারবে। ব্যয়বহুল একটি প্রজেক্ট। সাথে প্রশিক্ষিত জনবল প্রয়োজন। সব বিষয় মাথায় রেখে এই ব্যবসায় নামতে হবে। তিনি বলেন কুমির চাষে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অপার সম্ভাবনা রয়েছে। এক্ষেত্রে সরকারকেও এগিয়ে আসতে হবে। এটি একটি সম্ভাবনাময় খাত।'
জাহাঙ্গিরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রানীবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মনিরুল খান বলেন, 'এটি খুবই লাভজনক ব্যবসা। এর পুরোটাই এক্সপোর্ট নিভর্র। আন্তর্জাতিক বাজারে কুমিরের চামড়া ও মাংশের যে চাহিদা আছে তার তুলনায় সরবরাহ কম। বাংলাদেশে এই চাষে ব্যাপক সম্ভাবনা আছে। কারণ আমাদের দেশের আবহাওয়া কুমিরের গ্রোথের জন্য সহায়ক। আর এদের রোগবালাইও হয় অনেক কম। অল্প খাবারে অনেকদিন পালন করা যায়। যেহেতু দেশে শ্রমিকের পারিশ্রমিক কম, আবহাওয়া সহায়ক এবং আন্তর্জাতিক বাজার তৈরি হয়েই আছে সেহেতু সরকার এই সেক্টরে নজর দিলে বৈদেশিক মুদ্রা আসবে।'
তিনি আরও বলেন, 'এক্ষেত্রে কম সুদে লোন দেয়া হলে অনেকেই এগিয়ে আসবে। নতুন ব্যবসার ক্ষেত্র তৈরি হবে। বাড়বে কর্মসংস্থানও।'
বাণিজ্যিকভাবে কুমির চাষের পাশাপাশি এ খামার এলাকায় ৫ হাজার ফলদ ও বনজ গাছের সমন্বয়ে ছায়াঘেরা নৈসর্গিক প্রাকৃতিক পরিবেশও গড়ে তুলেছে রেপটাইলস ফার্ম লিমিটেড।