ডলারের দাম বাড়ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হস্তক্ষেপ সত্ত্বেও
বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় বাজারকে স্থিতিশীল রাখতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পদক্ষেপ সত্ত্বেও টাকার বিপরীতে মার্কিন ডলারের বিনিময় দর বেড়েই চলেছে। অথচ চলতি মাসের ১৯ তারিখ পর্যন্ত পুরো আগস্ট মাসের দ্বিগুণ বা ৭৪ কোটি ডলার বাণিজ্যিক ব্যাংকের কাছে বিক্রি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
তবুও জুলাই থেকে অক্টোবরের আলোচিত সময়ে ডলারের বিপরীতে ৮৫ পয়সা মূল্য হারিয়েছে টাকা।
সোমবার (২৫ অক্টোবর) খোলাবাজারেও ডলারের দাম উঠেছে ইতিহাসের সর্বোচ্চ- ৯০ টাকা ১০ পয়সা দরে বিকিকিনি হয়েছে। ক্রমবর্ধমান চাহিদার ফলে আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারেও ডলারের বিনিময় হারে ঊর্ধ্বগতি অব্যাহত রয়েছে।
বৈশ্বিক পণ্যবাজারের অস্থিতিশীল পরিবেশে টাকা দ্রুত মূল্যমান হারানোয়, মূল্যস্ফীতির আশঙ্কাও দেখা দিয়েছে।
এই পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক লেনদেনের অত্যাবশ্যকীয় মুদ্রাটির দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতি আরও দ্রুতগতিতে বাজারে ডলার সরবরাহের পরামর্শ দিচ্ছেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী নেতারা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুসারে, সোমবার আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে প্রতি ডলারের সর্বোচ্চ বিনিময় মূল্য ছিল ৮৫ টাকা ৬৫ পয়সা। তবে সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, এদিন মানি এক্সচেঞ্জ হাউজগুলোয় নগদ মূল্যে ডলার ৮৯ টাকা ৯০ পয়সা থেকে ৯০ টাকা ১০ পয়সায় কেনাবেচা হয়েছে।
জুলাই থেকে দেশে ডলারের দাম বাড়তে শুরু করে, তখন আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে প্রতি ডলারের বিনিময় মূল্য ছিল ৮৪ টাকা ৮০ পয়সা। এসময় খোলাবাজারে কেনাবেচা হয়েছে ৮৭-৮৮ টাকায়।
এদিকে ডলারের অব্যাহত দরবৃদ্ধিতে আগের ক্রয়নীতি থেকে সরে আসতে বাধ্য হয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আমদানিকারক ও ভ্রমণকারীদের আকস্মিক ডলার ক্রয় চাহিদা বাড়ায় এখন বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় বাজারকে সমর্থন দিতে, ডলার বিক্রিরই পদক্ষেপ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
২০২০-২১ অর্থবছরে প্রবাসী আয়ের উচ্চ প্রবাহ এবং কম আমদানির কারণে বাজার থেকে রেকর্ড পরিমাণ বা ৮০০ কোটি ডলার কিনে নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে এরপর চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের ১৯ অক্টোবর পর্যন্ত ১৬৮ কোটি ডলার বিক্রি করেছে বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রদত্ত তথ্যে জানা যায়।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দৃঢ় হস্তক্ষেপ সত্ত্বেও স্থানীয় মুদ্রার বিপরীতে ডলার দিন দিন আরও মূল্য অর্জন করছে। গত আগস্টে কেন্দ্রীয় ব্যাংক দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছে ৩০ কোটি ডলারের বেশি বিক্রি করেছিল। পরের মাসে এই অঙ্ক দ্বিগুণ হয়ে ৬৪ কোটি ১০ লাখ ডলারে পৌঁছায়। আর চলতি অক্টোবরের ১৯ তারিখ পর্যন্ত মাত্র ১৯ দিনেই বিক্রি করেছে ৭৪ কোটি ডলার।
তারপরও, আন্তঃব্যাংক হোক বা খোলাবাজার, সবুজরঙা মুদ্রাটির দাম চড়া সবখানেই।
এনিয়ে আমান মানি চেঞ্জারের পরিচালক আমানুর রহমান বলেন, 'আশির দশক থেকে এই ব্যবসার সাথে জড়িত, কিন্তু এর আগে ডলারের দাম কখনো এতোটা উঠতে দেখিনি।'
এখন দেশের মানুষ পেশাগত কাজ, শিক্ষা, চিকিৎসা ও কেনাকাটার জন্য বিভিন্ন দেশে যাতায়াত শুরু করেছে। এর প্রভাব খোলা বাজারে ডলারের দামে পড়েছে বলে মনে করেন তিনি।
নিট পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএ- এর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, 'ডলারের দাম বাড়লে আমদানিকারকরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এজন্য আমরা সরকারকে বলেছিলাম রপ্তানি ও আমদানির ক্ষেত্রে ভিন্ন একটা ডলারের রেট নির্ধারণ করতে। সেটা এখনো বাস্তবায়ন হয়নি।'
বস্তুত ডলারের দাম বাড়লে সাধারণ মানুষের ওপরই এর বিরূপ প্রভাব পড়ে, বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
