বিকাশের অভাবে রপ্তানি হারিয়েছে দেশীয় কার্পেট ইন্ডাস্ট্রি
সত্তর থেকে নব্বইয়ের দশকের মধ্যে বাংলাদেশে বানানো কার্পেট শোভা পেত অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশগুলোতে। কিন্তু সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এ খাতে যথাযথ প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ও উদ্ভাবন ঘটানো সম্ভব হয়নি। সেইসঙ্গে নকশা এবং গুণগত মানেরও উন্নতি না হওয়ায় এই শিল্প এখন প্রায় হারিয়ে যাওয়ার পর্যায়ে পৌঁছে গেছে।
আগে দেশীয় বাজারে কার্পেটের যথেষ্ট চাহিদা থাকলেও বর্তমানে তা পুরোপুরি আমদানি নির্ভর হয়ে পড়েছে।
আগে দেশে সাতটি প্রতিষ্ঠান কার্পেট বানাত এবং দেশীয় চাহিদা মিটিয়ে তারা বিদেশে রপ্তানি করতে সক্ষম ছিল।
কার্পেট উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সেলস এজেন্ট হয়ে কাজ করতেন শাহেদুল ইসলাম হেলাল। তিনি বললেন, 'আগে আমরা যে মানের কার্পেটই বানাতাম, ক্রেতারা তাই কিনে নিতেন। কিন্তু সময় পাল্টানোর সঙ্গে সঙ্গে ক্রেতারা নতুন নতুন ডিজাইন খুঁজতে থাকেন। কিন্তু আমরা তাদের সেই চাহিদা পূরণ করতে ব্যর্থ হওয়ায় ক্রেতারা আমাদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন।'
১৯৮০-এর দশকে বাংলাদেশের কার্পেট চীন, হাঙ্গেরি ও রাশিয়ায় রপ্তানি হতো। তখন বিনিময় প্রথার মাধ্যমে এক দেশের পণ্যের বিনিময়ে অন্য দেশের পণ্য আনা যেত।
শাহেদুল বর্তমানে বেঙ্গল ব্রেইডেড রাগ লিমিটেডের পরিচালক। তিনি জানালেন, দেশের এসব কার্পেট বানাতে পুরনো ও সেকেন্ড হ্যান্ড মেশিন ব্যবহৃত হতো। নতুন ডিজাইন উদ্ভাবনের দিকেও কর্তাব্যক্তিদের মনোযোগ ছিল না। ফলে বাজার হারানোয় ১৯৯৫ থেকে ১৯৯৬ সালের মধ্যে সবগুলো কোম্পানি তাদের ব্যবসা গুটিয়ে নিয়ে উৎপাদন কার্যক্রম বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়।
সাতটি কার্পেট উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বাগদাদ-ঢাকা কার্পেট ফ্যাক্টরি, আমিন কার্পেট এবং কর্ণফুলী ফোরাত কার্পেট ফ্যাক্টরি- এই তিনটি বাংলাদেশ জুট মিলস কর্পোরেশনের (বিজেএমসি) অধীনে কাজ করত।
গবেষকদের মতে, দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার ফলে এই প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ হয়ে গেছে।
শাহেদুল আরও বলেন, 'সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো দেশি জিনিসের পরিবর্তে বিদেশি পণ্য ব্যবহারেরই বেশি আগ্রহী ছিল। কিন্তু তারা চাইলেই তখন আমাদের দেশীয় কার্পেট কিনতে পারত এবং তাতে আমাদের ব্যবসাটাও টিকে থাকত। সরকার যদি আমাদের শিল্পকে উৎসাহ না দেয়, তাহলে জনগণই বা কেন কিনবে আমাদের কাছ থেকে?'
