পূর্বের অবস্থায় ফিরছে বাণিজ্য, তবে প্রতিবন্ধকতা রয়েই গেছে
দেশের অর্থনীতি এখন পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে যাওয়ার বিষয়ে মাসখানেক আগের তুলনায় ব্যবসায়ীদের আত্মবিশ্বাস বেড়েছে। কিন্তু, তারপরও তারা সামনে বেশ কিছু প্রতিবন্ধকতা দেখতে পাচ্ছেন। অর্থনীতিবিদ এবং ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দের মতে, প্রতিবন্ধকতাগুলো দ্রুত আগের জায়গায় ফিরতে বাধার সৃষ্টি করবে।
মহামারির অভিঘাতে স্থানীয় ও রপ্তানি বাজারের নেতিবাচক প্রভাব সত্ত্বেও টিকে থাকতে পেরেছে বেসরকারি খাত। তবে ঋণ প্রবৃদ্ধি এবং বিনিয়োগের তথ্য-উপাত্ত- তেমন একটা ভালো অবস্থা তুলে ধরছে না।
তবে, একমাত্র প্রণোদনা প্রকল্পই প্রতিষ্ঠানগুলোকে টিকিয়ে রেখে সামলে উঠতে সাহায্য করছে।
বেসরকারি খাতের জন্যে একমাত্র ভরসার জায়গা ছিল প্রণোদনা প্যাকেজ, যার কল্যাণে তারা কোনোরকমে ব্যবসা টিকিয়ে রাখে এবং তারপর কিছুটা ক্ষতি পুষিয়েও ওঠা শুরু হয়েছে।
গতকাল নগরের পৃথক দুই ওয়েবিনারে ব্যবসায়ীরা তাদের প্রতিবন্ধকতাগুলো চিহ্নিত করেন। ব্যবসা রেজিস্ট্রেশন করা থেকে শুরু করে ট্যাক্স প্রদান সংক্রান্ত বিভিন্ন সমস্যার কথা উঠে আসে এই ওয়েবিনারে।
আগের দিন এক সভায় ব্যবসায়ী নেতারা বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশীর কাছে তাদের উদ্বেগ প্রকাশ করেন। বাণিজ্যিক পরিবেশকে সহজ-স্বাভাবিক করতে সকল বাধা দূর করার আহ্বানও জানান তারা।
একে খান গ্রুপের পরিচালক আবুল কাশেম খান সানেমের ওই আয়োজনে বলেন, "বাংলাদেশ এখন অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের পথে আছে। এটা সত্যি যে, সরকারি প্রণোদনা আমাদের বড় ধরনের সহায়তা করেছে। কিন্তু, বেসরকারি খাতের সহনশীলতা এবং অভিযোজন ক্ষমতার কারণেই; অন্যদের তুলনায় আমাদের অর্থনীতি একটি ভালো অবস্থানে আছে।"
নিজের প্রতিষ্ঠানের কথা উল্লেখ করে আবুল কাশেম বলেন, নয় মাস আগের ক্ষতি তারা ৭০ থেকে ৭৫ শতাংশ পর্যন্ত কাটিয়ে উঠতে পেরেছেন। টিকাদান কর্মসূচির সফলতা বাণিজ্য খাতকে নতুন গতি দেবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, "আমরা আগামী তিন মাসের মধ্যে করোনা পূর্ব পর্যায়ে ফিরে যাওয়ার বিষয়ে আশাবাদী। আমাদের সেই আত্মবিশ্বাস আছে।"
আবুল কাশেমের আত্মবিশ্বাসকে সমর্থন করছে সানেমের তথ্য। তথ্যানুসারে, বাণিজ্যিক পুনরুদ্ধার নিয়ে ব্যবসায়ীদের আত্মবিশ্বাস গত তিন মাসে ৪ শতাংশ থেকে বেড়ে ১৬ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে।
স্থানীয় বাজারে পরিবেশনকারী বাণিজ্যগুলো রপ্তানি বাজার নির্ভর বাণিজ্যের চাইতে এখন অধিক আত্মবিশ্বাসী।
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সাবেক সভাপতি কাশেম খান অর্থনীতির পুনরুদ্ধার গতি নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করলেও ট্যাক্স ডিডাকশন অ্যাট সোর্স বা টিডিএসকে বড় এক প্রতিবন্ধকতা হিসেবে উল্লেখ করেন। ''
ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, "ট্যাক্সের হার যদি ৩২ শতাংশ হয়ে থাকে, তাও ব্যবস্থাপনার কারণে সেটা ৬৬ শতাংশে গিয়ে পৌঁছায়। সোর্স ট্যাক্স হিসেবে যে পরিমাণ অর্থ কাটা হয় সেটাই ফাইনাল। এরপর বেশি জমা করলে, সেটাও আর ঠিক করা হয় না। কিন্তু, সোর্সের ক্ষেত্রে আপনি কম টাকা দিলে, তারা পুরোটা আদায় করতে ঠিকই ছুটে আসবে।"
একারণেই, বহু মানুষ তাদের আয়ের সঠিক তথ্য দেন না। এছাড়াও, এধরনের কর আদায় ব্যবস্থাপনার কারণে ছোট প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ হয়ে যায়, অন্যদিকে নতুন ব্যবসার উদ্যোগের পথে বাধা সৃষ্টি করে, বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
আয়কর ব্যবস্থাপনা বাংলাদেশের বড় এক গলগ্রহের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভারত, মালেশিয়া এবং থাইল্যান্ডের কর ব্যবস্থাপনা প্রতিযোগিতামূলক বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
সরকারের উচিত এখন কর ব্যবস্থাকে বাণিজ্য-উপযোগী করে তোলা। এছাড়াও, তিনি করের হার কমলে অধিক সংখ্যক নাগরিক ট্যাক্স দিতে আগ্রহী হবে বলেও দাবি করেন।
ডিসিসিআই কর্তৃক প্রকাশিত "রোড টু রিকভারি ২০২১" প্রতিবেদনেও একই ধরনের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
চেম্বারের বক্তব্য অনুযায়ী ট্যাক্স এবং নন-ট্যাক্সের পরিধি বৃদ্ধি করা উচিত। ফলে, বর্তমান করদাতাদের উপর চাপ কমবে। এছাড়াও, ট্যাক্স রিটার্ন দাখিল ও ভ্যাট রিটার্নের জন্য অটোমেশনের পরামর্শও দেওয়া হয়।
ব্যবসায়ীদের জন্য নতুন কোনো উদ্যোগ গ্রহণের জন্য ট্রেড লাইসেন্স পেতেও ধৈর্যের পরীক্ষা দিতে হয়।
এছাড়াও, প্রতিযোগিতায় থাকার অন্যান্য দেশের সাথে করপোরেট ট্যাক্স রেটে সামঞ্জস্যতা আনার কথা বলা হয়।
বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) উদ্যোগে ব্যবসায়িক কার্যক্রম সহজ করার একাধিক পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। এর মধ্যে সরকারি অফিসের আমলাতান্ত্রিক জটিলতাও নজরে রাখা হয়েছে।
লেদারগুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার ম্যানুফেকচারারস অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (এলএফএমইএবি) সভাপতি সাইফুল ইসলাম ঢাকার অদূরে আশুলিয়া ইউনিয়ন পরিষদ থেকে ট্রেড লাইসেন্স বানানোর অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করেন।
তিনি বলেন, ইউনিয়ন পরিষদ, মিউনিসিপ্যালিটি ও অন্যান্য স্থানীয় সরকারের কাছ থেকে ট্রেড লাইসেন্স যোগাড়ের জন্য বিভিন্ন অপ্রীতিকর পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যেতে হয়। তিনি ব্যাংকের মাধ্যমে নবায়ন ব্যবস্থার দাবিও জানান।
