বিশ্বে এত গাড়ির কী দরকার!
নতুন পরিকল্পনা অনুযায়ী আন্তর্জাতিক গাড়িনির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলো উৎপাদন কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অটোনির্মাতাদের এই সিদ্ধান্তের ফলে আগামী কয়েক মাসের মধ্যে বিশ্ববাজারে গাড়ির ঘাটতি প্রায় কয়েক লাখে গিয়ে পৌঁছাবে। তবে, নতুন এই সিদ্ধান্ত আসলেও কতটুকু উদ্বেগজনক?
মহামারির আগে বৈশ্বিক গাড়ির বাজারে চাহিদার তুলনায় সরবরাহ ছিল বেশি। বিক্রি কমে যাওয়ায় ঝুঁকির মুখে পড়ে অটোমোবাইল শিল্পখাত। আর তাই উৎপাদন হ্রাসের নতুন এই সিদ্ধান্ত বাণিজ্যিক গাড়িনির্মাণ খাতের ভারসাম্য ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
এ মাসে চলতি বছরের উৎপাদন পরিকল্পনা নতুন করে সাজিয়েছে বিশ্বের বৃহত্তম গাড়িনির্মাতা প্রতিষ্ঠান টয়োটা মোটর করপোরেশন। অন্যান্য জাপানিজ গাড়ি প্রস্তুতকারকদের মধ্যে নিসান মোটর করপোরেশন এবং হোন্ডা মোটর করপোরেশনও একই পদক্ষেপ নিয়েছে। নতুন পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানগুলো মোট ১০ লাখের বেশি গাড়ির উৎপাদন কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
১৯৫৬ সালের পর চলতি বছরের জুলাইয়ে যুক্তরাজ্যে প্রথমবারের মতো গাড়ি উৎপাদন সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে এসেছে।
অন্যদিকে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আগস্টের শেষ নাগাদ গাড়ির সরবরাহ গত বছরের তুলনায় ৫০ শতাংশ কমেছে। ২০১৯ সালের তুলনায় সরবরাহ কমেছে ৭০ শতাংশ। বছরের শেষ ছয় মাসে উত্তর আমেরিকায় সাড়ে চার লাখের বেশি গাড়ির উৎপাদন কমবে। সারা বছরের হিসাবে নির্মিত হবে না প্রায় ১৫ লাখ ইউনিট গাড়ি।
কারখানায় হুট করে এত বিপুল সংখ্যক গাড়ির উৎপাদন কমে যাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। তবে, মহামারি আঘাত না হানলেও এরকমই কিছু হতো বলে ধারণা বিশ্লেষকদের।
'পিক কার' তত্ত্বানুসারে বাজারে গাড়ির চাহিদা এক সময় সর্বোচ্চ পর্যায়ে গিয়ে থেমে যায়। তাত্ত্বিক বিষয় হলেও এই প্রেক্ষাপটে গাড়ির সংখ্যা কমে যাওয়া অস্বাভাবিক ঘটনা নয়। বরং একে 'নতুন স্বাভাবিক' বলে মেনে নেওয়া চলে।
কোভিড-১৯ মহামারির পূর্বে গাড়ির বাজার কেমন ছিল তা দেখা যাক। বাজারে গাড়ির সরবরাহ ছিল প্রচুর। ক্রেতাদের আকৃষ্ট করতে শোরুমগুলো বিভিন্ন অফার, মূল্য হ্রাস সুবিধা দিয়ে আসছিল। এরসঙ্গে নিত্যনতুন প্রযুক্তি ও ফিচার যুক্ত করে চলত ক্রেতাদের আকর্ষণের চেষ্টা। কার্বন নিঃসরণ কমাতে অটোমেকারদের ওপর আরোপিত বিধিমালাও দিনদিন কঠোর হয়ে ওঠে। প্রযুক্তিগত ও বাণিজ্যিক উভয় কারণেই বাড়তে থাকে গাড়ির দাম।