বিজেএমসির অধীনে থাকা ফ্যাক্টরিগুলো বন্ধ হয়ে যাবার এক দশক পর সরকার আবার সেগুলো চালু করার চেষ্টা চালালেও সফল হয়নি। বর্তমানে হস্তশিল্পের সঙ্গে যুক্ত কিছু প্রতিষ্ঠান কটন ও সিনথেটিক তন্তু থেকে কার্পেট তৈরি করছে, যদিও তা খুবই স্বল্প পরিসরে।
চীন, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইরান, কানাডা, ফ্রান্স, স্পেন, বেলজিয়াম ও ভারত থেকে আসা পণ্য এখন দেশীয় চাহিদা মেটাচ্ছে।
কয়েকজন ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এখনো দেশীয় কার্পেটের দাম কমিয়ে বাজারজাত করলে তাতে হয়তো আবার ক্রেতারা আকৃষ্ট হবেন।
আমদানিকারকদের সূত্রানুযায়ী, তাদের বার্ষিক বিক্রির পরিমাণ ১০০-১৫০ কোটি টাকা। ঢাকায় ২০০-২৫০টি দোকানে গৃহসজ্জা পণ্য বিক্রি হয়। এলিফ্যান্ট রোড, পল্টন ও বায়তুল মোকাররমে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক বড় দোকান রয়েছে।
আমিরুল ইসলাম মিঠু নামে একজন বৃহৎ আমদানিকারকের মতে, দেশীয় চাহিদা এই শিল্পকে টেকসই রাখতে যথেষ্ট নয়। 'এটা একটা বিলাস পণ্য। দামও অনেক বেশি। বাংলাদেশের মতো গরম দেশের চেয়ে শীতপ্রধান দেশে কার্পেটের চাহিদা বেশি। এসব কারণেই কোনো দেশীয় কোম্পানি এই শিল্পের উৎপাদনে আগ্রহ দেখায় না,' বলেন তিনি।
তবে অন্য আমদানিকারকেরা অবশ্য বলছেন, আগে শুধুমাত্র ধনী ব্যক্তিরা কার্পেট কিনলেও এখন মধ্যবিত্ত শ্রেণিও তাদের ঘরের সৌন্দর্য্য বর্ধনে এ পণ্য ব্যবহার করছেন। সাধারণ মানুষের মধ্যে এই সৌন্দর্য্যবোধ জেগে ওঠাকে তারা নিজেদের জন্য আশীর্বাদই মনে করছেন।
কিন্তু মহামারির করাল গ্রাস থেকে বাঁচতে পারেনি কার্পেট শিল্পও। করোনার ক্ষতি পোষাতে ব্যস্ত এখন এই শিল্প মালিকেরাও।
রাজধানীর এলিফ্যান্ট রোডের একটি দোকানের ম্যানেজার সিরাজ হোসেনের কথাতেও করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার প্রতিধ্বনিই পাওয়া গেল। জানালেন ব্যবসায় চলমান মন্দার কথা, 'করোনার এ সময়ে আজকাল ধনী ব্যক্তিরাও কার্পেটের মতো বিলাসদ্রব্য কিনতে গেলে দুবার ভাবেন। বেচাকেনা পড়ে যাওয়ার ফলে আমরা নিজেদের পরিবারের খরচ সামলাতেই হিমশিম খাচ্ছি।'
পল্টনের আরেকটি দোকানের ম্যানেজার রবিউল ইসলামের থেকে জানা যায়, তারা ধীরে ধীরে মহামারির সময়ে হওয়া ক্ষতির ৭০ শতাংশ পুষিয়ে উঠতে সক্ষম হয়েছেন।
তবে জুট বা পাট থেকে কার্পেট তৈরি করছেন যারা, তাদের অবস্থা শোচনীয়। এসব উদ্যোক্তা ব্যবসা টিকিয়ে রাখতেই হিমশিম খাচ্ছেন। কারণ পাটের তৈরি কার্পেট বেশিদিন টেকে না, আবার দামও অন্য কার্পেটের চেয়ে তুলনামূলকভাবে বেশি। পাটের বিপরীতে সিনথেটিক তন্তুতে তৈরি কার্পেট এখন বাজারে শক্ত জায়গা করে নিয়েছে।