ফেনীতে নারিকেলের ছোবড়ায় দুই বন্ধুর ভাগ্য বদল
কয়েকটি নারিকেল সম্বল করে ২০১৪ সালে একটি ঝুপড়ি ঘর ভাড়া নেন দুই বন্ধু মো: ইউনুস ও জাফর ইকবাল ফারুক। ধারদেনা করে লাখখানেক টাকা বিনিয়োগ করে গত ৭ বছরে অর্ধকোটি টাকায় পৌঁছেছে তাদের ব্যবসা।
মাসে ১৮-২০ লাখ টাকার হিসাবে বছরে আড়াই থেকে তিন কোটি টাকার ৭ পদের নারিকেলের সামগ্রী বিক্রি হয় তাদের দোকান থেকে। দুই বন্ধুর ব্যবসায়িক সফলতার কথা এখন ফেনীর দাগনভূঞা উপজেলার সিলোনীয়া বাজার এলাকার মানুষের মুখে মুখে।
সরেজমিনে জানা গেছে, শুরুতে গ্রামগঞ্জের বিভিন্ন হাট থেকে নারিকেল সংগ্রহ করে বিভিন্ন আড়তে সরবরাহ করতেন ইউনুস ও ফারুক। পুঁজির স্বল্পতায় টিকে থাকার অনিশ্চয়তা দেখা দিলেও তারা হাল ছাড়েননি। পরবর্তীতে মাটিতে লোহা পুঁতে আধাআধি খোসা ছিলে সরবরাহ করা শুরু করেন।
শুরুতে খোসার চাহিদা না থাকলেও আস্তে আস্তে স্থানীয় লেপ-তোষকের দোকানিরা জাজিম তৈরীর জন্য আগ্রহ দেখাতে শুরু করে।
জাফর ইকবাল ফারুক বলেন, "চাহিদা বৃদ্ধির পাশাপাশি বড় আড়তদাররাও ক্রমান্বয়ে আমাদের মোকামে ভিড়তে শুরু করে। একসময় ফেনী থেকে চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, কুমিল্লা পর্যন্ত ছোট-বড় বাজার ও ফেনীর বিভিন্ন স্থানে লেপ তোষকের দোকানগুলোতে হেঁটে হেঁটে নারিকেলের ছোবড়া বিক্রি করতে দিনের পর দিন ধর্ণা দিয়েছি। কেউ আগ্রহ দেখিয়েছে, কেউ হয়তো কথাও বলেনি। এমনও দিন গেছে ঘরে রাখার জায়গা না থাকায় এবং গ্রাহক না পাওয়ায় লাখ টাকার ছোবড়া বর্ষায় জমিতে পচে গেছে"।
জানা গেছে, তাদের দুইজনের বাড়ি উপজেলার জায়লস্কর ইউনিয়নের খুশিপুর গ্রামে। ইউনুস কারিগর হিসেবে উৎপাদন ও অন্যান্য কর্মীদের দেখাশোনা করেন। জাফর ইকবাল ফারুক বিপণন ও নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার নিয়ে কাজ করেন।
তারা জানান, একসময় দুইজনে মিলে স্বল্প বিনিয়োগে নারিকেলের ব্যবসা শুরু করেন। এখন সেটি মাঝারি উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠানে রূপলাভ করেছে। নিয়মিত-অনিয়মিত মিলিয়ে ২০ জন মানুষের কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে।
ইউনুস মিয়া জানান, "নারিকেলের ছোবড়া প্রক্রিয়া করার কোন কারিগর ফেনী অঞ্চলে নেই। লক্ষ্মীপুরের মান্দারি, চন্দ্রগঞ্জ, পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও থেকে বেতনের পাশাপাশি থাকা-খাওয়ার সুবিধা দিয়ে কারিগর আনতে হয়েছে। নিজেরা শ্রম-ঘাম দিয়ে অনেক মাসে পরিবারের খরচও যোগাতে পারিনি। পর্যায়ক্রমে এলাকার লোকজনকে কাজ শেখার ব্যবস্থা করেছি। এখন আশেপাশের এলাকায় ১৫-১৬ জন দক্ষ শ্রমিক আছে"।
তিনি আরো জানান, ইতিমধ্যে ছোবড়া থেকে চোঁচা উৎপাদনের জন্য ১ লাখ টাকা মূল্যের একটি মেশিন বসানো হয়েছে। একসময় নারিকেলের অনেক কিছু ময়লা, অপ্রয়োজনীয় ভেবে ফেলে দিলেও এখন সবকিছুই ব্যবহারযোগ্য। নারিকেলের নানাবিধ কাঁচামাল বিদেশে রপ্তানিও হয়।
জাফর ইকবাল ফারুক জানান, একসময় নারিকেল শুধু তেল উৎপাদন ও বাসাবাড়িতে পিঠা-পুলি, পায়েস ইত্যাদি মুখরোচক খাবার তৈরীতে ব্যবহার হতো। এখন নারিকেলের ভিতরের সাদা অংশ থেকে তেল, কোকো পাউডার, নামীদামি ব্র্যান্ডের পোশাকের বোতাম, বাদ্যযন্ত্র একতারা, শো-পিস, চায়ের কাপ, মগ এবং ছোবড়া থেকে রশি, জাজিম, ম্যাট্রেস, ঝুড়ি ইত্যাদি তৈরি করা হয়। নারিকেলের চোঁচা তৈরির সময় যে ভুষি বের হয় তা ছাদবাগানের কাজে ব্যবহার হচ্ছে। প্রতিবছর শুধু ভুষি বিক্রি থেকে আয় হয় তিন লক্ষাধিক টাকা। ইতিমধ্যে তিনি ও তার স্ত্রী ফেনী এবং চট্টগ্রাম বিসিক থেকে উদ্যোক্তা প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছেন। ভবিষ্যতে ৮ লাখ টাকা দামের একটি মেশিন স্থাপন করে স্থানীয়ভাবে তেল উৎপাদনের পরিকল্পনা রয়েছে। নারিকেলের চিড়া তৈরির জন্য ১ লাখ টাকা দামের মেশিন বসানো হবে। মেশিনটি ভারত থেকে আমদানি করার প্রক্রিয়া চলছে বলেও জানান তিনি।
তিনি আরো জানান, ছাদকৃষির জন্য নারিকেলের ভুষি প্রতি ১০ কেজি বিক্রি হয় ২০০ টাকায়। চারা হওয়া নারিকেলগুলো সরকারি-বেসরকারি নার্সারীসমূহে সরবরাহ করা হয়। এছাড়া ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, নওগাঁ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, দিনাজপুর সহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে নারিকেলের চাহিদা মেটানো হয়। কোনদিন ১৫-২০ ট্রাক নারিকেল সরবরাহ করা হয়। প্রতি ট্রাকে আকারভেদে ৮ থেকে ১০ হাজার পিস নারিকেল পাঠানো হয়। প্রতি ট্রাক নারিকেলের দাম ৩-৪ লাখ টাকা।
জাফর ইকবাল ও ইউনুস আক্ষেপ করে বলেন, নারিকেল সামগ্রীর বহুমাত্রিক উৎপাদন ও বাণিজ্যিক সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু ব্যাংকগুলো এ খাতে বিনিয়োগে আগ্রহ দেখায় না। বিশেষ ঋণ সহায়তা পেলে কারখানা পর্যায়ে উন্নীত করে উৎপাদনের সক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্টদের সহায়তা কামনা করেন তারা।