২০২০ সালের শুরুতে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ অটোমোটিভ গাড়ির পার্টস সরবরাহকারী রবার্ট বোস জিএমবিএইচের সিইও ভকমার ডেনার বলেন, "আমরা সম্ভবত গাড়ি উৎপাদনের সর্বোচ্চ পর্যায় অতিক্রম করেছি।" প্রতিষ্ঠানটি তাদের মুনাফা সংকোচন এবং কর্মী ছাঁটাইয়ের ঘোষণা দেয়। টানা তৃতীয় বছরের মতো চাহিদা কমায় বৈশ্বিক গাড়ি উৎপাদন কমবে বলে ধারণা করা হয়েছিল। ২০২০ সালেও তা একইরকম ছিল।
একইসময় গাড়ি নির্মাতাদের মুনাফাও কমে আসে। খরচ নিয়ন্ত্রণ করাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু তা সত্ত্বেও উৎপাদন অব্যাহত থাকে। গাড়ি নির্মাতারা এই সমস্যা থেকে বের হয়ে আসার অন্য কোনো সমাধান দেখতে পারছিলেন না।
বৈশ্বিক অটো খাতের এই বেহাল দশা সম্পর্কে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলও (আইএমএফ) সতর্কতা জারি করে।
২০১৯ সালের অক্টোবরে প্রকাশিত ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুক প্রতিবেদনে সংস্থাটি জানায়, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পণ্যোৎপাদনের ৫ দশমিক ৭ শতাংশ দখল করে রয়েছে অটো খাত। অন্যদিকে, পণ্য রপ্তানির ৮ শতাংশই অটো খাতকেন্দ্রিক। আর তাই বৃহৎ পরিসরে অটো খাতের উৎপাদন হ্রাসের ঘটনায় বৈশ্বিক অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের আশঙ্কাও দেখা দেয়। কিন্তু, প্রতিষ্ঠানগুলো যা করে আসছে, তা করতে থাকলেও বিপর্যয় এড়ানো সম্ভব হতো না।
করোনা প্রাদুর্ভাবের ফলে যন্ত্রাংশ সরবরাহ কমে যাওয়ার পাশাপাশি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বন্ধ হওয়ায় অটোনির্মাতারা উৎপাদন কমাতে একরকম বাধ্য হচ্ছেন। একদিক থেকে বিষয়টি ভালো। বায়ুদূষণ হ্রাসের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে এত বেশি গাড়ির কি আদৌ কোনো প্রয়োজন রয়েছে?
অন্যদিকে, উৎপাদন খরচের পাশাপাশি গাড়ির দামও হুহু করে বাড়ছে। উৎপাদন কমে গেলে কিছু ক্রেতা অবশ্যই নিরাশ হবেন। প্রতিষ্ঠানগুলোও হয়তো যে পরিমাণ মুনাফার মুখ দেখত, তা আর দেখতে পারবে না।
কিন্তু, এই পরিস্থিতি থেকে ব্যবসায়িক মডেল নিয়ে আমরা পুনরায় গভীরভাবে চিন্তা করার সুযোগ পাব। গাড়িনির্মাতাদের ঝুঁকিও এখন কমবে। প্রতিষ্ঠানগুলো এখন আরও এক ধাপ এগিয়ে গ্যাসচালিত গাড়ির পরিবর্তে ইলেকট্রিক গাড়ি নির্মাণে মনোযোগ দিতে পারবে। অজস্র গাড়ির পরিবর্তে তারা পরিবেশবান্ধব উন্নত কিছু সংখ্যক গাড়ি বানানোর কথা চিন্তা করতে পারে।
কিন্তু, চাহিদা ও বর্তমান অবস্থা অনুধাবন করতে ব্যর্থ হয়ে গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলো যদি ফের আগের ব্যবসায়িক মডেলে ফিরে গিয়ে গণহারে গাড়ি উৎপাদন শুরু করে, তাহলে দিনশেষে তা প্রতিষ্ঠানগুলোর আরও বেশি ক্ষতির কারণ হয়েই দাঁড়াবে।
- সূত্র: ব্লুমবার্গ
- অঞ্জনী ত্রিবেদী ব্লুমবার্গের মতামত কলামিস্ট। তিনি এশিয়ান শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো নিয়ে প্রতিবেদন লিখে থাকেন। পূর্বে তিনি ওয়াল স্ট্রিট জার্নালে কাজ করতেন।