প্লাস্টিক খাত: রপ্তানি বিকাশের অপেক্ষায় থাকা বিশাল এক শিল্প
দেশে বছরে ২৮ হাজার কোটি টাকার বেশি পণ্য বিক্রির পাশাপাশি রপ্তানিতে বড় সুযোগ দেখছে প্লাস্টিক খাত। দেশে অভ্যন্তরে ২০ শতাংশ ও রপ্তানিতে ২৫ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধির বড় স্বপ্ন দেখছেন উদ্যোক্তারা।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, প্লাস্টিক পণ্যের আওতায় রয়েছে জীবন রক্ষাকারী ওষুধের প্যাকেট, ইনজেকশন সিরিঞ্জ, রক্ত সংগ্রহের ব্যাগ, চোখের মণি, তৈরি পোশাক শিল্পের হ্যাঙারসহ প্যাকেট, ক্রোকারিজ, ঘরের দরজা, জানালা, স্যানিটারি, ইলেকট্রিক দ্রব্যাদি, কম্পিউটার, টেলিফোন সেটসহ বিভিন্ন ধরনের খেলনা। আর বিশাল এই বাজারের চাহিদা পূরণে এগিয়ে চলছে দেশের প্লাস্টিক খাত। বর্তমানে দেশীয় বাজারে ৮০ শতাংশের বেশি যোগান দেওয়ার পাশাপাশি রপ্তানিও হাজার কোটি টাকার বেশি।
বাংলাদেশ প্লাস্টিক গুডস ম্যানুফ্যাকচারার অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিপিজিএমএ) সভাপতি শামীম আহমেদ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, বর্তমানে প্লাস্টিক পণ্যের বৈশ্বিক বাজার ৫৭০ বিলিয়ন ডলার। এ বাজারে বাংলাদেশের অংশ মাত্র দশমিক ৫ শতাংশ। গ্র্যান্ড ভিউ রিসার্চের মতে ২০২৫ সালে প্লাস্টিক পণ্যের বৈশ্বিক বাজারের আকার হবে ৭২১ বিলিয়ন ডলার। এ বাজারের এক শতাংশ বাংলাদেশের দখলে আসলেও ৬ হাজার কোটি টাকার বেশি রপ্তানি সম্ভব।
ওয়ার্ল্ড টপ এক্সপোর্টস এর একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্লাস্টিক পণ্যের বৈশ্বিক বাজারে শীর্ষস্থান দখলকারী দেশ চীনের নিয়ন্ত্রণে এ বাজারটির ২৬ দশমিক ৮ শতাংশ; যা থেকে তাদের আয় আসে ২১ দশমিক ৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এরপরের অবস্থানে রয়েছে জার্মানি যাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে ১২ শতাংশ বাজার।
শামীম আহমেদ বলেন, চীনের উপর অনেক দেশ নির্ভরতা কমিয়ে দেওয়ায় আন্তর্জাতিক বাজারে আমাদের দেশের পণ্যের চাহিদা বাড়ছে।
"আমাদের প্রায় ২৫০টির মতো এক্সপোর্ট অরিয়েন্টেড ফ্যাক্টরি রয়েছে। অনেক ছোট ছোট কারখানারও এক্সপোর্ট করার পটেনশিয়ালিটি আছে তবে ধারণক্ষমতা না থাকায় তারা পারছে না। বিপিজিএমইএ এই বিষয়টি নিয়ে কাজ করছে।"
"বিপিজিএমইএ বৈশ্বিক বাজারের ৩ শতাংশ অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে এবং আশা করি মাথাপিছু দেশীয় ব্যবহার ২০৩০ সালের মধ্যে ৩৫ কেজিতে পৌঁছে যাবে।"
শামীম আহমেদ বলেন, "প্লাস্টিক সম্পর্কে মানুষের মনে কিছু ভুল তথ্য ছিল এবং বেশ কয়েকবার সরকার প্লাস্টিকের নিষেধাজ্ঞা নিয়ে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নিয়েছে যা আমাদের পথকে কঠিন করে তুলেছিল।"
তিনি আরও বলেন, "সরকার একটি কেমিক্যাল জোন স্থাপনের পরিকল্পনা নিয়েছে, যেখানে আমাদের ১০০ একর জমি দেওয়া হতে পারে। তবে তা এখনও দেওয়া হয়নি।"
দেশে বিপুল চাহিদা
