তৃতীয় লিঙ্গের জন্য করছাড়: কাগজে-কলমে সম্ভব, বাস্তবে নয়
বর্তমান প্রসঙ্গ ও বিদ্যমান তথ্য অনুযায়ী, ১০ শতাংশ কর ছাড়ের বিষয়টি অবাস্তব স্বপ্ন বলেই মনে হয়।
সরকারি সংজ্ঞা অনুযায়ী তৃতীয় লিঙ্গ বলতে তাদেরকে বোঝায়, যারা সামাজিকভাবে 'হিজড়া' নামে পরিচিত, প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে জীবিকা নির্বাহের তাগিদে ভিক্ষাবৃত্তি ও গণিকাবৃত্তির সঙ্গে জড়িত।
আধুনিক বিশ্বে কোনও মানুষের আইনি পরিচয় তার জাতি পরিচয়, বর্ণ পরিচয় বা লিঙ্গ পরিচয়ের ওপর ভিত্তি করে হওয়া উচিত নয়। হিজড়াদেরও চাকরির বাজারে প্রবেশাধিকার থাকা উচিত। এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার জন্য রাখা এই প্রস্তাবনা সামনে এগিয়ে যাওয়ার পাথেয় হবে।
সমাজসেবা অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে বাংলাদেশে হিজড়ার সংখ্যা প্রায় ১১ হাজার।
তবে, লিঙ্গ বৈচিত্র্য নিয়ে কাজ করা অ্যাক্টিভিস্ট ও বিশেষজ্ঞরা হিজড়া ও পাশাপাশি ট্রান্সজেন্ডার জনগোষ্ঠীর কতোজন সদস্য আছেন দেশে তার আনুমানিক ধারণা পেতে আদমশুমারি চালানোর ওপর জোর দিচ্ছেন।
হিজড়াদের প্রায় সকলেই জন্মগতভাবে পুরুষ থাকলেও পরে নারী বলে চিহ্নিত হন।
দেশে হিজড়া বা ট্রান্সজেন্ডার জনগোষ্ঠীর প্রকৃত সদস্য সংখ্যা সরকারি হিসাবের চেয়ে অনেক বেশি, তবে শতকরা হিসেবে মোট জনগোষ্ঠীর বিপরীতে তা নগণ্য।
এছাড়াও, সরকারি হিসাবের বিষয়টি ছাড়াও হিজড়াদের নিয়োগের ক্ষেত্রে আরও বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। কয়েক দশকের চলমান বৈষম্য ও তাদের খারিজ করার এই সংস্কৃতির ফলস্বরূপ তাদের মধ্যে শিক্ষার হারও তলানিতে।
এই প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে কর ছাড়ের সুবিধা পাওয়ার জন্য ১০ শতাংশ নিয়োগের লক্ষ্য অনেকটা এক বালতি পানি হাতে মরুভূমি পাড়ি দিতে বলার মতো। পরিবর্তনের লক্ষ্যে নেওয়া উদ্যোগ বাস্তবসম্মত হতে হয়, তবেই পরিবর্তন আলোর মুখ দেখতে পারে।
বাজেটের এই প্রস্তাবনা যদি অনুমোদন পায়, তবে ট্রান্সজেন্ডার জনগোষ্ঠী থেকে ১০ শতাংশ কিংবা মোট লোকবলের ১০০ জনের বেশি নিয়োগ দেওয়ার সাপেক্ষে কোম্পানিগুলো তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীকে দেওয়া বেতনের ৭৫ শতাংশ বা মোট পরিশোধযোগ্য করের ৫ শতাংশ করছাড়ের সুবিধা পেতে পারে।
তবে একটি গ্রহণযোগ্য আদমশুমারি চালানোসহ বাদবাকি সব চ্যালেঞ্জ চিহ্নিত না করে এ কাজ করা সহজ হবে না।
তৃতীয় লিঙ্গের সংজ্ঞা
সমাজসেবা অধিদপ্তরের প্রচারিত লিফলেটে হিজড়াদের 'যৌন প্রতিবন্ধী' মানুষ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে; যাদের শারীরিক ও জেনেটিক কারণে নারী বা পুরুষ কোনো শ্রেণীতে অন্তর্ভূক্ত করা যায় না। এই সংজ্ঞায়নে বিজ্ঞান এবং এই সম্প্রদায়ের মানুষ- উভয়ই উপেক্ষিত।