ওয়েবিনারে তিনি বলেন, "এর ফলে ব্যবসায়ীরা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানের হস্তক্ষেপ থেকে রক্ষা পাবে, সেই সাথে ব্যবসার খরচও কমবে।"
বিজিএমইএ সহ-সভাপতি আরশাদ জামাল বলেন, সরকারের প্রণোদনা ঋণের কারণে রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো শ্রমিকদের বেতন পরিশোধ করতে সক্ষম হয়েছে। পোশাকশিল্প খাতের সহনশীলতাই এর মূল শক্তি, যার মাধ্যমে খাতটি নিজেদের সামলে উঠতে পেরেছে।
"খাতটি বাংলাদেশিদের দ্বারা পরিচালিত। তারা এখন বিভিন্ন প্রতিকূল পরিস্থিতি সামাল দিতে শিখে গেছে। তাদের স্থিতিস্থাপকতার বিষয়টির মানদণ্ড প্রয়োজন," বলেন তিনি।
তবে মহামারির সময় রপ্তানি বাজারে পোশাকের মূল্য কমলেও বাণিজ্যিক ব্যয় ৫ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে, শিল্পখাতটিকে সামলে উঠতে বহু সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে। তবে তিনি আশাবাদী যে, খাতটি দ্রুতই পুরনো গতি ফিরে পাবে।
সানেমের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, ব্যবসায়ী প্রতিবন্ধকতার বিষয়গুলো সবারই জানা আছে। সরকারের এখন উচিত সেগুলোকে দূর করা, যাতে অর্থনীতি দ্রুত গতিতে আগের অবস্থায় ফিরতে পারে।
সমাধান খুঁজছেন ব্যবসায়ীরা:
বিভিন্ন খাতের ব্যবসায়ী নেতাদের প্রতিনিধিত্বকারী একটি দল গত সোমবার বাণিজ্য মন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ করেন। তারা ব্যবসায়ীক পরিবেশকে বাণিজ্য-উপযোগী করে তুলতে সকল হস্তক্ষেপ ও প্রতিবন্ধকতার সমাধান চান।
মন্ত্রীর কাছে তারা চারটি দাবী তুলেন। এর মধ্যে ট্রেড লাইসেন্সের ব্যবস্থা সহজ করার দাবী একটি।
এছাড়াও, প্রস্তাবিত সংশোধন বিল অনুসারে একক মালিকানাভিত্তিক প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য ন্যূনতম পেইড আপ ক্যাপিটালের পরিমাণ ৫০ লাখ থেকে কমানোর দাবি তোলেন তারা।
প্রতিনিধি দলের সদস্য আবুল কাশেম বলেন, "একক বিনিয়োগের মাধ্যমে ব্যবসা শুরু করার ক্ষেত্রে, টাকার এই পরিমাণ অত্যধিক বলে স্বীকার করে মন্ত্রী বলেন, এই পরিমাণ ৫ লাখে কমিয়ে আনা উচিত।"
এছাড়াও, তারা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও কর্তৃপক্ষের সাথে মিলিত উদ্যোগের দাবি করেছেন। বিভিন্ন ট্যাক্স হার কমিয়ে যৌক্তিক পর্যায়ে আনা এবং প্লাস্টিক ও লেদারের মতো অন্যান্য রপ্তানি পণ্যের ক্ষেত্রে শুল্কাধীন গুদাম সুবিধা বৃদ্ধির কথাও বলা হয়।
সোমবারের এক আয়োজনে সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) বক্তব্য অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত অভ্যন্তরীণ সহনশীলতার কারণে দেশের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের কার্যক্রম অপেক্ষাকৃত ভালো পর্যায়ে আছে। এছাড়া, দ্বিতীয় প্রণোদনা পরিকল্পনাও দ্রুত অর্থনীতির পুনরুদ্ধারে সাহায্য করবে।
(সংক্ষেপিত)
- মূল লেখা : Businesses see recovery, but hurdles remain