কেএসআরএম গ্রুপের বিরুদ্ধে ২৩১ কোটি টাকার ভ্যাট ফাঁকির অভিযোগ
দেশের শীর্ষস্থানীয় রড উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান কেএসআরএমের বিরুদ্ধে ক্রয়-বিক্রয়ের তথ্য গোপন করে গত পাঁচ বছরে ২৩১ কোটি টাকা ভ্যাট ফাঁকি দেয়ার অভিযোগ উঠেছে।
গত মাসে প্রতিষ্ঠানটির একটি কারখানায় অভিযান চালানোর পর চট্টগ্রাম কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেট প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছে।
২২ জুন চট্টগ্রাম কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেটের একটি দল অভিযান পরিচালা করে প্রতিষ্ঠানটির বাণিজ্যিক দলিলাদি এবং দুটি কম্পিউটার জব্দ করে।
জব্দকৃত দলিলাদি থেকে বেরিয়ে আসে ক্রয়-বিক্রির তথ্য গোপন করে এই বিপুল অংকের ভ্যাট ফাঁকির তথ্য। ফাঁকিকৃত অর্থ আদায়ে বিভাগীয় মামলা দায়ের করেছে কাস্টমস এক্সাইজ ভ্যাট কমিশনারেট।
চট্টগ্রাম কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেটের অনুসন্ধানের প্রতিবেদনটি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের হাতে এসেছে।
প্রতিবেদনের তথ্যমতে, কেএসআরএম উৎপাদিত পণ্য বিক্রয়ে ভ্যাট ও কাঁচামাল ক্রয়ে উৎসের ভ্যাটে এসব টাকা ফাঁকি দিয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি উৎপাদিত পণ্যের তথ্য গোপন করে ৮৫ কোটি ২৯ লাখ ১৫ হাজার ৬৯৫ টাকা এবং কাঁচামাল ক্রয়ে উৎসে মূসক বাবদ ১৪৫ কোটি ৮৭ লাখ ৬৮ হাজার ৭৮৪ টাকা ফাঁকি দিয়েছে।
এই বিষয়ে চট্টগ্রাম কাস্টমস, এক্সাইস ও ভ্যাট কমিশনারেট এর উপ-কমিশনার আহসান উল্লাহ বলেন, "রড উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান কেএসআরএম দীর্ঘদিন ধরে মূসক ফাঁকি দিয়ে যাচ্ছে এমন তথ্যের ভিত্তিতে আমরা প্রতিষ্ঠানটির কারাখানায় অভিযান পরিচালনা করি। অভিযানে জব্দকৃত দলিলাদি বিশ্লেষণ করলে প্রতিষ্ঠানটির বিশাল মূসক ফাঁকির এই তথ্য বেরিয়ে আসে।"
কেএসআরএম স্টিল প্ল্যান্ট লিমিটেড ২০০৬ সালের জুলাই থেকে চলতি বছরের মে পর্যন্ত ১৮ কোটি ৭৪ লাখ ৩৭৬ মেট্রিক টন এমএস রড উৎপাদন শেষে বাজারজাত করে।
বিপরীতে প্রতিষ্ঠানটির ১৮৮ কোটি ৭১ লাখ ৪৬ হাজার ৫১৪ টাকা মূসক পরিশোধ করার কথা। কিন্তু তা না করে প্রতিষ্ঠানটি শুধুমাত্র ১০৩ কোটি ৪২ লাখ ৩০ হাজার ৮১৭ টাকা মূসক পরিশোধ করে। এতে প্রতিষ্ঠানটি সরকারের মূসক ফাঁকি দেয় ৮৫ কোটি ২৯ লাখ ১৫ হাজার ৬৯৫ টাকা।
অন্যদিকে, কাঁচামাল ক্রয়সহ সকল কেনাকাটার বিপরীতে উৎসে মূসক দেয়ার বিধান থাকলেও প্রতিষ্ঠানটি ২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের মে পর্যন্ত সমস্ত ক্রয়ের বিপরীতে উৎস মূসক কর্তনের কোনো দলিলাদি কিংবা রিটার্ন প্রদর্শন করে নি। এভাবে গত সাড়ে চার বছরে ১৯ লাখ ৯৭ হাজার ৮৮৭ মেট্রিক টন কাঁচামাল ক্রয়ের বিপরীতে প্রতিষ্ঠানটি উৎসে মূসক ফাঁকি দিয়েছে ১৪৫ কোটি ৮৭ লাখ ৬৮ হাজার ৭৮৪ টাকা।
এই বিষয়ে কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেট চট্টগ্রামের কমিশনার মোহাম্মদ আকবর হোসেন বলেন, "কেএসআরএম নামক প্রতিষ্ঠানটি দীর্ঘদিন ধরে যথাযথভাবে মূসক পরিশোধ করছে না এবং নিয়মিত মূসক ফাঁকি দিয়ে যাচ্ছে বলে গোপন সংবাদ পাই। আমাদের নিবারক দলের মাধ্যমে তল্লাশি এবং তদন্তে বিশাল ফাঁকি বের হয়ে আসে।"