প্লাস্টিক খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশে তৈরি আধুনিক প্লাস্টিক পণ্য সামগ্রী আন্তর্জাতিক মানের। আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে পাল্লা দিয়েই প্লাস্টিকের ব্যবহার বাড়ছে বাংলাদেশে।
সরকারি তথ্য-উপাত্ত বলছে, ২০০৭ থেকে ২০ শতাংশ হারে বাড়ছে প্লাস্টিক পণ্যের বৈশ্বিক চাহিদা। প্লাস্টিকের বৈশ্বিক ব্যবহার মাথাপিছু ৫০ কেজি। যুক্তরাষ্ট্রে এ হার মাথাপিছু ১০৯ কেজি। চীন ও ভারতে যথাক্রমে ৩৮ ও ১১ কেজি। বাংলাদেশে মাথাপিছু প্লাস্টিকের ব্যবহার ৯ কেজি। ফলে বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে এ বাজারে।
দেশে প্লাস্টিক খাতের শীর্ষস্থানীয় কোম্পানি প্রাণ আরএফএল গ্রুপের পরিচালক (মার্কেটিং) চৌধুরী কামরুজ্জামান কামাল বলেন, "বৈশ্বিক অভিজ্ঞতা থেকে ধারণা করা যায় যে দেশের উন্নয়নের সঙ্গে সমান্তরালভাবে বাড়ছে প্লাস্টিক পণ্যের ব্যবহার। হাউজহোল্ড সামগ্রীতে ১০ শতাংশ ও সাধারণ পণ্যে ২০ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি রয়েছে।"
তিনি বলেন, "বাংলাদেশের জিডিপি বাড়ছে, ক্রয়ক্ষমতা বাড়ছে। প্লাস্টিক ও প্যাকেজিং ম্যাটেরিয়ালের ব্যবহারও বাড়ছে। উৎপাদন প্রক্রিয়া ও পুনর্ব্যবহারের উপযোগিতা বিবেচনায় সার্বিকভাবে প্লাস্টিক শিল্প পরিবেশবান্ধব শিল্প। ফলে এ পণ্যের বাজারও বাড়বে।"
কাজ করছে ১৫ লক্ষ মানুষ, বিনিয়োগ ২০,৫৫০ কোটি টাকা
বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট ডেভেলপমেন্ট অথরিটি'র (বিআইডিএ) মতে, বর্তমানে দেশে ৫ হাজার ৩০টি প্লাস্টিক কারখানা আছে। এর মধ্যে ৯৮ শতাংশই ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের মালিকানায়।
খাত সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, এই খাতে মোট বিনিয়োগ প্রায় ২০ হাজার ৫৫০ কোটি টাকা।
বিডা'র তথ্য অনুযায়ী, স্থানীয় বাজারে প্লাস্টিক পণ্যের বার্ষিক বিক্রয় প্রায় ২৮ হাজার কোটি টাকা। এরমধ্যে পিভিসি পাইপের বিক্রয় ৬ হাজার কোটি টাকার বেশি এবং গৃহস্থালী সামগ্রীর বিক্রি প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা।
এছাড়াও, বর্তমানে এই খাতটি জিডিপিতে প্রায় ১ শতাংশ অবদান রাখে এবং এ খাত থেকে বছরে ৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকার রাজস্ব আদায় করে সরকার।
বিকাশমান এই শিল্পটি বেশ বড় কর্মসংস্থান বাজারও তৈরি করেছে। বর্তমানে প্রায় ১৫ লক্ষ মানুষ এই খাতে কাজ করছে।
তবে প্লাস্টিক শিল্পে মানবসম্পদ উন্নয়নের জন্য কোন প্রতিষ্ঠান না থাকায় এ খাতটি তেমন দক্ষ জনশক্তি পাচ্ছে না বলে জানান, বিপিজিএমই এর সাবেক প্রেসিডেন্ট জসিম উদ্দিন।
নতুন বিনিয়োগের ঘোষণা
বিশ্বব্যাপী করোনা আঘাতের মধ্যেই প্লাস্টিক খাতে নতুন বিনিয়োগের ঘোষণা দেয় দেশের শীর্ষ প্লাস্টিক উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান প্রাণ আরএফএল গ্রুপ।
২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে দেওয়া ঘোষণা অনুযায়ী, প্লাস্টিকের তৈরি ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম, চিকিৎসা উপকরণ এবং খেলনা রপ্তানিতে ১৫৪ কোটি টাকার বিনিয়োগের কথা জানায় তারা।