হিজড়ারা এমন এক জনগোষ্ঠী, শুধু দক্ষিণ এশিয়াতেই যাদের অস্তিত্ব রয়েছে। তারা সংস্কৃতির অংশ হিসেবেই আমাদের অন্তর্ভুক্ত, তারা গান গান, নাচেন, নবজাতক শিশুকে আশীর্বাদ করেন।
লিফলেটে তাদের যে সংজ্ঞায়ন রয়েছে তা গ্রহণযোগ্যও নয়, সঠিকও নয়।
যেহেতু হিজড়া কারা তা নির্ধারণ না করেই সরকার হিজড়া সম্প্রদায়কে স্বীকৃতি দিয়েছে; হিজড়া, উভলিঙ্গ এবং ট্রান্সজেন্ডার ব্যক্তিদের জন্য সরকারি স্বীকৃতির মাধ্যমে আসা আইনী সুরক্ষা পাওয়া না পাওয়ার ঝুঁকিও তৈরি হয়।
নিজেকে হিজড়া নয়, ট্রান্সজেন্ডার নারী হিসেবে পরিচয় দিতেই স্বাছন্দ্যবোধ করেন জয়া শিকদার। তার মতে, সরকারের প্রয়োজন তৃতীয় লিঙ্গের প্রকৃত সংজ্ঞায়ন নির্ধারণ করা। কারা এর মধ্যে পড়বে এবং কীভাবে তাদের শ্রমবাজারে অন্তর্ভুক্ত করা যাবে তা নির্ধারণ করা প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেন তিনি।
২০১৪ সালে অপ্রত্যাশিতভাবেই হিজড়াদের জন্য সরকারি চাকুরিতে যোগদানের সুযোগ আসে। তাদের তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার কয়েক মাস পরই আসে এই ঘোষণা। তবে সেইসঙ্গে 'প্রকৃত হিজড়া' নির্ধারণে মানহানিকর মেডিক্যাল চেক-আপের সিদ্ধান্ত আসে। ফলে যা হতে পারতো এই জনগোষ্ঠীর জন্য এক নতুন এক সুযোগ, তা-ই তাদেরকে আরও প্রান্তিককরণেই ভূমিকা রাখে।
যখন হাসপাতালের নন-মেডিক্যাল স্টাফরা এক ডজন চাকরি সন্ধানী ও রোগীদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছিলেন, আশেপাশের মানুষজন তাদের বিদ্রুপ করছিল। এখানেই শেষ নয় তাদের দুর্দশা। প্রার্থীদের ছবি সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়, প্রচলিত ট্যাবুর সুযোগ নিতে চাইছেন কিছু পুরুষ- এভাবেই তাদের উপস্থাপন করা হয়।
সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ওই উদ্যোগ ব্যর্থ হয়, পরে হিউম্যান রাইটস ওয়াচে এ ঘটনা নথিভুক্ত হয়। এখন পর্যন্ত তাদের প্রচলিত ধারায় অন্তর্ভুক্ত করার উদ্যোগ কতোটুকু কার্যকর হয়েছে তা নিয়ে বর্তমানে সন্দিহান বিশেষজ্ঞ ও অ্যাক্টিভিস্টরা।
ট্রান্সজেন্ডার নারী অ্যাক্টিভিস্ট জয়া শিকদারের মতে, লিঙ্গ পরিচয়ের জন্য সমাজে প্রান্তিককরণের শিকার হওয়া সব গ্রুপকেই একটি একক আমব্রেলা ট্রার্ম 'ট্রান্সজেন্ডারের' আওতায় নিয়ে আসা উচিত। ট্রান্সজেন্ডার শব্দটি আন্তর্জাতিকভাবেও স্বীকৃত।
জনসাধারণের মধ্যে প্রচলিত ভুল ধারণার কারণেই যাদের লিঙ্গ পরিচয় প্রথাগত নারী পুরুষের বাইনারি ধারণার মধ্যে পড়ে না, তারা আরও বেশি হেনস্তার শিকার হন।
সাজিদা ফাউন্ডেশনের মানসিক স্বাস্থ্য প্রোগ্রামে কর্মরত ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট রুবিনা জাহিন বলেন, "কথার চেয়ে কাজের শক্তি বেশি। সম্মিলিত এই প্রচেষ্টাকে বাস্তবে রূপ দিতে, সামাজিকভাবে অন্তর্ভুক্ত নয় এমন মানুষদের প্রতি জনসাধারণের সংবেদনশীলতা বাড়াতে জনসচেতনতা সৃষ্টির কাজও চালিয়ে যেতে হবে,"
