বছরে ৩০ হাজার মেট্রিক টন প্লাস্টিক রিসাইক্লিং করছে প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ
প্লাাস্টিকের ভাঙা চেয়ার, মোড়া, বালতি, বাটিসহ বিভিন্ন গৃহস্থালি পণ্য একটি মেশিনের প্লেটের ওপর রাখা হচ্ছে। পণ্যগুলো মেশিনের আরেক পাশ দিয়ে ছোট ছোট প্লাষ্টিক চূর্ণ হয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। এই প্লষ্টিকের গুঁড়োগুলো বস্তায় ভরে আরেকটি কারখানার মেশিনে দিয়ে স্বয়ংক্রিয় কয়েকটি ধাপে তৈরি করা হচ্ছে প্লাস্টিক তৈরির কাঁচামাল রেজিন। যা দিয়ে নতুন করে তৈরি হচ্ছে প্লাস্টিকের বালতি, চেয়ার, বেলচা, ফুলের টবসহ ১০০ ধরনের পণ্য।
হবিগঞ্জের প্রাণ আরএফএল ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কে সরেজমিন ঘুরে এভাবেই ভাঙাচোরা প্লাস্টিক রিসাইক্লিং করে নতুন প্লাষ্টিকের পণ্য তৈরি করতে দেখা গেল।
প্রাণ আরএফএলের সংশ্লিষ্টরা জানান, ২০১২ থেকে প্রতিষ্ঠানটি ব্যবহারের পর ফেলে দেওয়া এসব প্লাস্টিক পণ্য পুনর্ব্যবহারের জন্য তৈরি করছে। এরজন্য সারাদেশে তাদের পুরোনো প্লাস্টিক সংগ্রহের জন্য ১০টি সংগ্রহ কেন্দ্র তৈরি করা হয়েছে। সেখানে প্লাস্টিকগুলো গুঁড়ো করে হবিগঞ্জের রিসাইক্লিং কারখানায় পাঠানো হয়। প্রতিবছর প্রায় ৩০ হাজার মেট্রিক টন 'ব্যবহৃত প্লাস্টিক' সংগ্রহ করছে তারা। এখান থেকে প্রায় ২৭ হাজার মেট্রিক টন কাঁচামাল উৎপন্ন হয়।
হবিগঞ্জের ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কের একটি কারখানায় শুধুমাত্র পুরোনো প্লাস্টিক ব্যবহার করে রেজিন (প্লাষ্টিক তৈরির কাচামাল) তৈরি করা হচ্ছে। যেখানে মোট ৭টি প্রডাকশন লাইন রয়েছে।
এখান থেকে রেজিন তৈরি করে তা কালার ও গ্রেড অনুযায়ী আলাদা করা হচ্ছে। পরে সেগুলো মেশিনে দিয়ে তৈরি করা হচ্ছে নতুন সব প্লাস্টিক পণ্য।
জানা গেছে, প্লাস্টিক রিসাইক্লিং খাতে গ্রুপটির এ পর্যন্ত মোট বিনিয়োগ প্রায় ৩২০ কোটি টাকা। যেখানে প্রায় ২,০০০ লোক সরাসরি এবং ৪,০০০ লোকের পরোক্ষভাবে কর্মসংস্থান হয়েছে। বর্তমানে গ্রুপটি তার মোট প্লাস্টিক ব্যবহারের প্রায় ১০ ভাগ রিসাইক্লিং করে থাকে।
আগামী পাঁচ বছরের পরিকল্পনার কথা উল্লেখ করে প্রাণ আরএফএল গ্রুপের পরিচালক (বিপনন) কামরুজ্জামান কামাল বলেন, "মোট ব্যবহারের প্রায় ২০ ভাগ রিসাইক্লিং করার লক্ষ্য রয়েছে আমাদের। খুব শীঘ্রই আরো নতুন ১০টি সংগ্রহ কেন্দ্র করা হবে। "