গ্রুপটির অঙ্গ:প্রতিষ্ঠান বঙ্গ প্লাস্টিক ইন্টারন্যাশনাল; আদমজী রপ্তানি প্রক্রিয়াজাত শিল্পাঞ্চলে স্থাপিত নতুন কারখানায় বছরে প্রায় ৯ হাজার টন খেলনার সঙ্গে ৮৫০ টন পিপিই সরঞ্জাম যেমন; সার্জিক্যাল ফেস মাস্ক, কেএন-৯৫ মাস্ক, এন-৯৫ মাস্ক, সার্জিকাল গ্লাভস, জুতো কভার, এমওপি ক্যাপস, স্যানিটারি ন্যাপকিন, ডায়াপার এবং হ্যান্ড স্যানিটাইজার বার্ষিকভাবে উৎপাদন করবে।
করোনার মধ্যেই আরএফএলের চেয়ে বড় বিনিয়োগের ঘোষণা দিয়েছে এন মোহাম্মদ প্লাস্টিক ইন্ডাস্ট্রি। আগস্ট মাসের শুরুতে ৫০০ কোটি টাকা বিনিয়োগের ঘোষণা দিয়ে বাংলাদেশ ইকোনমিক জোন অথোরিটি'র (বেজা) সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করেছে তারা।
বঙ্গবন্ধু শিল্প নগরীতে স্থাপিত এই কারখানায় ১৬০০ মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টির আশা করছেন এন মোহাম্মদ প্লাস্টিক ইন্ডাস্ট্রির ম্যানেজিং ডিরেক্টর মো. নজরুল হক।
এছাড়াও বেশ কয়েকটি কোম্পানি বিনিয়োগের অপেক্ষায় রয়েছে বলে জানিয়েছেন খাত সংশ্লিষ্টরা।
বিকাশমান এই খাতের জন্য নতুন নীতিমালা
দেশের প্লাস্টিক খাতের বিকাশের লক্ষ্যে ন্যাশনাল প্লাস্টিক ইন্ডাস্ট্রি ডেভেলপমেন্ট পলিসি-২০২০ (৭ম খসড়া) প্রকাশ করেছে শিল্প মন্ত্রণালয়।
শিল্প মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, প্লাস্টিক শিল্প বিকাশের বিদ্যমান প্রতিবন্ধকতা ও প্রতিকূলতা বিবেচনা করেই একটি জাতীয় প্লাস্টিক শিল্প উন্নয়ন নীতি প্রণয়ন করছে সরকার। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের প্রেক্ষাপটে পরিবেশবান্ধব প্লাস্টিক শিল্পের কাঠামো গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতিতে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক দুই ধরনের বাজারই নীতিমালাটির ক্ষেত্রে বিবেচনায় নেয়া হয়েছে। মূল্য সংযোজন বৃদ্ধি, দক্ষ মানবসম্পদ উন্নয়ন, বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণ, উন্নত প্রযুক্তি থেকে শুরু করে শিল্পটির সার্বিক সুষম উন্নয়ন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে নীতিমালাটির ওপর মতামত গ্রহণও শুরু হয়েছে।
নীতিমালায় বলা হয়েছে, এ খাতের টেকসই প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে মান নিয়ন্ত্রণ, উদ্ভাবনী প্রযুক্তি, ছাঁচ তৈরির ব্যবস্থা, প্লাস্টিক বর্জ্যের যথাযথ ব্যবস্থাপনা, ব্যবসাবান্ধব কর ও শুল্কের ব্যবস্থা করা হবে।
শিল্প মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (পরিকল্পনা) মো. গোলাম ইয়াহিয়া দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "প্লাস্টিক খাতের নীতিমালাটি মতামত গ্রহণ পর্যায়ে আছে। এ খাতের উন্নয়নে উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। পরিবেশ ও সার্বিক কমপ্লায়েন্সকে গুরুত্ব দিয়ে প্লাস্টিক শিল্পনগরীসহ প্লাস্টিক শিল্পকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সংক্রান্ত কৌশলগত বিষয়গুলো এখানে যুক্ত করা হয়েছে।"