হিজড়া, তৃতীয় লিঙ্গ বা ট্রান্সজেন্ডার সম্প্রদায়ের সদস্যরা কর্মক্ষেত্রে যে সব বাধার সম্মুখীন হন এব্যাপারে ট্রান্সএডের প্রতিষ্ঠাতা ও ট্রান্সজেন্ডার জনগোষ্ঠীর ক্ষমতায়নে কাজ করা লামিয়া তানজিন তানহা বলেন, অনেকেই তাদের সহকর্মীদের আচরণে চাকরি ছেড়ে দেন। এর মধ্যে অন্যতম বৈষম্য হলো অফিস প্রাঙ্গনের টয়লেট ব্যবহার করতে না পারা।
ক্ষমতায়নই সামনে এগোনোর পাথেয়
ট্রান্সজেন্ডার জনগোষ্ঠীর পক্ষ থেকেও পরিবর্তনের দিকে এগিয়ে আসা প্রয়োজন। চাকরির বাজারে প্রবেশের জন্য তাদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার দরকার, প্রয়োজন প্রশিক্ষণের ও দক্ষ হয়ে হয়ে ওঠার।
সরকার বিভিন্ন সময় নানা প্রশিক্ষণের আয়োজন করেছে, তবে এসব প্রশিক্ষণ কর্মশালা কতোটুকু ভূমিকা রাখতে পেরেছে তাও স্পষ্ট নয়।
২০১৯ সালে সমাজসেবা অধিদপ্তরের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন কর্মসূচির আওতায় আয়োজিত ৫০ দিনব্যাপী ব্লক/বাটিক প্রিন্ট প্রশিক্ষণে অংশ নেন শাহাদাত।
প্রশিক্ষণ শেষে পাওয়া ১০ হাজার টাকা ও বাড়তি কিছু বিনিয়োগ নিয়ে শাহাদাত ও আরও দু'জন ট্রান্সজেন্ডার নারী মিরপুরে একটি দোকান দেন।
পরিবারে নিজেকে ট্রান্সজেন্ডার নারী হিসবে পরিচয় করিয়ে দিতে এখনো ভয় পান শাহাদাত, পরিবারের সঙ্গেই থাকেন তিনি। শাহাদাত জানালেন, খুব স্বল্প সংখ্যক মানুষ তাদের থেকে কেনাকাটায় আগ্রহী হওয়ায় এবং কোনো আর্থিক সহায়তা না থাকায় তাদের ব্যবসার উদ্যোগ টিকতে পারেনি। দোকান খোলার মাত্র সাত মাস পরই তা বন্ধ হয়ে যায়।
মনোবিজ্ঞানী রুবিনা এব্যাপারে বলেন, "তাদেরকে শুধু কর্মক্ষেত্রে নিয়ে আসার মাধ্যমেই আমরা তাদের অধিকার নিশ্চিত করতে পারবো না। ট্রান্সজেন্ডার ব্যক্তিদের প্রয়োজন সহায়তা ও সমর্থন, অনুপ্রেরণা। সেইসঙ্গে, কীভাবে তারা নিজেদের কণ্ঠস্বরও সবার কাছে পৌঁছে দিতে পারেন এবং সমানাধিকারের দাবি তোলার জন্য উপযুক্ত স্থান পাবেন তার নিশ্চিত করতে তারা কীভাবে নেতৃত্ব দানের মতো পদে যেতে পারে তারজন্য প্রয়োজন সঠিক দিক-নির্দেশনার।
ট্রান্সজেন্ডারদের মূলধারায় সম্পৃক্ত করার মতো বৈশ্বিকভাবে গ্রহণযোগ্য প্রক্রিয়া গ্রহণের ওপর জোর দেন রুবিনা।
গত ১৫ দিন ধরে মিরপুরের এক চাইনিজ রেস্টুরেন্টে ওয়েটার হিসেবে কাজ করছেন শাহাদাত।
"আমার পরিচিত এক ধনী ব্যক্তির সুপারিশে এই চাকরি পেয়েছি আমি (ওই ব্যক্তির লিঙ্গ পরিচয়ও তার জন্মের সময় পাওয়া লিঙ্গ পরিচয়ের চেয়ে ভিন্ন)। এটিই একমাত্র জায়গা যেখানে আমি নিজের মতো করে থাকতে পারি," বলেন শাহাদাত।
- প্রতিবেদনটি ইংরেজিতে পড়ুন: Tax rebate for 3rd gender: Possible on paper, not in practice