ফেলে দেয়া নারিকেল ছোবড়ায় কোটি টাকার কোকো ফাইবার আর কোকো ডাস্টের ব্যবসা
গত ১০ বছর আগেও নারিকেল ছিলে ছোবড়া ফেলে দেয়া হতো। কেউ কেউ শুধুমাত্র জ্বালানী হিসেবে ব্যবহার করতো। কিন্ত আগের ফেলে দেয়া নারিকেলের ছোবড়া এখন অনেক দামী ও খুবই চাহিদাসম্পন্ন পণ্য। শুধু ছোবড়াই না, ২-৩ বছর যাবত এই ছোবড়ার গুঁড়াও মূল্যবান পদার্থ। এমন বক্তব্য লক্ষ্মীপুরের রায়পুর উপজেলার হায়দরগঞ্জ বাজারের নারিকেলজাত পণ্য ব্যবসায়ী আবদুর রহিমের।
নারিকেল ছোবড়া থেকে শৌখিনপণ্য তৈরির প্রধান উপাদান কোকো ফাইবার এবং মাটিবিহীন ছাদবাগান, নার্সারির গাছ বপন, পশু ও পোল্ট্রিখামার তৈরির অন্যতম উপাদান কোকো ডাস্ট। কোকো ফাইবার ও কোকো ডাস্ট উৎপাদনের প্রধান বাজার দেশের অন্যতম নারিকেল উৎপাদনকারী জেলা লক্ষ্মীপুর।
লক্ষ্মীপুরে এখন বছরে প্রায় অর্ধশত কোটি টাকার কোকো ফাইবার ও ডাস্ট উৎপাদন হয়। বর্তমানে নতুন এ দুটি পণ্যের চাহিদা এত বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে যে, কারখানাগুলো পণ্য উৎপাদন করার আগেই অগ্রিম বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী, কৃষক এবং শ্রমিকদের সাথে কথা বলে এমন তথ্য জানা গেছে।
লক্ষ্মীপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানায়, জেলায় ২ হাজার ৭৩৫ হেক্টর জমিতে নারিকেল বাগান রয়েছে। রয়েছে প্রতিটি বাড়িতেই নারিকেল গাছ। বাগান ও বাড়ি থেকে বছরে প্রায় সাড়ে ৫-৬ কোটি শুকনো নারিকেল আহরণ করা হয়। প্রসেসিং কারখানাগুলোতে শুকনো নারিকেলের ছোবড়া থেকে কোকো ফাইবার বা আশঁ এবং ছোবড়ার গুঁড়া বা কোকো ডাস্ট তৈরি করা হয়।
নারিকেল ক্রয়-বিক্রয়ের আড়ত ও ছোবড়া প্রসেসিং কারখানা গড়ে ওঠেছে জেলার রায়পুর উপজেলার হায়দরগঞ্জ, সদর উপজেলার দালাল বাজার, মান্দারী, চন্দ্রগঞ্জ, রামগঞ্জ উপজেলার পানপাড়া, মীরগঞ্জ, সোনাপুর, কমলনগর উপজেলা হাজিরহাট, রামগতির আলেকজান্ডার ও জমিদারহাটে। এসব এলাকায় ছোট বড় ৩০টি কারখানা রয়েছে। প্রতিটি কারখানায় নারী ও পুরুষ মিলে কমপক্ষে ১০-১২ জন শ্রমিক কাজ করে।
কারখানা শ্রমিক সেলিম জানান, গত ১০ বছর যাবত নারিকেলের ছোবড়ার আঁশ দিয়ে জাজিম, পাপোশ, রশি, সোফা ও চেয়ারের গদিসহ বিভিন্ন ধরনের শৌখিন ও প্রয়োজনীয় পণ্য তৈরি করা হচ্ছে। বেডিং শিল্পেও ছোবড়ার ব্যবহার ছিল। আর ছোবড়া থেকে ফাইবার তৈরির সময় যে গুঁড়া পাওয়া যেতো তা কোন কাজে লাগতো না। কিন্ত এখন কোকো ফাইবার নামে ছোবড়ার আঁশ এবং কোকো ডাস্ট নামে ছোবড়ার গুঁড়ার ব্যাপক চাহিদা ও দাম।
