জাল টিআইএন দিয়ে নিবন্ধিত গাড়ি নজরদারির আওতায় আনছে সরকার
গাড়ির মালিকদের কর ফাঁকি রোধ করতে আয়কর রিটার্ন যাচাইয়ের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। জাল টিআইএন (কর শনাক্তকরণ নাম্বার) ব্যবহার করে রেজিস্ট্রেশনের মাধ্যমে কর ফাঁকির মতো অনিয়ম বন্ধ করতে কাজ চলছে বলে জানান জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কর্মকর্তারা।
ইতোমধ্যে, গাড়ি রেজিস্ট্রেশনের সময় প্রদান করা ই-টিআইএন তথ্য যাচাই করতে বিআরটিএ'র সঙ্গে যৌথভাবে কাজ শুরু করেছে এনবিআর।
এছাড়া, আয়কর রিটার্নে মালিকরা গাড়ির রেজিস্ট্রেশনের তথ্য প্রকাশ করেছেন কিনা এবং গাড়ির মূল্যের সাথে প্রদর্শিত আয় সামঞ্জস্যপূর্ণ রয়েছে কিনা সেটিও যাচাই করা হবে।
সরকারের নতুন এই উদ্যোগের ফলে, জাল ই-টিআইএন প্রতিহত করার পাশাপাশি গাড়ির রেজিস্ট্রেশন এবং নবায়ন থেকেও রাজস্ব আয় বৃদ্ধি পাবে বলে আশাবাদী এনবিআর কর্মকর্তারা।
সূত্র জানায়, ব্যক্তিগত গাড়ির রেজিস্ট্রেশনে অনিময়, কর ফাঁকি বন্ধে বিআরটিএ'র সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করতে গত ২৩ জুন দুই সংস্থার সিস্টেম ইন্টিগ্রেশন করা হয়েছে।
প্রাথমিক তথ্যে অনেক গাড়ির মালিককে আয়কর রিটার্নে গাড়ির তথ্য গোপন করতে দেখা গেছে। আবার অনেকে কর বিভাগের চোখ এড়াতে জাল টিআইএন ব্যবহার করে রেজিস্ট্রেশন নিয়েছেন। এসব অনিয়ম বন্ধে একগুচ্ছ পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এসব উদ্যোগ বাস্তবায়িত হলে জালিয়াতির মাধ্যমে রেজিস্ট্রেশন গ্রহণ বন্ধ হওয়ার পাশাপাশি অগ্রিম আয়কর পরিশোধে বাধ্য হবেন গাড়ি মালিকরা।
সূত্র আরও জানায়, বৈধ টিআইএন দিয়ে বিআরটিএ'র যেসব গাড়ির রেজিস্ট্রেশন নেওয়া হয়েছে, সেগুলোর সার্কেল অনুযায়ী তালিকা করা হয়েছে। এসব তালিকা সংশ্লিষ্ট কর অঞ্চলের মাঠ পর্যায়ের সার্কেলগুলোতে গত ১৩ জুলাই পাঠানো হয়।
সার্কেলগুলোকে তালিকা অনুযায়ী গাড়ির মালিকদের রিটার্ন যাচাই করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। একইসঙ্গে, গাড়ির মালিক রিটার্ন জমা দিয়েছেন কিনা অথবা গাড়ির বিনিয়োগ রিটার্নে দেখানো হয়েছে কিনা, তা ছক আকারে এনবিআরে পাঠাতে বলা হয়েছে।
জানা গেছে, গত বছরের শুরুতে কেন্দ্রীয় কর জরিপ অঞ্চল নিয়মিত কার্যক্রমের অংশ হিসাবে বিআরটিএ থেকে এক হাজার ৮২১টি বিলাসবহুল গাড়ির তথ্য সংগ্রহ করে। গাড়িগুলোর মধ্যে রয়েছে- বিএমডব্লিউ, ভলভো, মার্সিডিজ বেঞ্জ, আউডি, লেক্সাস, জাগুয়ার, হ্যামার, প্রাডো ও হ্যারিয়ার। এর মধ্যে ৮৯১টি গাড়ির রেজিস্ট্রেশনে ব্যবহার করা টিআইএন যাচাই করে দেখা যায়, ১২৬টি গাড়ির রেজিস্ট্রেশনে জাল টিআইএন ব্যবহার করা হয়েছে।
