আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় ৮ বছরেও শেষ হয়নি সাবরাং ট্যুরিজম পার্কের কাজ
কক্সবাজারের টেকনাফে সাবরাং ট্যুরিজম পার্কের উন্নয়ন কাজের উদ্বোধন হয়েছিল ২০১৬ সালে। এরপর ৮ বছর পেরিয়ে গেলেও এখন শেষ হয়নি পার্কটির কাজ।
সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ও অংশীজনরা বলছেন, জমি কেনায় আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, করোনা মহামারি, পর্যাপ্ত উন্নয়ন তহবিলের অভাব এবং সর্বোপরি ঢিলেঢালা পদ্ধতিতে কাজের কারণে প্রকল্পের অগ্রগতি স্থবির হয়ে পড়েছে।
তবে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেজা) সাম্প্রতিক পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা অনুযায়ী, বিনিয়োগকারীদের জন্য পার্কের সমস্ত সার্ভিস সংযোগ ২০২৯ সালের মধ্যে সম্পন্ন হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
পর্যটন বিশেষজ্ঞ ও শিল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রকল্পটি দ্রুত শেষ করা উচিত। কারণ, বিশ্বের বৃহত্তম প্রাকৃতিক সমুদ্রসৈকতের পাশাপাশি এর পাহাড়, মেরিন ড্রাইভ ও প্রবাল দ্বীপ সেন্ট মার্টিনের কারণে আন্তর্জাতিক পর্যটকদের অন্যতম প্রধান গন্তব্য কক্সবাজার।
টেকনাফের যেখানে গিয়ে মেরিন ড্রাইভ সড়কটি শেষ হয়েছে, তার পাশেই ৯৬৭ একর জমিতে সাবরাং ট্যুরিজম পার্ক গড়ে তুলছে বেজা।
বিদেশি পর্যটক আকর্ষণে বেজা টেকনাফ ও মহেশখালী উপজেলায় মোট ১১ হাজার একর জমি নিয়ে তিনটি পর্যটন পার্কের উন্নয়ন কাজ শুরু করে ২০১৬ সালে। এর মধ্যে ৯৬৭ একর জমিতে সাবরাং ট্যুরিজম পার্ক, ২৭১ একর জমিতে নাফ ট্যুরিজম পার্ক ও ৯ হাজার ৪৬৭ একর জমিতে সোনাদিয়া ইকো ট্যুরিজম পার্ক তৈরির পরিকল্পনা নেওয়া হয়।
তবে এসব প্রকল্পের সামগ্রিক অগ্রগতি হচ্ছে খুব ধীরগতিতে। এখন পর্যন্ত শুধু সাবরাং ও সোনাদিয়ায় কিছু উন্নয়ন দৃশ্যমান হয়েছে, যা প্রকল্পগুলোর কাজের গতি নিয়ে উদ্বেগ সৃষ্টি করছে।
বেজার সাবেক নির্বাহী চেয়ারম্যান পবন চৌধুরী দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, '২০১৬ সালের দিকে এ টুরিজম পার্ক তিনটি করার অনুষ্ঠানিক কাজ শুরু হয়। তখন জমি অধিগ্রহণ শুরু হয়। কিন্তু সরকারি কাজ ধীর গতিতে চলে।'
পবন চৌধুরী আরও বলেন, 'আমি ২০২১ সালে বেজা থেকে অবসরে যাই। তখন যে অবস্থায় ছিল, সেই অবস্থাই এখন আছে। তখন প্রশাসনিক ভবন, গেস্টহাউস করেছিলাম, ফটো কর্নার ও সুরক্ষা বাঁধ নির্মাণ করেছিলাম। কাজ সেই পর্যন্তই আটকে আছে।'
বেজা সূত্রে জানা গেছে, সাবরাং ট্যুরিজম পার্কে ২৬ জন বিনিয়োগকারীকে ১১৯.৭৯ একর জমি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। আর বিনিয়োগ প্রস্তাব এসেছে প্রায় ৪২১ মিলিয়ন ডলার।
আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে অবকাঠামো উন্নয়নের কাজ শেষ করার পরিকল্পনা করেছে বেজা। এর জন্য নেওয়া হয়েছে প্রায় ২ হাজার কোটি টাকার চার বছর মেয়াদি একটি প্রকল্প। প্রকল্প প্রস্তাবটি সরকারের কাছে জমা দেওয়া হয়েছে। সূত্র জানায়, এ প্রকল্পের বাজেট ধরা হয়েছে প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা।
এ বাজেটের একটি বড় অংশ—প্রায় ৫০০ কোটি টাকা—ব্যয় হবে ট্যুরিজম পার্ককে সাগরের উচ্চ জোয়ারের প্রভাবমুক্ত রাখতে 'সুপার ডাইক' বা শক্তিশালী বেড়িবাঁধ নির্মাণে।
তবে এখনও এ প্রকল্প অনুমোদন দেয়নি সরকার।
স্থানীয় কিছু কোম্পানি, যেমন ইফাদ গ্রুপ, ডিআইআরডি কম্পোজিট টেক্সটাইলস লিমিটেড, পাটোয়ারী এন্টারপ্রাইজ, ইস্ট ওয়েস্ট ট্রাভেলস অ্যান্ড ট্যুরস ও ডিআইপিটিএ গার্মেন্টস লিমিটেড এ পার্কে হোটেল করার জন্য জমি নিয়েছে।
তবে সাবরাং ট্যুরিজম পার্কে জমি পেয়েছে, এমন চারটি প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সেখানে তাদের হোটেল করার মতো অবকাঠামো এখনও তৈরি হয়নি; তাই তারা কাজ শুরু করছে না।
