ছাই থেকে সোনা সংগ্রহের ‘ছালি ব্যবসা’
'যেখানে দেখিবে ছাই উড়াইয়া দেখ তাই, পাইলেও পাইতে পারো অমূল্য রতন' কবি গগণ চন্দ্র দাসের কবিতার বাস্তব প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠেছে মানিকগঞ্জের সিংগাইর উপজেলার গোবিন্দল এবং চারিগ্রাম ইউনিয়নে। স্বর্ণের গহনা তৈরির দোকানের পরিত্যক্ত ছাই থেকে সোনা সংগ্রহে ব্যস্ত রয়েছে এই দুই ইউনিয়নের প্রায় চার হাজার পরিবার।
ছাই থেকে সোনা সংগ্রহের এই ব্যবসাটি স্থানীয়ভাবে 'ছালি ব্যবসা' নামে পরিচিত। ছাই থেকে সোনা সংগ্রহের জন্য ছালি ব্যবসায়ীদেরকে বেশ কিছু ধাপ অতিক্রম করতে হয়। প্রয়োজন অধিকতর মূলধন এবং শ্রমিকের। যে কারণে পরিবারের পুরুষ সদস্যদের পাশাপাশি এই কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত রয়েছে নারীসহ অন্য সদস্যরাও।
স্বর্ণের দোকানের পরিত্যক্ত এই ছাই থেকে শুধুমাত্র সোনা নয়, রূপা, তামা, সীসা ও ব্রোঞ্জ খুঁজে বের করেন ছালি ব্যবসায়ীরা। সোনা এবং রূপা বিকিকিনির জন্য চারিগ্রাম বাজারে গড়ে উঠেছে প্রায় ৭০ থেকে ৮০টি জুয়েলারী দোকান। এসব দোকান ছাড়াও দেশের বিভিন্ন জায়গায় বিক্রি হয় ছাই থেকে সংগৃহীত সোনা এবং রূপা।
ছাই সংগ্রহের পদ্ধতি
দেশের বিভিন্ন এলাকার স্বর্ণের গহনা তৈরির দোকান থেকে ছাই সংগ্রহ করেন সিংগাইরের ছালি ব্যবসায়ীরা। তবে খুলনা, যশোর, নড়াইল, বগুড়া, রাজশাহী, সিরাজগঞ্জ, জামালপুর এলাকায় সিংগাইরের ছালি ব্যবসায়ীদের পদচারণা বেশি। প্রয়োজনীয়তার উপর নির্ভর করে যাচাইবাছাই শেষে নির্ধারণ করা হয় ছাইয়ের দরদাম।
ছাই থেকে সোনা সংগ্রহের পদ্ধতি
স্বর্ণের দোকান থেকে সংগ্রহ করা ছাই থেকে সোনা সংগ্রহের জন্য প্রথমে ছাঁকন পদ্ধতিতে ছাইগুলো সূক্ষ্ম একটি চালনিতে নিয়ে চালতে হয়। এরপর সেই ছাইগুলোকে ঢেঁকিতে ছেটে পরিষ্কার পানির সঙ্গে মিশিয়ে পিণ্ড তৈরি করতে হয়।
এবার সেই পিণ্ডগুলোকে ভালো করে রৌদ্রে শুকিয়ে নেন ছালি ব্যবসায়ীরা। শুকানো পিণ্ডগুলোকে আগুনের তাপ দেন। এতে করে সেই পিণ্ডগুলো থেকে ময়লা বের হয়ে যায়। পিণ্ডের বাকী অংশে জড়িয়ে থাকে সোনা, রূপা, তামা, সিসা ও ব্রোঞ্জ।
তরল এসব পদার্থকে মাটিতে গর্ত করে চুন ও ধানের তুষ দিয়ে পুড়িয়ে সিসা বের করা হয়। এরপর ছাঁকনি দিয়ে ছেঁকে পানিতে ধুয়ে আলাদা করা হয় সিসাগুলোকে। বাকী অংশ থেকে নাইট্রিক এসিড ও আরও কিছু কেমিক্যাল মিশিয়ে আলাদা করা হয় সোনা ও রূপা। এভাবেই ছাই থেকে সোনা সংগ্রহ করেন ছালি ব্যবসায়ীরা।
সিংগাইর উপজেলার চারিগ্রাম ইউনিয়নের ছালি ব্যবসায়ী মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, গহনা তৈরির দোকান থেকে অল্প কিছু ছাই ছাঁকনি দিয়ে চেলে যাচাই-বাছাই শেষে ব্যবসায়ীক অভিজ্ঞতার মাধ্যমে ছাইয়ের দাম নির্ধারণ করা হয়। স্বর্ণ পাওয়ার অনুমানের উপর ভিত্তি করে প্রতি বস্তা (দুই মণের বস্তা) ছাইয়ের দাম দেওয়া হয় দুই থেকে দশ হাজার টাকা পর্যন্ত। অনেক সময় আবার এর চেয়ে বেশি দামেও ছাই সংগ্রহ করা হয়।
নুরু মিয়া নামের আরেকজন ছালি ব্যবসায়ী বলেন, ছাই কেনার উপর ভিত্তি করে সোনা পাওয়া যায়। অনেক সময় বেশিদামে ছাই কিনেও আশানুরূপ সোনা পাওয়া যায় না। অর্থ্যাৎ ছালি ব্যবসা নির্ভর করে ছাই কেনার উপর। ভাগ্য ভালো থাকলে মুনাফা বেশি। আবার অনেক সময় লোকসান গুনতে হয় বলে মন্তব্য করেন তিনি।
তিন যুগের ছালি ব্যবসায়ী মোয়াজ্জেম হোসেন জানান, ছালি ব্যবসায় ৭/৮ জন শ্রমিক নিয়ে কাজ করেন তিনি। করোনার শুরু থেকেই ব্যবসায় মন্দা। করোনাকালীন সময়ে ছাই সংগ্রহ করা বেশ কঠিন হয়ে পড়েছে। প্রয়োজন অনুযায়ী ছাইয়ের স্বল্পতাও রয়েছে।
