চালের দামে লাগাম নেই
করোনা সংক্রমণের কারণে যখন লাখ লাখ মানুষ চাকরি বা কাজ হারিয়ে দিশেহারা, ঠিক তখনই লাগামহীনভাবে বাড়ছে চালের দাম। যদিও সর্বশেষ বোরো মৌসুমে রেকর্ড পরিমাণ চাল উৎপাদনের দাবি করছে কৃষি বিভাগ।
রাজধানীর চালের বাজার ঘুরে জানা গেছে, সবচেয়ে বেশি পরিমাণে বেড়েছে মোটা চালের দাম। প্রতি কেজি মোটা চাল কিনতে খরচ করতে হচ্ছে বাজারভেদে ৫০-৫৩ টাকা পর্যন্ত। ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) এর মঙ্গলবারের বাজার বিশ্লেষণের তথ্য বলছে, গত এক সপ্তাহে মোটা চালের কেজিতে দুই টাকা পর্যন্ত দাম বেড়েছে। এক মাসের ব্যবধানে এই বৃদ্ধির পরিমাণ প্রায় সাড়ে ৫ শতাংশ এবং গত বছরের তুলনায় মোটা চাল বিক্রি হচ্ছে ১৪.১২ শতাংশ বেশি দামে।
এছাড়া মাঝারি মানের চাল বিক্রি হচ্ছে ৫৬-৬২ টাকার মধ্যে যা গত বছরের তুলনায় প্রায় ১৩ শতাংশ বেশি। সরু বা চিকন চাল বাজারে কিনতে গেলে ৬৫-৭০ টাকা পর্যন্ত খরচ করতে হচ্ছে একেকজন ভোক্তাকে। এই চালও গত বছরের চেয়ে প্রায় ১৪.২৯ শতাংশ বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে।
অথচ কৃষি বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, দেশে বোরো, আমন ও আউশ মৌসুমে সাড়ে তিন কোটি টন চাল উৎপাদিত হয়। সবশেষ বোরো মৌসুমে চালের উৎপাদন ২ কোটি টন ছাড়িয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। যেখানে গত বছর বোরো মৌসুমে ১ কোটি ৯৬ হাজার টন চাল উৎপাদন হয়েছিল।
এ খাতের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ৫০-৫৩ টাকা কেজি দরের চাল নিম্ন আয়ের মানুষের সক্ষমতার বাইরে। সেটা বুঝা যায় ওপেন মার্কেট সেলের বিক্রয়কেন্দ্রগুলো দেখলে। ৩০ টাকা কেজি দরে চাল কিনতে প্রতিদিনই মানুষের লাইন দীর্ঘ হচ্ছে এবং অনেক মানুষ ফিরে যাচ্ছে। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ চাইলে সরকারকে আরও বেশি পরিমাণে চাল বাজারে বিক্রি করতে হবে। যাতে করে ব্যবসায়ীদের উপর একটা চাপ তৈরি হয়।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ইউনিভার্সিটি অব গ্লোবাল ভিলেজের উপাচার্য এবং কৃষি অর্থনীতিবিদ জাহাঙ্গীর আলম খান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "চালের দাম এখন সাধারণ মানুষের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। এই নিয়ন্ত্রণটা এখন ব্যবসায়ীদের হাতে। এর জন্য সরকারকে উদ্যোগী হতে হবে। না হলে সাধারণ মানুষের কষ্ট দীর্ঘ হবে"।
তিনি বলেন, "সরকারের মজুদ এখন ভালো অবস্থায় আছে। এখান থেকে বাজারে প্রচুর পরিমাণে চাল বিক্রি করতে হবে। প্রয়োজনে আমদানি (সরকারিভাবে) করে হলেও বাজারে চালের সরবরাহ সরকারি পর্যায় থেকে বাড়াতে হবে। যাতে ব্যবসায়ীরা চালের দাম কমাতে বাধ্য হয়"।
মালিবাগের খালেক রাইস এজেন্সির মালিক মো. দীদার হোসেন টিবিএসকে বলেন, "মিল মালিকরা কদিন পরপরই চালের দাম বাড়াচ্ছে। তারা জানিয়েছে ধানের দাম বেশি তাই চালের দামও বাড়তি। অথচ চালের বাজার অস্থির হলে ক্রেতা কমে যায়"।
এদিকে মিল মালিকদের দাবি, ধানের দাম বেশি হওয়ার কারণেই চালের দাম বাড়তি। ব্যবসায়ীরা বলছেন, এখন এক মণ ধান কিনতে ১০৫০-১১০০ টাকা খরচ করতে হচ্ছে। কিন্তু কৃষক ও কৃষি বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বোরো মৌসুমের শুরুতে মিলার ও চাতাল মালিকরা যখন ব্যাপকভাবে ধান কিনেছে তখন দাম ছিল মানভেদে ৬০০-৮০০ টাকার মধ্যে। এখন যখন কৃষকের হাতে ধান নেই তখন দাম হয়েছে ১০৫০-১১০০ টাকা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ অটো মেজর এন্ড হাস্কিং মিল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক লায়েক আলী দাবি করেন, "ধান এখন মৌসুমি ব্যবসায়ীদের হাতে। তাদের কাছ থেকে কিনতে হচ্ছে বাড়তি দাম দিয়ে। এক্ষেত্রে চালের দাম কমানোর কোন সুযোগ নেই। কারণ মিলারদের হাতে ধান নেই"।
সরকারের সংগ্রহ ও মজুদ পরিস্থিতি
সরকার ১০৮০ টাকা মণ হিসেবে বোরোর উৎপাদন থেকে ৬ লাখ ৫০ হাজার টন ধান কেনার ঘোষণা দিয়েছিল। যেখানে গত মাসের ২৯ তারিখ পর্যন্ত ৩ লাখ ১৬ হাজার ৫২৪ মেট্রিক টন বোরো ধান কিনতে পেরেছে। অন্যদিকে গত মৌসুমের চেয়ে কেজিতে ৪ টাকা বাড়িয়ে ৪০ টাকা কেজি দরে সাড়ে ১১ লাখ টন চাল কেনার ঘোষণার বিপরীতে ৮ লাখ সাড়ে ৯ হাজার টন চাল কিনতে পেরেছে। সরকারের ক্রয় কার্যক্রম ৩১ আগস্ট শেষ হবে।
এতে করে অবশ্য এ বছরের শুরুর দিকে তলানিতে নেমে আসা মজুদ বেশ ভালো অবস্থান পেয়েছে। খাদ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে ১৫.৬৬ লাখ টন খাদ্যশস্যের মজুদ রয়েছে। যেখানে ১১.৯৭ লাখ টন চাল, ২.৪৭ লাখ টন গম ও ১.৮৭ লাখ টন ধান রয়েছে।
দুদিন আগে খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার রাজশাহীর নওগাঁতে লোকাল সাপ্লাই ডিপো (এলএসডি) পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের বলেন, ইতোমধ্যে ওএমএস কার্যক্রমে চালের বরাদ্দ দ্বিগুণ করা হয়েছে। সেপ্টেম্বর মাস থেকে খাদ্য বান্ধব কর্মসূচিতে চাল বিতরণ শুরু হবে।