এদিকে নাম না প্রকাশের শর্তে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন সাবেক গভর্নর বার্তা সংস্থা ইউএনবি'কে বলেছেন, সাম্প্রতিক সময়ে ডলারের বিনিময় মূল্য বাড়ার কারণ দুটি: প্রথমত, বিশ্বজুড়ে কোভিড-১৯ জনিত বিধিনিষেধ উঠে যেতে থাকায় শিক্ষা, চিকিৎসা ও বিনোদনের জন্য মানুষের বিদেশ ভ্রমণ বেড়েছে এবং দ্বিতীয় কারণ, বাংলাদেশ থেকে বিদেশে অর্থ পাচার বৃদ্ধি।
উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, সম্প্রতি ব্যাংকিং ও ই-কমার্স খাতের কিছু জালিয়াতি দেশ থেকে ক্রমবর্ধমান হারে অর্থ পাচারেরই ইঙ্গিত দিচ্ছে।
এব্যাপারে অর্থনীতিবিদ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. মির্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, মুদ্রাস্ফীতি যাতে কোনভাবে লাগামহীন না হয়, সেজন্য বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের বিক্রি বাড়াতে পারে।
'মুদ্রাস্ফীতি এখনো সহনীয় থাকলেও, যেহেতু আমরা কোভিড পরবর্তী অর্থনীতি উদ্ধারের জন্য কাজ করছি; সুতরাং এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংককে আরো দূরদর্শী হতে হবে। একইসঙ্গে, এখন আমাদের বিদেশি সাহায্য যেগুলো আসছে, এগুলো যেহেতু ফরেন এক্সচেন্জ বিভাগ হয়ে আসে, সুতরাং এগুলোও দ্রুত বন্টনের ব্যবস্থা করতে হবে।'
তাতে ডলারের দাম স্থিতিশীল রেখে অর্থনীতিতে ভারসাম্য রক্ষা করা সহজ হবে, বলে মন্তব্য করেন এই বিশেষজ্ঞ।
গত অর্থবছরে (২০২০-২১) কোভিড-১৯ মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক সহায়তা বৃদ্ধি পায়। এসময় মোট ৯৩৫ কোটি ডলার বৈদেশিক সহায়তার প্রতিশ্রুতি মিললেও, পাওয়া গেছে ৭২১ কোটি ডলার।
এব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, 'এলসি সেটেলমেন্ট বাড়ার ফলে ডলারের দাম বেড়েছে। এজন্য আমরা ডলার বিক্রি করছি। পর্যাপ্ত ডলারের মজুদও আছে। ব্যাংকগুলো চাহিদা দিলে আমরা সেভাবে ডলার দিতে পারব।'
'এখন আর্ন্তজাতিক বাজারেও বিভিন্ন পণ্য-কাঁচামালের দাম বাড়ার ফলে এই অবস্থা। তবে যে চাপ আছে, সেটা বেশিদিন থাকবে না। আমাদের রপ্তানি আয়ও বাড়তে শুরু করেছে, রেমিটেন্সও গতি পাবে। তখন পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করবে, ডলারের দাম স্থিতিশীল হবে'- বলে মনে করেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই কর্মকর্তা।
মুদ্রাস্ফীতি অস্বাভাবিক বাড়তে পারে কী না- এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, 'মুদ্রাস্ফীতি কোন মাসে বাড়ছে, আবার পরের মাসে কমছে এমন অবস্থায় আছে। এই বিষয়টি বেশ কয়েকটি অনুষঙ্গের উপর নির্ভর করে। সুতরাং ডলারের দাম সাময়িক বাড়ার ফলে মুদ্রস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার মতো অবস্থা দেখছি না।'
মুদ্রা বিনিময় খাত সংশ্লিষ্টরাও বলছেন, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড গতি ফিরে পাওয়ার কারণেই ডলারের দাম ঊর্ধ্বমুখী। নানান কারণে বাংলাদেশিদের বিদেশ ভ্রমণ বাড়ায় নগদ ডলারের ক্রয় চাহিদা বেড়েছে বলে জানান তারা।
তাছাড়া, মহামারিকালে বাংলাদেশমুখী যে উচ্চ রেমিট্যান্স প্রবাহ দেশের মুদ্রাবাজারকে প্রাণবন্ত রেখেছিল, তা চলতি অর্থবছরের শুরুতেই গতি হারায়। এই ঘটনাও ডলারের বাজারে বাড়তি চাপ সৃষ্টি করে।
ব্যবসায়ী নেতারা বলছেন, আমদানি বাড়ার কারণে ডলারের দাম বাড়তে শুরু করলেও, রপ্তানি আয় এখনো আগের অবস্থায় আসেনি।
এতে করে ডলারের দাম বৃদ্ধিতে রপ্তানিকারকদের যে সুবিধা পাওয়ার কথা ছিল, সেটা তারা পাচ্ছেন না। আবার আমদানি ব্যয় বাড়ায় তা আমাদের স্থানীয় বাজারের ওপরেও প্রভাব ফেলছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যানুসারে, চলতি বছরের জুলাই-আগস্ট মেয়াদে বাংলাদেশ ১০ দশমিক ৮৪ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করেছে। যার বিপরীতে মাত্র ৬৭৩ কোটি ডলার রপ্তানি হওয়ায় ডলার সংকট দেখা দেয়।
এব্যাপারে পেঁয়াজ আমদানিকারক মো. মাজেদ টিবিএস'কে বলেন, 'আমরা পেঁয়াজ আমদানি করতে গিয়ে যে দামে এলসি খুলেছি, গত কয়েক মাস ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় আমাদের আমদানি মূল্যও বেড়ে যাচ্ছে। এর ফলে দেশের বাজারে পণ্যের দামও বেড়ে যাচ্ছে।'
ডলারের দাম বাড়ায় রেমিট্যান্স প্রেরণকারীরা উপকৃত হবেন কিনা বা এটা দেশের অর্থনীতির জন্য উপযোগী কি না- এ বিষয়ে জানতে চাইলে সিপিডি'র সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান বিজনেস স্টান্ডার্ডকে বলেন, 'রেমিট্যান্স বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ, তবে এক্ষেত্রে সেটা খুব বেশি কার্যকর হবে না। উল্টো ডলারের দাম বাড়লে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাবে।'