বিশ্বের সবচেয়ে ব্যয়বহুল টিভি শো: প্রতি সিজনে খরচ ৪০০ মিলিয়ন ডলার
মহামারির সময় স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মের জনপ্রিয়তা বেড়ে যাওয়ায় হলিউড স্টুডিওগুলো দর্শক টানতে ব্যয়বহুল প্রোডাকশন তৈরির প্রতিযোগিতায় নামে। একে অপরকে পেছনে ফেলতে স্টুডিওগুলো বিপুল অর্থ বিনিয়োগ শুরু করে, যা এখন পর্যন্ত কয়েক শত বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। এর মধ্যে একটি শো শীর্ষস্থান দখল করেছে।
স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মের সফলতা নির্ভর করে "টেন্টপোল" প্রোডাকশনের ওপর। এই টেন্টপোল প্রোডাকশন এমন কনটেন্টকে বোঝায়, যা প্রচুর দর্শক আকর্ষণ করে এবং নতুন সাবস্ক্রাইবার বাড়িয়ে দেয়। স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মগুলো আলাদা করে কোনো শো দেখার জন্য টাকা নেয় না; তারা একক সাবস্ক্রিপশনের মাধ্যমে সব কনটেন্টে প্রবেশাধিকার দেয়। তাই প্ল্যাটফর্মগুলোর লাভ হিসেব করা হয়, দর্শক টানার সক্ষমতার ভিত্তিতে। আর এই ধরনের শো তৈরিতে খরচ কম নয়।
২০১১ সালে এইচবিও তাদের "গেম অব থ্রোনস" সিরিজ দিয়ে এই ট্রেন্ড শুরু করে। এরপর ২০১৩ সালে নেটফ্লিক্স তাদের "হাউস অব কার্ডস" প্রোডাকশন দিয়ে বিপুল জনপ্রিয়তা পায়। ডিজনি প্লাস ২০১৯ সালে স্টার ওয়ারস এবং মার্ভেল ফ্র্যাঞ্চাইজির শো দিয়ে স্ট্রিমিং দুনিয়ায় প্রবেশ করে।
এই প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে অ্যামাজন তাদের প্রাইম প্ল্যাটফর্মে আরও বড় কিছু নিয়ে আসার পরিকল্পনা করে। স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মে দর্শকদের আকর্ষণ ধরে রাখতে ভবিষ্যতেও এই ব্যয়বহুল প্রতিযোগিতা চলতে থাকবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
২০১৭ সালে অ্যামাজন জনপ্রিয় ফ্যান্টাসি সিরিজ 'দ্য লর্ড অব দ্য রিংস'-এর টেলিভিশন স্বত্ব কিনতে ২৫০ মিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে জানার পর মিডিয়া দুনিয়ায় আলোড়ন সৃষ্টি হয়। ব্রিটিশ লেখক জেআরআর টলকিনের এই বইগুলো ১৯৫০-এর দশকে প্রকাশিত হয় এবং বিশ্বব্যাপী বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করে।
অ্যামাজনের প্রধান নির্বাহী জেফ বেজোস এই চুক্তিতে ব্যক্তিগতভাবে জড়িত ছিলেন। সূত্র জানায়, বেজোস নিজেই সিরিজটির বড় ভক্ত এবং এর বাণিজ্যিক সম্ভাবনা নিয়ে তিনি অত্যন্ত আশাবাদী ছিলেন।
এর আগে নিউজিল্যান্ডের নির্মাতা পিটার জ্যাকসন বইগুলোকে ছয়টি চলচ্চিত্রে রূপান্তর করেন, যা বিশ্বব্যাপী ৫.৯ বিলিয়ন ডলার আয় করে। এই বিশাল সাফল্য থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে বেজোস মনে করেন, স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মে সিরিজটির নতুন সংস্করণ আরও বড় সাড়া ফেলতে পারে।
বেজোস বুঝতে পেরেছিলেন, টলকিনের এই ক্লাসিক গল্প আরও বড় লাভের সম্ভাবনা তৈরি করতে পারে। তার এই উচ্চাকাঙ্ক্ষী উদ্যোগ শুধু অ্যামাজনের জন্য নয়, পুরো স্ট্রিমিং দুনিয়ায় নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে।
অ্যামাজন 'দ্য লর্ড অব দ্য রিংস' সিরিজের প্রিক্যুয়েল 'দ্য রিংস অব পাওয়ার' নির্মাণের মাধ্যমে জনপ্রিয় 'গেম অব থ্রোনস'-এর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চেয়েছিল। সিরিজ নির্মাণে কোনো খরচের কমতি রাখা হয়নি। ২০১৮ সালে হলিউড রিপোর্টার এই সিরিজের পাঁচ সিজনের সম্ভাব্য ব্যয় ১ বিলিয়ন ডলার বলে উল্লেখ করে। তবে ডেইলি মেইল সম্প্রতি জানিয়েছে, প্রথম দুই সিজনেই প্রায় এই পরিমাণ খরচ হয়ে গেছে।
