নীতিগত সহায়তার অভাবে আটকে আছে টায়ার শিল্পের বিকাশ
দেশে ৫ হাজার কোটি টাকার বেশি টায়ারের বাজার। তবে এই বাজারের ৯০ শতাংশই আমদানিনির্ভর। রপ্তানিতে রয়েছে বিপুল সম্ভাবনা। কিন্তু নীতিগত সহায়তার অভাব এবং কাঁচামালের সংকটে টায়ার শিল্পে বিনিয়োগের উদ্যোগ নিয়েও থমকে আছেন দেশি-বিদেশি উদ্যোক্তারা।
শিল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে বছরে ২৫ লাখ টায়ারের চাহিদা রয়েছে। কিছু কোম্পানি টায়ার উৎপাদন করছেও। কিন্তু তারপরও এখনও দেশের চাহিদার প্রায় ৯০ শতাংশ টায়ারই আমদানি করতে হয়।
ছয়-সাত বছর আগে বড় বিনিয়োগের উদ্যোগ নিয়েও কারখানা স্থাপন করেনি চীন-ভারতের দুটি কোম্পানি। স্থানীয় কিছু কোম্পানি কারখানা স্থাপন করার পরও উৎপাদনে যাচ্ছে না। আবার কারখানা সম্প্রসারণ করেও বর্ধিত সক্ষমতা ব্যবহার করছে না কোনো কোনো কোম্পানি।
উদ্যোক্তারা বলছেন, সব ধরনের টায়ার বানাতে বিশাল বিনিয়োগ—অন্তত ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা—দরকার। কিন্তু দেশে টায়ারের চাহিদা, বিশেষ করে ভারী যানবাহনের টায়ারের চাহিদা একেবারেই কম। এত কম চাহিদার জন্য কারখানাগুলোর পূর্ণ সক্ষমতা ব্যবহার করার দরকার পড়ছে না। উদ্যোক্তারা দাবি জানিয়েছেন, এজন্য সরকারের উচিত কাঁচামাল আমদানি আরও সহজ করা এবং রপ্তানির জন্য সুযোগ-সুবিধা দেওয়া।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন, দেশে টায়ার উৎপাদনের মূল কাঁচামাল কার্বন, রাবার, বিভিন্ন রাসায়নিক ও ইয়ার্নের পর্যাপ্ত সরবরাহ নেই। কাঁচামাল আমদানি করে উৎপাদন করলে খরচ চীন-ভারতের চেয়ে ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ বেড়ে যায়।
অন্যদিকে, ফিনিশড প্রোডাক্টে মাত্র ১০ শতাংশ শুল্ক থাকায় এরকম পণ্য আমদানি করাই বেশি সুবিধাজনক।
টায়ার অ্যান্ড টিউব মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ আসলাম জানান, 'দেশে বর্তমানে বছরে ২৫ লাখের বেশি ভারী যানের টায়ারের চাহিদা রয়েছে।
'হালকা যানের টায়ারের চাহিদা আরো বেশি। সব মিলিয়ে দেশে বছরে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকার টায়ার আমদানি হয়। সারাদেশে ২ হাজারের বেশি বিক্রেতা এসব টায়ারের ব্যবসা করছেন।'
তিনি আরও বলেন, 'আমদানি টায়ারের ওপর শুল্কহার ১০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২৫ শতাংশ করা হলে এবং স্থানীয় উৎপাদকদের কর সুবিধা দিলে দেশে এই খাতে আরও বিনিয়োগ হবে। দেশে কারখানা হলেই কেবল বিদেশ-নির্ভরতা কমবে।'
আটকে আছে ভারত-চীনের দুটি বড় বিনিয়োগ
বিপুল সম্ভাবনা দেখে ২০১৪ সালে বাংলাদেশে টায়ার শিল্পে ৭৭০ কোটি টাকা বিনিয়োগের ঘোষণা দেয় ভারতের আরপিজি এন্টারপ্রাইজেসের ফ্ল্যাগশিপ কোম্পানি সিয়াট (CEAT)।
