চাকরি ছেড়ে দিয়ে নিজেরাই উদ্যোক্তা তারা
অর্পীতা বড়ুয়া, পেশায় একজন ফিজিওথেরাপিস্ট। বেশ অনেক দিন থেকেই মেডিক্যাল প্র্যাক্টিস করছেন না তিনি। ছেলে ছোট থাকায় পরিবারকেই সময় দিচ্ছেন ২ বছর ধরে। এই অবসর সময়টুকু কাজে লাগানোর জন্য এবং পরিবারের সাথে সারাক্ষণ থাকার সিদ্ধান্ত নিয়ে হয়ে উঠেছেন একজন সফল উদ্যোক্তা।
বাসায় বসেই বিভিন্ন ধরনের পিঠা ও আচার তৈরী করে অনলাইনের বদৌলতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকের পেইজের মাধ্যমে তার তৈরী পণ্যগুলো বিক্রি করছেন। পরিবারের সবাই তাকে সহযোগিতা করছে তার এ ব্যতিক্রমধর্মী কাজে।
'ইটসি বিটসি' নামে জনপ্রিয় খাবারের এ পেইজের উদ্যোক্তা অর্পীতা বড়ুয়া দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'আমি প্রায় ৫ বছর ধরে হোম মেড খাবার তৈরী করে অনলাইনের মাধ্যমে গ্রাহকদের কাছে বিক্রি করছি। তবে সম্প্রতি আমি আমার প্র্যাক্টিস বাদ দিয়ে পুরোটা সময়ই পরিবারকে এবং আমার এ কাজে দিচ্ছি। প্রতিমাসে প্রায় ১২০০ জনের খাবারের অর্ডার সরবরাহ করি আমি"।
শুধু খাবারই নয় নিজের হাতে তৈরী করা গহনা, নকশা করা জামা, পাঞ্জাবী, শাড়ি প্রভৃতিও বিক্রি করছেন 'ঋষা' নামক ফেসবুক পেইজের মাধ্যমে। ট্রাডিশনাল আর্টের প্রতি তার অন্যরকম আবেদন রয়েছে।
নিজের ব্যবসার ভবিষ্যত নিয়ে তিনি বলেন, 'আমার খাবারের আইটেমগুলো নিয়ে একটি বড় ইন্ডাস্ট্রি গড়ে তুলতে চাই। সম্পৃক্ত করতে চাই দেশের অবহেলিত নারীদের। আমার বাসার জন্য যে খাবার আমি তৈরী করি সেভাবেই গ্রাহকদের হোম মেড খাবারের গুণগত মান বজায় রেখেই সরবরাহ করে যাচ্ছি'।
শুধু অর্পীতাই নন, বর্তমান সময়ে অনেক নারীই দেশীয় পণ্যের ওপর গুরুত্ব দিয়ে নিজেদের তৈরী খাবার, গহনা, ক্রাফটসহ নানা কাজে সম্পৃক্ততার মাধ্যমে অর্থনৈতিকভাবে সাবলম্বী হচ্ছেন।
এমন নারী উদ্যোক্তাদের নিয়ে গঠিত 'দেশজ ক্রাফটস' এর মাধ্যমে ৫০০ জনেরও বেশি নারী উদ্যোক্তা সম্পৃক্ত করে একটি ই-কমার্স মার্কেটপ্লেস তৈরীর বৃহৎ পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। তৈরী হয়েছে নারী উদ্যোক্তাদের জন্য একটি অনন্য প্লাটফরম। যেখানে উদ্যোক্তারা তাদের তৈরী দেশীয় পণ্য সবার সামনে তুলে ধরছে।
এ সংগঠনটির সদস্যদের বর্তমানে প্রাথমিক ব্যবসার পরিধি প্রায় ২.৫ কোটি টাকার।
এ প্লাটফরমের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে এখানে সবাই দেশীয় পণ্য নিয়ে কাজ করছে।
উদ্যোক্তারা হাতে তৈরী শিকা, ব্যাগ, বিভিন্ন গহনা, পিঠা, আচার, পাত্রে আঁকা নানা ধরণের শৈল্পিক নকশা, জামা, পাঞ্জাবী, শাড়িতে হাতে করা রঙের বিভিন্ন কাজসহ হস্তশিল্পের নানা ধরণের ব্যতিক্রমী কাজ করে নিজেদের তুলে ধরছে অনলাইন মাধ্যমে।
'আর্টিস্টিকস' এর স্বত্বাধিকারী কামরুন নাহার টিবিএসকে বলেন, 'আমি একটা স্কুলে চাকরি করতাম। করোনার মধ্যে হঠাৎ জুন মাসে একদিন স্কুলের ভাইস প্রিন্সিপাল ফোন কল দিয়ে বলেন 'আগামী মাস থেকে তোমার বেতনটা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে'। এর পর থেকে আমি হ্যান্ড পেইন্টের কাজ শুরু করি। আমার ব্যবসার বয়স একদম নতুন হলেও সবার থেকে ব্যাপক সাড়া পাচ্ছি'।
'মাত্র ৪ হাজার টাকা দিয়ে শুরু করি। বর্তমানে প্রায় ৪০ হাজার টাকার পণ্য আছে যেগুলো বিক্রি করবো। মাত্র ৩/৪ মাসে প্রায় ৬০ হাজার টাকার শাড়ি, পাঞ্জাবী, ওয়ানপিস বিক্রি করেছি'।
