বগুড়ার দই রপ্তানিতে বিপুল সম্ভাবনা
সরকারি সহযোগিতার পাশাপাশি দ্রুত পরিবহন নিশ্চিত করা সম্ভব হলে বগুড়ার দই ভারত ও নেপালসহ অনেক দেশেই রপ্তানির সুযোগ রয়েছে। ব্যবসায়ীরা এ দাবি করে বলেছেন, তার প্রমাণ পাওয়া গেছে ২০০৯ সালে ভারতের শিলিগুড়িতে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলায়।
ওই মেলায় বগুড়ায় তৈরি এক ট্রাক দই কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই বিক্রি হয়ে যায়।
দেশের বাইরে সুস্বাদু এ খাদ্যের চাহিদার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে তখন থেকেই রপ্তানির সরকারি অনুমোদনের চেষ্টা করছেন ব্যবসায়ীরা। কিন্তু এখনো তা পাওয়া যায়নি। তবে প্রশাসনিক কর্মকতারা বলেছেন, দই রপ্তানির সুযোগ সৃষ্টি করতে প্রায় এক বছর আগে কাজ শুরু হয়েছে।
বাণিজ্য সচিব মো. জাফর উদ্দিন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান, দই রপ্তানি বিষয়ক কোনো আবেদনপত্র এখনো তারা পাননি।
'রপ্তানির জন্য কী ধরনের সহযোগিতা প্রয়োজন, প্রস্তুতকারকরা তা আমাদের জানালে আমরা সে অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করব। যদি দই উৎপাদনকারীদের কোনো সংগঠন থাকে, তারা কিংবা বগুড়া চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি এ ব্যাপারে চাইলে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে। আমি ব্যক্তিগতভাবে চেম্বারের সঙ্গে যোগাযোগ করব,' বলেন তিনি।
সচিব জানান, রপ্তানি পণ্যে বৈচিত্র্য আনার ব্যাপারে সরকার ও তার মন্ত্রণালয়ের আগ্রহ রয়েছে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষে তিনি দই প্রস্তুতকারকদের সব ধরনের সহযোগিতা দেওয়ার আশ্বাস দেন।
বগুড়ার পাশাপাশি দেশের অন্যান্য অঞ্চলে দই উৎপন্ন হলেও বিশেষ কিছু গুণ আর স্বাদের কারণে 'বগুড়ার দই' স্থান করে নিয়েছে সবার ওপরে।
বাংলাদেশ জাতীয় তথ্য বাতায়নে বগুড়া জেলার বর্ণনায় বগুড়ার দই সম্পর্কে বলা হয়েছে, 'স্বাদে ও গুণে অতুলনীয়'।
চাহিদার তুলনায় বগুড়ায় কী পরিমাণ দই উৎপাদন হয়, তার কোনো সঠিক হিসাব না থাকলেও দই প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর পাশাপাশি ব্যবসায়ীরা বলছেন, ছোট-বড় মিলিয়ে এখন ৪০০ কারখানায় প্রতিদিন গড়ে তৈরি হয় প্রায় ৫০ টন আর উৎসবে, বিশেষ করে দুই ঈদে এ চাহিদা বেড়ে দ্বিগুণেরও বেশি হয়।
উত্তরাঞ্চলীয় শ্রমিক ফেডারেশনের সদস্য সচিব আব্দুল মোমিন জানান, বগুড়ার বিভিন্ন এলাকায় গড়ে ওঠা কারখানাগুলোতে প্রায় ১৫ হাজার শ্রমিকের কর্মসংস্থান হয়েছে। 'এদের সবাই অবশ্য সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত নন; তবে বেশির ভাগই সদস্য এবং অনেক বছর ধরেই তারা কাজ করছেন দই তৈরির কারখানায়', বলেন আব্দুল মোমিন।
'এশিয়া সুইটস' বগুড়ায় মিষ্টি তৈরি শুরু করে ১৯৮৫ সালে আর দই ১৯৯৫ সালে। তাদের দই ও মিষ্টির চাহিদা এখন দেশজুড়ে। প্রতিষ্ঠানটি প্রতিদিন প্রায় দুই টন দই তৈরি করে। সবটাই বিক্রি হয়ে যায় দুপুরের মধ্যে।
এশিয়া সুইটসের অন্যতম পরিচালক মো. নুরুল বাশার চন্দন জানান, তাদের কারখানায় তৈরি দই বাণিজ্যিকভাবে প্রথম যায় ভারতের শিলিগুড়িতে। 'দইয়ের গুণগত মান ঠিক রাখায় ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই টেবিলে নিতে হবে। এর বেশি সময় স্বাভাবিকভাবে রাখলে গুণগত মান নষ্ট হয়ে যায়। গুণগত মান ঠিক রাখতে তাই প্রয়োজন দ্রুত পরিবহন নিশ্চিত করা,' বলেন তিনি।