সিস্টেম ইন্টিগ্রেশনের পর বিআরটিএ-র সফটওয়্যারে ১২ লাখ ৮৫ হাজার ৫৭২টি গাড়ির রেজিস্ট্রেশনের টিআইএন পাওয়া যায়। এর মধ্যে আট লাখ ৪৩টি গাড়ির টিআইএন সঠিক। বাকি চার লাখ ৮৫ হাজার ৫২৯টি টিআইএন সঠিক নয়। অর্থাৎ, জাল টিআইএন-এর মাধ্যমে এসব গাড়ির নিবন্ধন নেওয়া হয়েছে।
এনবিআর থেকে পাঠানো চিঠিতে বলা হয়েছে, সাম্প্রতিক সময়ে দেশে ব্যক্তিগত ব্যবহারের উদ্দেশ্যে নিবন্ধিত গাড়ির সংখ্যা উল্লেখজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে করদাতাদের মধ্যে সঠিক মূল্য দেখিয়ে গাড়িতে বিনিয়োগের ঘোষণায় অনীহা দেখা যাচ্ছে। এছাড়া, একাধিক গাড়ির মালিকানা থাকলেও তা গোপন করার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। ফলে, রাজস্ব আদায় হ্রাস পাচ্ছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এনবিআরের এক কর্মকর্তা বলেন, "গাড়ির মালিকদের কর ফাঁকি দেওয়ার দিন শেষ। চাইলেও ভবিষ্যতে কেউ আর তথ্য গোপন করতে পারবেন না। যেমন, অনেকে জাল টিআইএন ব্যবহার করে গাড়ির নিবন্ধন নিয়েছেন। ভবিষ্যতে রেজিস্ট্রেশন নবায়ন করতে গেলে বিআরটিএ টিআইএন যাচাই করবে। এ জন্য বিআরটিএকে এনবিআরের সিস্টেমে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। সুতরাং, জাল টিআইএনে গাড়ির নবায়ন সম্ভব নয়।"
"আবার অনেকে বৈধ টিআইএনে গাড়ি কিনলেও তা রিটার্নে দেখাননি। এমন করদাতাদের খুঁজে বের করতে গাড়ির নাম, মডেল নম্বর, মালিকের নাম ও টিআইএনের তালিকা সার্কেল অফিসে পাঠানো হয়েছে। সার্কেল অফিসকে সেগুলোকে যাচাই করতে বলা হয়েছে," বলেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, গাড়ির রেজিস্ট্রেশনে অগ্রিম আয়কর আদায়ে চলতি অর্থবছরের বাজেটে জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। এতে অগ্রিম আয়কর আদায় বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
"প্রাথমিক তথ্যের ভিত্তিতে গাড়ির মালিকদের রিটার্নের তথ্য যাচাইয়ে কর অঞ্চলগুলোতে চিঠি দেওয়া হয়েছে। পরবর্তীতে আরও বড় পরিসরে কার্যক্রম গ্রহণ করা হবে," বলেন তিনি।
উল্লেখ্য, চলতি অর্থবছরের বাজেটে গাড়ি রেজিস্ট্রেশনে অগ্রিম আয়কর ৩০ জুনের মধ্যে পরিশোধের নিয়ম করা হয়েছে। নিয়মের বাত্যয় ঘটলে জরিমানা দিতে হবে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, বিআরটিএ দুই বছরের জন্য গাড়ির ফিটনেস সনদ দিয়ে থাকে।
কোনও ব্যক্তি ২০২১-২২ অর্থবছরে ১৫শ সিসির কম গাড়ির ফিটনেস সনদ নিলে প্রথম বছরের জন্য ২৫ হাজার টাকা অগ্রিম আয়কর দিতে হবে। পরের বছরের অগ্রিম আয়করের টাকা ২০২৩ সালের ৩০ জুনের আগে পরিশোধ করতে হবে। গাড়ির মালিক ৩০ জুনের পরে অগ্রিম আয়কর পরিশোধ করলে পরবর্তী নবায়নের সময় ২৫ হাজার টাকার পাশাপাশি ২৫ হাজার টাকা জরিমানা দিতে হবে। অর্থাৎ, পরবর্তী নবায়নে ৫০ হাজার টাকা অগ্রিম আয়কর হিসেবে দিতে হবে।