গহনা তৈরির একটি দোকান থেকে স্বাভাবিক সময়ে বছরে ১/২ বার ছাই ক্রয় করা যায়। সংক্রমণ এড়াতে গহনা তৈরির দোকান বন্ধ থাকায় ছাই পাওয়া বেশ কষ্টকর হয়ে পড়েছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
খায়ের হোসেন নামের একজন ব্যবসায়ী বলেন, ছাইয়ের উপর ভিত্তি করে সোনা পাওয়া যায়। প্রতি মাসে অনেক ব্যবসায়ী দুই থেকে তিন ভরি পর্যন্ত পায়। আবার অনেকেই মাসে এক ভরিও পায় না। এটি ব্যবসায়ীক মূলধন ও ভাগ্যের উপর নির্ভরশীল।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দাসেরহাটি এলাকার একজন গৃহিণী বলেন, ছাই থেকে সোনা সংগ্রহ করা বেশ কষ্টসাধ্য কাজ। মুনাফার অভাবে বাড়তি শ্রমিক নিয়ে কাজ করার উপায় না থাকায় তিনিও সোনা সংগ্রহের কাজে সহায়তা করেন। এতে করে কিছুটা হলেও মুনাফা বাড়ে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
ফরহাদ হোসেন বলেন, ছাইয়ের মান ভালো থাকলে ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা খরচ করেই এক ভরি পরিমাণ সোনা পাওয়া যায়। তবে এটি নিশ্চিত করে বলার উপায় নেই। ছাইয়ের মান খারাপ থাকলে লোকসানও হয়।
আরমান আলী বলেন, ছাই থেকে সোনা সংগ্রহের পর তা স্থানীয় চারিগ্রাম বাজারে বিক্রি করা হয়। বড় ছালি ব্যবসায়ীরা বেশি সোনা একত্র করে আবার ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় বিক্রি করেন। লাভ-লোকসানের মধ্য দিয়েই এই ব্যবসায়ী ৬ যুগ পার করে দিয়েছেন বলে জানান তিনি।
চারিগ্রাম বাজারের 'ফারিয়া জুয়েলারী'র মালিক ফারুক হোসেন বলেন, স্থানীয় ছালি ব্যবসায়ীর নিকট থেকে সোনা কিনে তিনি বিক্রি করেন। এই ব্যবসার জন্য অধিক মূলধন প্রয়োজন। যার মূলধন যতো বেশি তার মুনাফাও ততো বেশি। ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকা খরচ করে তিনি মাসে প্রায় ৬০ থেকে ৭০ হাজার টাকা আয় করেন বলে মন্তব্য করেন।
চারিগ্রাম জুয়েলারী সমবায় সমিতির সভাপতি মানিক হাসান বলেন, ছালি ব্যবসায়ীদের নিকট থেকে সোনা এবং রূপা ক্রয় করে স্থানীয় বাজারে বিক্রি করেন তারা। তার সমিতির সদস্য সংখ্যা ৬৯ জন। যারা সোনা ও রূপা বিকিকিনির সঙ্গে রয়েছেন। এর বাইরেও অনেকে সোনা-রূপার ব্যবসা করছে।
বাজারের বড় ব্যবসায়ীরা বেশি করে সোনা ক্রয় করে মানিকগঞ্জ শহর এবং ঢাকার তাঁতিবাজারসহ দেশের বিভিন্ন বাজারে বিক্রি করেন। সোনা বিকিকিনির ব্যবসায় প্রচুর মূলধন প্রয়োজন। বাজারের অনেক ব্যবসায়ী মাসে ২০ থেকে ৩০ লাখ টাকার সোনা-রূপা বিকিকিনি করেন। তবে অনেকেরই সেই মূলধন নেই।
সোনা-রূপার ব্যবসা নির্ভর করে মূলধনের উপর। তবে করোনাকালীন সময় থেকে ব্যবসায় মুনাফা কম হচ্ছে। চাহিদা অনুযায়ী সোনা-রূপার যোগান দিতে পারছে না ছালি ব্যবসায়ীরা।
চারিগ্রাম ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সাজেদুল আলম স্বাধীন বলেন, তার ইউনিয়নে প্রায় তিন হাজার পরিবার ছালি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত রয়েছে। এছাড়াও গোবিন্দল ইউনিয়নে রয়েছে আরও প্রায় দেড় হাজার ছালি ব্যবসায়ী। ছাই থেকে সোনা সংগ্রহ করে ছালি ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি স্থানীয় জুয়েলারী ব্যবসায়ীরাও বেশ লাভবান। এছাড়া ছাই থেকে সোনা সংগ্রহকারীরা দেশের অর্থনীতিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।