লতিফা বেগম, উম্মে নাহার ও সালমা ফেরদৌসী তিন বোন তাদের চাকরি ছেড়ে উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে শুরু করেছেন শিকা বানিয়ে অনলাইনে বিক্রি। জানুয়ারিতে শুরু করলেও সবার থেকে বেশ সাড়া পেয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন তারা।
তাদের সাথে কথা হলে টিবিএসকে জানান, ছোটবেলায় তাদের দাদুর কাছ থেকে এ শিকা বানানো শিখে আজ এটিকেই অর্থ উপার্জনের পথ হিসেবে দেখছেন তারা।
দু'মাসেরও কম সময়ের মধ্যে তাদের বানানো প্রায় ৫০টি শিকার সবগুলোই বিক্রি হয়ে গিয়েছে বলে জানান তারা। প্রতিটি শিকার মূল্য ৩০০ থেকে ২০০০ টাকা পর্যন্ত।
'কাদম্বরী'র স্বত্বাধিকারী রাজবি তাসনিম বলেন, আমি এ কাজ শুরু করি দেড় বছর আগ থেকে। আমার নিজের শখ থেকেই শাড়িতে রঙের কাজ করে আমার বন্ধুদের উপহার দিতাম। এক পর্যায়ে এসে এটাকে বাণিজ্যিকভাবে শুরু করি। গত ঈদে তার তৈরীকৃত সবগুলো শাড়ি বিক্রি হয়ে যায়।
তার সাথে প্রায় ৭০ জন নারী কাজ করছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
তাসনিমের মতই আরেকজন উদ্যোক্তা সেলিনা তার সন্তানকে সামলিয়ে দেশীয় কারুকার্য নিয়ে কাজ করছেন। খাদি, মসলিন কাপরের উপর এ কারুকার্য তুলে ধরছে দেশীয় ঐতিহ্য।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষ করে নিজের শেখা দেশীয় গহনা তৈরীর অভিজ্ঞতাতেই একজন সফল উদ্যোক্তা হিসেবে সবার কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠছেন হোসনা এমদাদ। তার এ কাজের হাতেখড়ি প্রায় ৯ বছর আগে হলেও মাত্র দু বছর যাবত বাণিজ্যিকভাবে শুরু করেছেন।
তিনি টিবিএসকে বলেন, 'বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শেষ করার পরে সবারই আগ্রহ থাকে কোনো চাকরিতে সুযোগ করে নিবে কিন্তু আমি সবার থেকে একটু ব্যতিক্রমী চিন্তা করেই দেশীয় সব উপাদান দিয়ে গহনা তৈরী করে অনলাইনে বিক্রির কাজ শুরু করি। সবার থেকে ভালোই সাড়া পাচ্ছি'।
ড চিং চিং কাজ করছেন ব্যতিক্রমী রিক্সা প্রিন্ট নিয়ে। বিভিন্ন বোতল, পানির পট, ব্যাগ, কলম দানি, চাবির রিং প্রভৃতির উপরে রিক্সা প্রিন্ট করে সেগুলো বিক্রি করছে্ন অনলাইনে। সাড়াও পাচ্ছেন বেশ।
করোনাকালীন সময়ে অনেকেই চাকরি হারিয়েছেন কিন্তু দেশজ ক্রাফটের সাথে সম্পৃক্ত অনেক নারীই চাকরি ছেড়ে উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্নে নিজেকে এগিয়ে নিচ্ছেন।
'দেশজ ক্রাফট' এর মডারেটর তাহমিনা তানিয়া টিবিএসকে বলেন, 'শুধু চাকরিতেই সফলতা নয় দেশীয় পণ্য নিয়ে কাজ করলেও যে সফল হওয়া সম্ভব আমরা এ ধারণাকেই প্রতিষ্ঠা করতে পারবো বলে আশা করছি।
আমরা খুব দ্রুতই দেশীয় পণ্যের একটি ই-কমার্স সাইট নিয়ে আসছি। এখানে সবাই যার যার প্রোফাইলে তাদের পণ্যগুলো আপলোড দিবেন'।
'দেশজ ক্রাফট' এর স্বত্বাধিকারী নিশাত মাশফিকা বলেন, 'আমি অনেক আগ থেকেই চেষ্টা করছি যে নারীরা দেশীয় পণ্য নিয়ে কাজ করে তাদেরকে একত্রিত করে একটা প্লাটফরম তৈরী করা। যেটা একটু দেরিতে হলেও করতে পেরেছি। আমরা নিয়মিত আমাদের উদ্যোক্তাদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছি এবং একজন তার আশপাশের আরও নারীদের এ কাজে যাতে সম্পৃক্ত করে সে জন্য তাদের উদবুদ্ধ করা হচ্ছে।
আমাদের সাথে ৫০০ জনের মতো উদ্যোক্তাকে একত্রিত করতে পেরেছি। আমরা আরও বড় পরিসরে এগোনোর চেষ্টা করছি'।