বিআরটিএ'র ওয়েবসাইটের তথ্য মতে, সারাদেশে মোট নিবন্ধিত ব্যক্তিগত গাড়ি রয়েছে ৩ লাখ ৭২ হাজার ১৩৭টি। প্রতিবছরই ব্যক্তিগত গাড়ির নিবন্ধন সংখ্যা বাড়ছে। ২০২০ সালে ১২ হাজার ৪০৩টি গাড়ি নিবন্ধন নিয়েছে। আর চলতি বছরের মে পর্যন্ত নিবন্ধন নিয়েছে ৬ হাজার ১৯৬টি গাড়ি। এছাড়া বাস, ট্রাক, পিক আপ, সিএনজি, মোটরসাইকেল- সব মিলিয়ে বিআরটিএতে নিবন্ধিত যানবাহন রয়েছে ৪৭ লাখ ২৯ হাজারটি।
রিটার্ন জমা না দিলে মিলবে না ফিটনেস সনদ
এখন টিআইএন নম্বর থাকলেই গাড়ির রেজিস্ট্রেশন ও ফিটনেস সনদ নেওয়া যায়। আগামীতে রিটার্ন জমার স্লিপ ছাড়া ফিটনেস সনদ পাওয়া যাবে না। এজন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে ২৫ মার্চ এনবিআর সড়ক পরিবহন বিভাগের সচিবকে চিঠি দিয়েছে।
জানা গেছে, গত ১৫ মার্চ অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের সম্মেলন কক্ষে আয়কর রিটার্ন জমা ও উৎসে কর কর্তন কার্যক্রম বেগবান করতে আন্তঃমন্ত্রণালয়ের সভা হয়। সেখানে ১০ মন্ত্রণালয় ও এনবিআরের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।
মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিরা সবাই সরকারি সেবা পেতে টিআইএনের বদলে রিটার্ন জমার স্লিপ বাধ্যতামূলক করার বিষয়ে একমত পোষণ করেন। এরপরই ওইসব মন্ত্রণালয় ও বিভাগে চিঠি পাঠানো হয়েছে।
চিঠিতে বলা হয়েছে, ট্রেড লাইসেন্স নবায়ন, গাড়ি রেজিস্ট্রেশন-নবায়ন, নৌযান রেজিস্ট্রেশন-নবায়ন, আমদানি-রফতানি সনদ, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের তালিকাভুক্তি ও নবায়নে ই-টিআইএন সনদ গ্রহণের বাধ্যবাধকতা আছে।
দেখা যাচ্ছে, টিআইএনধারী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে অনলাইন থেকে এই সনদ নিয়ে সব সুবিধা ভোগ করলেও আয়কর রিটার্ন জমা দিচ্ছেন না। ফলে রিটার্ন জমার হার বাড়ছে না। বড় একটি অংশ কর আওতার বাইরে থাকছে।
চিঠিতে আরও বলা হয়েছে, বর্তমানে একজন গাড়ির মালিক রিটার্ন জমা না দিয়ে শুধু ই-টিআইএনের মাধ্যমে গাড়ির রেজিস্ট্রেশন করতে পারছেন। আয়কর আইনে রিটার্ন জমা না দেওয়ার কারণে টিআইএন প্রত্যাহার বা বাতিলের সুযোগ নেই। তাই, টিআইএনধারীদের রিটার্ন জমা না দিয়ে আয় গোপন ও কর ফাঁকির সুযোগ থেকে যাচ্ছে।
এছাড়া, দরপত্রে অংশগ্রহণ, ঠিকাদারি তালিকাভুক্তিসহ সব ক্ষেত্রে রিটার্নের প্রাপ্তিস্বীকারপত্র জমার বাধ্যবাধকতা মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও অধিদপ্তরের নীতিমালায় অন্তর্ভুক্ত করলে কর জাল ও কর কমপ্লায়েন্স বৃদ্ধি পাবে।