বাংলাদেশী অংশীদার এ কে খান অ্যান্ড কোম্পানি লিমিটেডের সঙ্গে মিলে ২০১৮ সালে ঢাকার পাশে ভালুকায় জমিও কেনে কোম্পানিটি। তবে বাংলাদেশের বাজারে চাহিদা ও উৎপাদন-সক্ষমতার ব্যবহার নিয়ে দ্বিধায় পড়ে বিনিয়োগ স্থগিত রেখেছে কোম্পানিটি।
এ কে খান অ্যান্ড কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কে এম মাজেদুর রহমান বলেন, 'টায়ার ইন্ডাস্ট্রি বেশ ব্যয়বহুল। সব ধরনের টায়ার বানাতে মিনিমাম ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ দরকার। এত বিপুল বিনিয়োগ করে যে পরিমাণ প্রোডাক্টশন দরকার, তার ডিমান্ড বাংলাদেশে নেই। ফলে স্থানীয় বাজারের সঙ্গে রপ্তানি বাজার ধরতে হবে। এর জন্য সরকারের যে পলিসি সাপোর্ট দরকার সেটি বাংলাদেশে নেই।'
তিনি আরও বলেন, 'অন্যদিকে হেভি ট্রান্সপোর্টের টায়ারের একটি কারখানা বানাতে যে বিনিয়োগ দরকার, সে তুলনায় স্থানীয় বাজারের ডিমান্ড কম। ফলে কাঁচামাল আমদানি সহজলভ্য করার পাশাপাশি রপ্তানির সুযোগ করে দিতে হবে উদ্যোক্তাদের।
মাজেদুর রহমান জানান, রপ্তানিতে বাংলাদেশের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী ভারত, চীন ও শ্রীলঙ্কা। তিনি বলেন, 'টায়ারসহ মোটর পার্টস উৎপাদনে ভারত বেশ শক্তিশালী। চীন ও ভারতের পার্টস সারাবিশ্বে সহজলভ্য। প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে শ্রীলঙ্কারও অনেক কারখানা রয়েছে। ফলে বাংলাদেশে হুট করেই এত বড় বিনিয়োগের আগ্রহী নয় সিয়াট।'
এ কে খান অ্যান্ড কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আরও বলেন, 'সিয়াটের বিনিয়োগ ঘোষণার পরই আরও বেশ কয়েকটি কোম্পানি বাংলাদেশে টায়ার ইন্ডাস্ট্রিতে বিনিয়োগে নামে। কিন্তু কর ও ভ্যাটে ছাড় না পেলে এত বিনিয়োগ করে রিটার্ন পাওয়া যাবে না। এছাড়া রপ্তানি বাজারও তৈরি করতে হবে। তবে বিনিয়োগ প্রত্যাহার না করে বাংলাদেশের বাজার অবজারভেশনে রেখেছে সিয়াট।'
অন্যদিকে সিয়াটের মতোই বিনিয়োগের ঘোষণা দিয়েও কারখানা স্থাপন স্থগিত করে দিয়েছে চীনের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান কুনমিং আয়রন অ্যান্ড স্টিল হোল্ডিং কোম্পানি লিমিটেড। তবে বাংলাদেশের অংশীদার জিপিএইচ গ্রুপের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চলে জমি কিনে রেখেছে কোম্পানিটি।
২০১৬ সালে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের বাংলাদেশ সফরের পর প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশে ২৩০ কোটি ডলার বিনিয়োগের ঘোষণা দেয়। বাংলাদেশের ১৭টি কোম্পানিকে সঙ্গে নিয়ে প্রকৌশল খাতে এ বিনিয়োগের পরিকল্পনা করা হয়। এর মধ্যে জিপিএইচের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে টায়ার উৎপাদন প্রকল্প অন্যতম।