সংশ্লিষ্টরা জানান, আমদানি করলে ২৭ হাজার টন কাঁচামালের পেছনে ব্যয় হতো প্রায় ৪০০ কোটি টাকা। রিসাইক্লিং কার্যক্রম পরিচালনার ফলে প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় হচ্ছে।
জানা গেছে, প্রতিষ্ঠানটি প্রতিবছর প্রায় তিন লাখ মেট্রিক টন প্লাস্টিক পণ্য উৎপাদন করে থাকে। এসব পণ্যের মধ্যে রয়েছে গৃহাস্থালি পণ্য, পাইপ ও ফিটিংস, গার্মেন্টস এক্সেসরিজ ও খাদ্যপণ্যের প্যাকেজিং।
প্রাণ-আরএফএল পিইটি, এইচডিপিই, এলডিপিই, পিপি, পিভিসি, পিএস ও এবিএস প্লাস্টিক সংগ্রহ করে। তবে বেশি সংগ্রহ করে পিইটি, পিপি ও পিভিসি। ডিলার, প্লাস্টিক সংগ্রহকারী, ভাঙারি ব্যবসায়ী, প্লাস্টিক পণ্যের কারখানা ও ডিপো থেকে থেকে এসব'ব্যবহৃত প্লাস্টিক' সংগ্রহ করা হয়। এসব 'ব্যবহৃত প্লাস্টিক' মানভেদে ৬০-৭০ টাকা কেজি দরে সংগ্রহ করা হয়।
আরএফএল রিসাইক্লিং প্রজেক্টের চীফ অপারেটিং অফিসার মো. কামরুল হাসান বলেন, "পিইটি বোতল এবং পিইটি জাতীয় প্যাকেজিং এর ব্যাপক ব্যবহার হয় বাংলাদেশে। এ ভাবনা থেকে প্রাণ-আরএফএল এ খাতে আগামী দুই বছরের মধ্যে পিইটি বোতলের রিসাইক্লিং প্লান্ট করার পরিকল্পনা করছে, যেখানে ফেব্রিক পর্যন্ত করা যাবে।"
এর ফলে পরোক্ষভাবে পরিবেশের ব্যাপক উপকার হবে এবং এ খাতকে বিকশিত করতে ব্যাপক ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা যায়।
স্থায়িত্ব, কম খরচ এবং বিভিন্ন আকার ও সহজলভ্যতার কারণে প্লাস্টিকের ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে। বর্তমানে প্রতিবছর বিশ্বব্যাপী প্রায় ৪০০ মিলিয়ন মেট্রিক টনের বেশি প্লাস্টিক উৎপাদিত হচ্ছে।
বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় চার হাজার প্লাস্টিক উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যেখানে প্রায় ২০ লাখের বেশি লোক প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত। বাংলাদেশে প্রতিবছর প্লাস্টিকের ব্যবহার প্রায় ২৪ লাখ টন। বছরে এর মাথাপিছু ব্যবহার প্রায় ১৫ কেজি। এক্ষেত্রে মাথাপিছু ব্যবহারে বাংলাদেশের অবস্থান অনেক পিছনে। বিশ্বে বছরে মাথাপিছু প্লাস্টিক ব্যবহৃত হয় ৬০ কেজি। উত্তর আমেরিকা, পশ্চিম ইউরোপ ও জাপানের মতো উন্নত দেশগুলোতে প্রতিবছর মাথাপিছু ব্যবহার একশ কেজিরও বেশি।
কামরুজ্জামান কামাল বলেন, "আমাদের রিসাইক্লিং প্লাস্টিক যে দামে বিক্রি করা হবে, সেখান থেকে দুই টাকা করে সিএসআর খাতে ব্যবহারের পরিকল্পনা করছি আমরা। এ টাকা দিয়ে গাছ লাগানো থেকে শুরু করে পরিবেশের উন্নয়নে কাজ করা হবে।"