প্রতিষ্ঠানটিকে শিগগিরই কারণ দর্শানোর নোটিস জারি করা হবে। এক্ষেত্রে ফাঁকিকৃত রাজস্বের সমান পরিমাণ জরিমানা এবং প্রযোজ্য সুদ পরিশোধ করতে হবে। ফাঁকিকৃত অর্থ তাদের সরকারি কোষাগারে জমা দিতে হবে। এ ব্যাপারে কোন ধরনের ছাড় দেয়া হবে না।
উল্লেখ্য, দেশে প্রতিবছর এমএস রডের চাহিদা প্রায় ৬০ লাখ মেট্রিক টন। ছোট-বড় মোট ২৩৫ টি কারখানা প্রতিবছর ৬০ থেকে ৭০ লাখ মেট্রিক টন এমএস রড উৎপাদন করে। এর মধ্যে দেশের শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠান কেএসআরএম প্রতিবছর প্রায় ছয় থেকে আট লাখ মেট্রিক টন রডের যোগান দেয় বাজারে।
কেএসআরএম স্টিল প্ল্যান্টের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মেহেরুল করিম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "বিষয়টি সম্পর্কে আমি অবগত নই। ভ্যাটের বিষয়টি দেখার জন্য আমাদের আলাদা ভ্যাট এন্ড লিগ্যাল ডিপার্টমেন্ট রয়েছে। ওই ডিপার্টমেন্টের সাথে কথা বলে জানাতে পারব।"
কেএসআরএম'র ভ্যাট বিভাগের কর্মকর্তা হাবিবুর রহমান বলেন, "চট্টগ্রাম কাস্টমস্, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেটের লোকজন কারখানায় অভিযান চালিয়ে কিছু কাগজপত্র নিয়ে গেছে তা ঠিক। তবে ভ্যাট কমিশনারেট এর পক্ষ থেকে আমরা এখনো কোন কাগজপত্র হাতে পায় নি।"
কেএসআরএমের বক্তব্য
ইতোমধ্যে চট্টগ্রাম কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেটের বরাতে বিভিন্ন গণমাধ্যমে পাঠানো 'কেএসআরএম স্টিল প্ল্যান্ট লিমিটেডের দুইশত একত্রিশ কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকি উদঘাটন' শিরোনামে যে বিবৃতি দেওয়া হয়েছে ওই ব্যাপারে কেএসআরএম একেবারেই অবগত নয়।
কারণ ভ্যাট কমিশনারেট ইতোমধ্যে কিছু ডকুমেন্ট জব্দ করলেও আমাদের কাছ থেকে কোনো বক্তব্য নেওয়া হয়নি। তাছাড়া বিষয়টি নিয়ে আমাদেরও কিছু জানানো হয়নি লিখিত বা মৌখিকভাবে। যদি ডকুমেন্ট পর্যালোচনায় রাজস্ব ফাঁকি চিহ্নিত হয় তা আমাদের জানানো উচিত ছিলো সবার আগে। তা না করে বিবৃতি দিয়ে কেএসআরএমকে হেয় করা হচ্ছে।
যেকোনো আইনগত পাওনা পরিশোধ করতে কেএসআরএম সবসময় বদ্ধপরিকর। তার মানে এই নয় যে, আমাদের জানানো হবে না। বিষয়টি আমাদের জানানো হলে আমরা সেই উদ্যোগ গ্রহণের সুযোগ পেতাম। পাওয়া পরিশোধের সময়সীমা বেঁধে দেওয়ারও সুযোগ ছিলো। অথচ এ বিষয়ে আমাদের আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগও দেওয়া হয়নি। যা কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না।
বিষয়টি বন্ধের দিন গণমাধ্যমে প্রেস রিলিজ আকারে পাঠানো কোনোভাবেই যৌক্তিক হতে পারে না। এতে করে বিষয়ের সত্যতা যাচাই ও অবগত না হয়ে আমাদের পক্ষে কোনো ধরনের বক্তব্য দেওয়ারও সুযোগ নেই। এটি মূলত একপক্ষীয় সিদ্ধান্ত। সংশ্লিষ্টদের সাথে আমাদের ইতোপূর্বে কোনো ধরনের আলাপ আলোচনা হয়নি। অথচ এ সিদ্ধান্তের কারণে আমাদের ব্র্যান্ড ইমেজ ক্ষতিগ্রস্ত হবে, যা অপ্রত্যাশিত।