এটি নির্মাণ করতে বিপুল অর্থ ব্যয় হলেও অ্যামাজন আনুষ্ঠানিকভাবে এর বাজেট নিয়ে কোনো মন্তব্য করেনি। সাধারণত স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মগুলো তাদের প্রোডাকশনের ব্যয়ের তথ্য গোপন রাখে, কারণ বিভিন্ন প্রজেক্টের খরচ একত্রে দেখানো হয়। তবে নিউজিল্যান্ডে নির্মিত প্রোডাকশনগুলো ব্যতিক্রম। দেশটির সরকার প্রোডাকশন খরচের ২০ শতাংশ ফেরত দেয়, যার জন্য নির্মাতারা আলাদা কোম্পানি তৈরি করে ব্যয়ের বিস্তারিত তথ্য জমা দেয়। এভাবেই 'দ্য রিংস অব পাওয়ার'-এর খরচের তথ্য প্রকাশিত হয়েছে।
দ্য রিংস অব পাওয়ার এর প্রথম সিজন নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ৩৫০.৭ মিলিয়ন ডলার। মূলত অর্কদের বিশাল সেনাবাহিনী ও দৃশ্যপট তৈরিতে এই খরচ হয়েছে। দ্বিতীয় সিজন, যা যুক্তরাজ্যে চিত্রায়িত হয়েছে, নির্মাণে খরচ হয়েছে ৪৫৮.২ মিলিয়ন ডলার।
প্রথম সিজনের ভিজ্যুয়াল ইফেক্টস-এ কাজ করেছেন ১,৫০০ এর বেশি শিল্পী। ওয়েটা এফএক্স এতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে। দ্বিতীয় সিজনেও ভিজ্যুয়াল ইফেক্টের মান ধরে রাখা হয়েছে।
যুক্তরাজ্য সরকার দ্বিতীয় সিজনের নির্মাণ ব্যয়ের ৯১.৯ মিলিয়ন ডলার ফেরত দিয়েছে, যা দেশটির ২৫.৫ শতাংশ কর প্রণোদনার আওতায় পরে। শুটিংয়ে ৫২২ জন স্থানীয় কর্মী কাজ করেছেন এবং তারা মোট ৩৫.৭ মিলিয়ন ডলার মজুরি পেয়েছেন।
প্রতিটি মিনিটের জন্য এই শো-এর ব্যয় ৮ লাখ ৫০ হাজার ডলার, যা যুক্তরাজ্যের প্রণোদনা পেতে প্রয়োজনীয় সর্বনিম্ন
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মাত্র ৩৭ শতাংশ দর্শক পুরো প্রথম সিজন দেখেছেন। দ্বিতীয় সিজনের প্রিমিয়ার মাত্র ৯ লাখ দর্শক দেখেছেন, যা প্রথম সিজনের প্রিমিয়ারের অর্ধেক।
টলকিন এস্টেটের চাওয়া অনুযায়ী, শোটি যুক্তরাজ্যে চিত্রায়িত হয়েছে। অ্যামাজন লন্ডনের বাইরে অবস্থিত সেই স্টুডিওটি কিনে নেয়, যেখানে দ্বিতীয় সিজনের শুটিং হয়েছিল। তবে, শো-এর বিপুল বাজেটের বিপরীতে দর্শক কম থাকার কারণে এর আর্থিক সফলতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
'দ্য রিংস অব পাওয়ার' বৈচিত্র্যময় অভিনেতা-অভিনেত্রীদের জন্য ব্যাপক সমালোচনার মুখোমুখি হয়েছে। অনেক বইয়ের ভক্তের দাবি, টলকিনের মাস্টারপিসকে আধুনিক বিশ্বের জন্য আপডেট করা হয়েছে, যা মূল বইয়ের গল্পকে বিকৃত করেছে। এই বিতর্কের ফলে সিরিজটি রটেন টমেটোজ ওয়েবসাইটে মাত্র ৪৯ শতাংশ রেটিং পেয়েছে, যেখানে 'গেম অব থ্রোনস' পেয়েছিল ৮৫ শতাংশ রেটিং।
বিশাল বাজেট এবং যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে তুলনামূলক কম দর্শক থাকা সত্ত্বেও মিডিয়া বিশ্লেষক টম হ্যারিংটন বলেন, "অ্যামাজন এই সিরিজ থেকে তেমন লাভ করতে পারবে না।" তবে তিনি উল্লেখ করেন, "প্রাইম ভিডিওর প্রধান উদ্দেশ্য হলো, তৃতীয় পক্ষের ভিডিও সাবস্ক্রিপশন বিক্রি এবং সিনেমা ভাড়া দেওয়া। এসব ক্ষেত্রে মূল কনটেন্ট, যেমন দ্য রিংস অব পাওয়ার, দর্শকদের প্ল্যাটফর্মে আকৃষ্ট করার এক উপায় হিসেবে কাজ করে।"
তবে শেষ পর্যন্ত 'দ্য রিংস অব পাওয়ার' যতটুকু না দর্শক টানতে পেরেছে, তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো সিরিজটিকে ঘিরে তৈরি হওয়া উত্তেজনা, যা নিঃসন্দেহে স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মের দুনিয়ায় বড় প্রভাব ফেলেছে।