একক প্রতিষ্ঠান হিসাবে এশিয়া সুইটস বছরে প্রায় ১ কোটি ৩০ লাখ টাকা ভ্যাট দেয় বলেও উল্লেখ করেন চন্দন।
অন্যদিকে, 'আকবরিয়া' লাচ্ছা সেমাই বিদেশে রপ্তানি হলেও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মতো তাদের দইও বাণিজ্যিকভাবে দেশের বাইরে রপ্তানি করা যাচ্ছে না।
আকবরিয়া গ্রুপের চেয়ারম্যান মো. হাসান আলী আলাল জানান, তার প্রতিষ্ঠানে প্রতিদিন গড়ে তৈরি হয় ৩ টন দই। তিনি দাবি করেন, আকবরিয়ার দইয়ের মান খুবই ভালো।
'আমাদের প্রতিষ্ঠানে তৈরি দই তিনটি রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে গেছে এবং সবগুলো অনুষ্ঠানের আগে সরকারি কর্মকর্তারা মান যাচাই করেছেন,' বলেন মো. হাসান আলী আলাল।
তিনি জানান, আকবরিয়া গ্রুপ আমেরিকায় দুইবারে ৬০০ গ্রাম ওজনের ১০ হাজার পিস দই পাঠিয়েছে। গ্রাহকরা খুবই খুশি হয়েছেন বগুড়ার দই খেয়ে; কিন্তু নানা জটিলতায় এখনো দই রপ্তানির সুযোগ পাননি ব্যবসায়ীরা।
ব্যবসায়িক সৌহাদ্য বাড়াতে ২০০৯ সালে ভারতের শিলিগুড়িতে নর্থ বেঙ্গল চেম্বার অব কমার্স আয়োজন করে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলা। বগুড়ার প্রতিষ্ঠান 'শোভা এন্টারপ্রাইজ' সেখানে প্রথমবারের মতো বাণিজ্যিকভাবে নিয়ে যায় দই।
প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার সৈয়দ আহম্মদ কিরণ জানান, ওই চেম্বারের সভাপতির অনুরোধে দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী ও কাস্টমস মেলায় বগুড়ার দই নিয়ে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়। 'হিমায়িত ট্রাকে তিন টন দই ওই মেলায় নেওয়ার পরপরই ভারতীয় টিভি চ্যানেল এ খাদ্য নিয়ে লাইভ অনুষ্ঠান সম্প্রচার করে আর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই শেষ হয়ে যায় সব দই,' বলেন তিনি।
কিরণ দাবি করেন, সরকার দই রপ্তানির অনুমতি দিলে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব।
সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা, ব্যবসায়ীদের উৎপাদন সক্ষমতা বৃদ্ধি আর গুণগত মান ঠিক রাখতে পারলে বগুড়ার দই রপ্তানি পণ্য হিসেবে দেশের বাইরে পাঠানোর ব্যাপক সুযোগ রয়েছে। এক্ষেত্রে সরকারের সুর্নিদিষ্ট নীতিমালা থাকতে হবে বলে জানান তিনি।
বগুড়ার 'মিডসিটি সুইটসে'র মালিক তানভীর বলেন, 'বিশ্বায়নের যুগে সবকিছু এখন হাতের মুঠোয় চলে এসেছে। ব্যবসা-বাণিজ্য সবকিছু এখন অনেক সহজ। বগুড়ার দই আন্তর্জাতিক বাজারে নেওয়া এখন অবশ্যই সময়ের দাবি। এ ক্ষেত্রে সরকারিভাবে পৃষ্ঠপোষকতা খুব জরুরি।'
'বগুড়ার দই দেশের বাইরে রপ্তানি করা গেলে অর্থনৈতিকভাবেও বেশ লাভবান হবে দেশ। একইসঙ্গে বাড়বে কর্মসংস্থানও', যোগ করেন তিনি।
বগুড়া চেম্বার অব কমার্সের সহ-সভাপতি মাহফুজুল ইসলাম বলেন, 'দই রপ্তানি ও বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে বিমান বন্দরের কোনো বিকল্প নেই। উত্তরাঞ্চলের সঙ্গে ঢাকা ও আন্তর্জাতিকভাবে বিমানে যোগাযোগ করা গেলে এ পণ্যের গুণগত মান ঠিক রেখে রপ্তানি করা সহজ হবে। অর্থনৈতিকভাবে পরিবর্তন আসবে উত্তরাঞ্চলে। বাড়বে কর্মসংস্থান।'
'দই রপ্তানি হলে বাংলাদেশের সুনামও বাড়বে,' বলেন তিনি।