সাবরাং ট্যুরিজম পার্কে দুটি বিদেশি কোম্পানিও হোটেল নির্মাণের পরিকল্পনা করেছে। সিঙ্গাপুরভিত্তিক ইন্টার-এশিয়া গ্রুপ ইতিমধ্যে ৪০ একর জমি নিয়েছে। নেদারল্যান্ডসভিত্তিক কোম্পানি লিজার্ড স্পোর্টসও বিনিয়োগের পরিকল্পনা করছে।
ট্যুর অপারেটর অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-এর সভাপতি মোহাম্মদ রফিউজ্জামান সাবরাং ট্যুরিজম পার্কের কাজ দ্রুত শেষ করার প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করে বলেন, পার্কটি হলে বিদেশি পর্যটকরা রাতেও নিরাপদে সৈকতে চলাচল করতে পারবেন, যা দেশের পর্যটন খাতকে দ্রুত এগিয়ে নিয়ে যাবে।
সাতটি প্রধান পর্যটন আকর্ষণ—নদী, সমুদ্র, পাহাড়, বন, ইতিহাস, সংস্কৃতি, ঋতুবৈচিত্র্য ও আতিথেয়তা—থাকার পরও বিদেশি পর্যটক আকর্ষণে প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় পিছিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ। ২০২৩ সালে বাংলাদেশে সাড়ে ৬ লাখ বিদেশি পর্যটক এসেছে, যার বেশিরভাগই এসেছে ভারত থেকে। এছাড়া যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও ইতালি থেকেও পর্যটক এসেছেন।
অন্যদিকে একই বছরে মালদ্বীপ ১.৮ মিলিয়ন ও শ্রীলঙ্কা ১.৫ মিলিয়ন আন্তর্জাতিক পর্যটক আকর্ষণ করেছে।
বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের গভর্নিং বডির সদস্য শিবলুল আজম কোরেশি টিবিএসকে বলেন, 'প্রতি বছর বাংলাদেশ থেকে প্রায় ৩০ লাখ পর্যটক বিদেশে ঘুরতে যাচ্ছে। এতে অনেক ডলার বিদেশে চলে যাচ্ছে।
'এ ট্যুরিজম পার্কগুলো হলে দেশের মধ্যেই এই পর্যটকরা ঘুরবেন। সেইসঙ্গে বিদেশি পর্যটকও বেশি বেশি আসবেন বাংলাদেশে।'
দুটি পার্ককে যুক্ত করবে ক্যাবল কার
বেজার পঞ্চবার্ষিক কর্মপরিকল্পনায় বলা হয়েছে, সাবরাং ট্যুরিজম পার্কসংলগ্ন মেরিন ড্রাইভ থেকে নেতাং হিল হয়ে নাফ ট্যুরিজম পার্ক পর্যন্ত প্রায় ৮.৫ কিলোমিটারের একটি ক্যাবল কার স্থাপনের জন্য জরিপ করা হচ্ছে। জরিপের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে রয়েছে। ২০২৬ সালের মধ্যে ক্যাবল কারের কাজ সম্পন্ন হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
সাবরাং ট্যুরিজম পার্কে বিদেশি পর্যটকদের জন্য একটি এক্সক্লুসিভ জোন তৈরির উদ্যোগও নিয়েছে বেজা। এই ১০০ একরের এক্সক্লুসিভ জোনটি হবে বাংলাদেশে প্রথম, যা বিদেশি পর্যটকদের জন্য নির্ধারিত থাকবে।
বেজার সদ্যবিদায়ী নির্বাহী চেয়ারম্যান মো. সারওয়ার বারী টিবিএসকে বলেন, সাবরাং ট্যুরিজম পার্কে ভূমি উন্নয়ন কাজ শেষে হয়েছে। অন্যান্য সব ইউটিলিটি সুবিধা নিশ্চিত করতে একটি উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) প্রস্তুত করা হয়েছে।
নাফ ও সোনাদিয়া ট্যুরিজম পার্কের অগ্রগতি
বেজা সূত্রে জানা গেছে, নাফ ট্যুরিজম পার্কের মাস্টার প্ল্যানের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার কাছে নাফ নদীর তীরে জালিয়ার দ্বীপে পার্কটি তৈরির জন্য দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারী খোঁজা হচ্ছে।
সম্ভাব্য বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে বেজা গত ৭ মে একটি আন্তর্জাতিক দরপত্র ইস্যু করেছে। এতে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বের (পিপিপি) মাধ্যমে নকশা, নির্মাণ, অর্থায়ন, পরিচালনা ও স্থানান্তর (ডিবিএফওটি) মডেলের আওতায় পার্কটি গড়ে তোলার প্রস্তাব আহ্বান করা হয়েছে।
এছাড়া সোনাদিয়া ইকো-ট্যুরিজম পার্কের মাস্টার প্ল্যানও অনুমোদন পেয়েছে। পিপিপির আওতায় এটি তৈরির নীতিগত অনুমোদনও পাওয়া গেছে।
বেজা সূত্র জানায়, সোনাদিয়া পার্কের ভূমি উন্নয়ন, প্রশাসনিক ভবন, ডাইক নির্মাণ, সেতু নির্মাণ ও বিদ্যুৎ সংযোগসহ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো প্রকল্প ইতিমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে।
পার্কটিতে থাকবে হোটেল কমপ্লেক্স, ইকো-ট্যুরিজম সুবিধা, ভাসমান জেটি, সামুদ্রিক অ্যাকোয়ারিয়াম, ইকো-কটেজ ও ভাসমান রেস্তোরাঁর মতো আধুনিক সুবিধা।