জিপিএইচ গ্রুপের সিএফও কামরুল ইসলাম বলেন, 'প্রথমে হালকা পরিবহনের জন্য এবং পরবর্তীতে ভারীসহ সব ধরনের টায়ার নির্মাণের কারখানা স্থাপনের পরিকল্পনা ছিল। তবে বাংলাদেশে বিপুল বিনিয়োগের বিপরীতে রিটার্ন পাওয়া নিয়ে শঙ্কা তৈরি হওয়ায় তা আপাতত হোল্ড রয়েছে।'
তিনি আরও বলেন, 'বিনিয়োগের তুলনায় স্থানীয় ডিমান্ড কম থাকলেও আমাদের আমেরিকা-ইউরোপের বাজার ধরার পরিকল্পনা ছিল। ওই সময় চীনের সঙ্গে আমেরিকার বাণিজ্য সম্পর্কে টানাপোড়েন ছিল। তবে পরিস্থিতি পরিবর্তন হওয়ায় এবং বাংলাদেশের তুলনায় ভিয়েতনামে বিনিয়োগ রিটার্ন সহজ হওয়ায় ওরা ওদিকে গিয়েছে। তবে বাংলাদেশে বিনিয়োগ পরিকল্পনা এখনও বাতিল হয়নি।'
স্থানীয় বিনিয়োগ
২০১৫ সালে সরকার কর অবকাশ ঘোষণার পর যমুনা গ্রুপ একাই ২ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করে ২৫ লাখ টায়ার উৎপাদন সক্ষমতার কারখানা স্থাপন করেছে। তবে কোম্পানিটির এখনও উৎপাদনে যায়নি।
যমুনা টায়ার অ্যান্ড রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড বড় বাস, ট্রাক, যাত্রীবাহী যান এবং মোটরসাইকেলসহ সব ধরনের টায়ার উৎপাদনের জন্য পঞ্চগড়ে কারখানার সব কাজ সম্পন্ন করেছে।
প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা বলছেন, আমদানিকৃত টায়ারের চেয়ে যমুনা টায়ারের দাম অধিকতর সাশ্রয়ী হবে। দেশের চাহিদা মিটিয়ে উৎপাদনের ৪০ শতাংশ রপ্তানি করা হবে।
যমুনা গ্রুপের পরিচালক (মার্কেটিং, সেলস অ্যান্ড অপারেশনস) মোহাম্মদ আলমগীর আলম বলেন, 'মেশিনারী স্থাপন শেষে আমরা জনবল নিয়োগও সম্পন্ন করেছি। ২০২০ সালের মাঝামাঝি সময়ে বিদেশী এক্সপার্টদের আসার কথা ছিল। কিন্তু করোনার কারণে সব আটকে গেছে।
'আমরা উৎপাদন শুরু করলে বিদেশে রপ্তানি করতে পারব। এজন্য সরকারকে কাঁচামাল আমদানিতে শুল্কছাড়েরর পাশাপাশি ভ্যাট ও ক্যাশ ইনসেনটিভ দিতে হবে।'
যমুনা গ্রুপ ছাড়াও মেঘনা গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান মেঘনা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড ৫০০ কোটি টাকা ব্যয়ে সাইকেল, বড় বাস ও ট্রাকের টায়ার উৎপাদনের জন্য একটি নতুন কারখানা স্থাপন করছে। মেঘনা বর্তমানে মোটরসাইকেল, ইজি বাইক, সিএনজিচালিত তিন চাকার গাড়ি, হালকা ট্রাক ও রিকশার টায়ার তৈরি করছে। প্রতিষ্ঠানটি সাইকেলের টায়ার ও টিউব রপ্তানিও করছে।
এছাড়া দেশে বিদ্যমান টায়ার উৎপাদকদের মধ্যে অ্যাপেক্স হুসেন গ্রুপ দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে এই খাতে আছে। কোম্পানিটি বর্তমানে মোটরগাড়ির টায়ার উৎপাদন করে।
তবে দেশে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি টায়ার উৎপাদন করছে গাজী গ্রুপ।
গাজী টায়ার বাস, ট্রাক, হালকা বাণিজ্যিক যানবাহন, মোটরসাইকেল, অটোরিকশা ইত্যাদির জন্য অনেক ধরনের টায়ার তৈরি করে।