রায়পুর উপজেলার হায়দরগঞ্জ বাজারের নারিকেল ব্যবসায়ী আবদুর রহিম জানান, প্রতিটি কারখানায় প্রতিদিন কয়েক টন ছোবড়াকে আঁশে পরিণত করা হয়। ব্যাপক চাহিদা থাকায় জেলার বিভিন্ন স্থানে প্রতি বছর ছোবড়া প্রক্রিয়াকরণ কারখানা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ছোবড়া থেকে মেশিনের সাহায্যে বের করা হয় আঁশ বা ফাইবার। ছোবড়া সংখ্যা হিসেবে ক্রয় করা হয়। এক হাজার নারকেলের ছোবড়ায় কমপক্ষে ৮০ কেজি আঁশ বা ফাইবার পাওয়া যায়। তিনি আরো জানান, প্রতিটি কারখানা থেকে বছরে প্রায় দেড় থেকে দুই কোটি টাকার ফাইবার বিক্রি করা হয়।
একই এলাকার তোফায়েল জানান, গত ২ বছর আগেও প্রতিটি নারিকেলের ছোবড়া কেনা হতো ৫০ পয়সা দরে। এখন মানভেদে প্রতিটি নারিকেলের ছোবড়া ৫-৭ টাকায় কেনা হয়। ছোবড়া থেকে ফাইবার তৈরির পর প্রতি ২০ কেজি ওজনের একেকটি ফাইবার বান্ডেল বিক্রি হয়ে থাকে ৫০০-৬০০ টাকা দরে। প্রতিটি কারখানায় সপ্তাহে ৪-৬ ট্রাক ফাইবার উৎপাদন হয়। প্রতি ট্রাকে কমপক্ষে ২০০ বান্ডেল ফাইবার বহন করা হয়। তিনি জানান, সব খরচ বাদে একেকটি কারখানা মাসে ৫০ হাজারের বেশি আয় করে থাকে।
দালাল বাজার এলাকার সততা ট্রেডার্সের মালিক মোঃ জাকির হোসেন বলেন, "আমরা ছোবড়া থেকে ফাইবার তৈরি করি। আমাদের থেকে ফাইবার নিয়ে অন্য কোম্পানীগুলো তোশকের ভেতরের অংশ ম্যাট্রেস বা কয়ার বেল্ট তৈরি করে। সে কারণে বর্তমানে ছোবড়ার আঁশ বা ফাইবারের ব্যাপক চাহিদা।"
অন্যদিকে নার্সারি মালিক মোঃ আনোয়ার জানান, ছোবড়া থেকে ফাইবার তৈরির সময় যে গুঁড়া বের হয় তা দিয়ে মাটি ছাড়া শাকসবজি চাষ, আধুনিক গ্রিন হাউজ ও ছাদ বাগানের জন্য কোকো মাস ও কোকো ডাস্ট তৈরি করা হয়। চারা উৎপাদনের জন্য এখন মাটির পরির্বতে কোকো ডাস্ট খুবই জনপ্রিয়। সে কারণে ছোবড়ার গুঁড়াও এখন মূল্যবান। এক হাজার নারিকেলে উপজাত হিসেবে বের হয় ১৬০ কেজির মতো গুঁড়া বা কোকো ডাস্ট। ২০ কেজির প্রতি বস্তা কোকো ডাস্ট ১৪০-১৬০ টাকায় পাইকারি বিক্রি করা হয়। প্রতি কারখানা বছরে ১৫-২০ লাখ ছোবড়ার কোকো ডাস্ট বিক্রি করে।
কোকো ডাস্টের ক্রেতা মোঃ ফারুক জানান, ছোবড়ার গুঁড়া কোকো ডাস্ট দিয়ে 'কয়ার পিট' নামের একটা বিশেষ পণ্য তৈরি করা হয়। পশুপালন ফার্মে এটির ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। 'কয়ার পিট' পশুর খামারের মেঝেতে মলমূত্র শুষে নিতে ব্যবহার করা হয়। তিনি আরো জানান, কোকো ডাস্টের ৮-১০ গুণ পানি ধারণক্ষমতা রয়েছে। সে কারণে কৃষিতে বর্তমানে কোকো ডাস্ট জনপ্রিয় হচ্ছে।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে লক্ষ্মীপুর বিসিক শিল্প নগরীর সম্প্রসারণ কর্মকর্তা শাহরিয়ার ইসলাম খান বলেন, "ফেলনা নারিকেলের ছোবড়া থেকে লক্ষ্মীপুরে অনেকগুলো কারখানা তৈরি হয়ে বহু মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। অপ্রচলিত দুটি পণ্যের ব্যাপক বাজার তৈরি হওয়ায় এ জেলার অর্থনীতি সমৃদ্ধ হচ্ছে। পাশাপাশি বছরে প্রায় অর্ধশত কোটি টাকা আয় হচ্ছে কোকো ফাইবার ও কোকো ডাস্ট থেকে।"