বৈশ্বিক জ্বালানি সংকটের নেপথ্যের ভূরাজনীতি
চলতি মাসে বিশ্বব্যাপী জ্বালানি উৎস রূপান্তরের প্রক্রিয়ায় বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে। অবশ্য এ দশা তো হওয়ারই ছিল। কেন? সেই ঘটনাগুলোই এখানে তুলে ধরা যাক।
যেমন, পর্যবেক্ষক, বাজার বিশেষজ্ঞ ও অর্থনীতির নিবিড় পাঠকরা জানেন, গত কয়েক সপ্তাহ ধরে ঘুমের ঘোরে হাঁটার মতোই জ্বালানি স্বল্পতার বিপর্যয়ের খাদে পা দিয়েছে বিশ্ব। আগস্টের নিম্ন দর থেকে অপরিশোধিত জ্বালানির প্রধান সূচকগুলোতে ব্যারেলপ্রতি মূল্য এখন ২৫ শতাংশ বেশি। এশিয়ায় সর্বকালের সর্বোচ্চ অবস্থানে পৌঁছানোর পথে প্রাকৃতিক গ্যাসের দর। মহাদেশটির বিশাল সব তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর জন্য কয়লার অভাবও এজন্য দায়ী। ফলে কমাতে হয়েছে বিদ্যুৎ উৎপাদন, অনেক এলাকা যে কারণে থেকে থেকেই লোডশেডিংয়ের কবলে পড়ে।
বিদ্যুৎ ঘাটতির প্রতিক্রিয়ায় অনেক কারখানায় উৎপাদন কাজ বন্ধ রাখতে হয়, উৎপাদনের গতি হারায় সচল কারখানাগুলো। ফলে ভোগ্যপণ্য ও কাঁচামালের বৈশ্বিক স্বল্পতাও আরো তীব্র হয়। এমনই একটি গুরুত্বপূর্ণ কাঁচামাল হলো প্রক্রিয়াজাত সিলিকন, যা সোলার প্যানেল তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। রুঢ় বাস্তবতা হলো—আমাদের অসম্পূর্ণ, নিষ্ফল জ্বালানি উৎস রূপান্তর নীতির ফসল হিসেবেই চীনে দেখা দিয়েছে কয়লার অভাব, যুক্তরাষ্ট্রে সৌরকোষের দাম বৃদ্ধি করছে।
জ্বালানি বিপর্যয়ের জন্য বহু অনুঘটক দায়ী। চলমান মহামারিতে বিশ্ব বাণিজ্যে পণ্য, জ্বালানি, কাঁচামাল—সবকিছুর পরিবহন শৃঙ্খল ব্যাহত হয়েছে। সরবরাহ চক্রে সমস্যার কারণে কারখানা পর্যায়ে পণ্য উৎপাদনও কমে আসে। উৎপাদনের পর ভোক্তার কাছে পৌঁছে দিতেও ভোগান্তির শেষ নেই। জ্বালানি সংকটের পেছনেও যা অন্যতম প্রধান কারণ।
কিন্তু এই সংকটকে আরো তীব্র করেছে নির্বোধ ভূরাজনৈতিক সিদ্ধান্ত এবং সুচিন্তিত পরিকল্পনার অভাব। বিশ্ব অর্থনীতির বিশাল পরিসরের অন্যান্য ত্রুটির মতোই, এই ছিদ্রও ইঙ্গিত দিচ্ছে যে পৃথিবী নতুন ব্যবস্থার পথে পা বাড়াতে চলেছে। গত বিশ্ব মন্দা থেকে ১২ বছর ধরে উত্তরণ ও প্রবৃদ্ধি ভোগ করার সময় সরকারগুলোর বাজেট ঘাটতি ছিল আঁটসাঁট। সে যুগে কম চাহিদাই ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সমস্যা। কিন্তু এবার আমরা কম সরবরাহের উল্টো দুনিয়ায় পা রেখেছি।
এই বাস্তবতায় বর্তমানে বিশ্বের প্রধান চারটি জ্বালানি উৎস এবং তারা কীভাবে একে অপরকে নতুন বিপদে ঠেলে দিচ্ছে সে দিকটি তুলে ধরা প্রয়োজন।
গ্যাস:
সবার আগেই আসা যাক প্রাকৃতিক গ্যাসের কথায়, যা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র, ঘর উষ্ণ রাখা ও রান্নার জ্বালানি। এখানে গুরুত্বপূর্ণ কিছু ঘটনা ঘটছে। প্রথমত, মার্কিন উৎপাদকরা মহামারিপূর্ব সময়ের মতো বিপুল উৎপাদন করতে পারছেন না। দ্বিতীয়ত, বিগত বেশ কয়েক বছর ধরে গ্যাসকে তরলীকৃত করে সমুদ্রেপথে বাণিজ্যের উদ্যোগ নিয়েছে উত্তোলনকারী দেশগুলো। ফলে পাইপলাইনের পয়েন্ট টু পয়েন্ট পাইপলাইনের বিপত্তি এড়িয়ে দূর দেশে বিক্রি হচ্ছে এলএনজি।
কিন্তু এলএনজির চাহিদার প্রতি অতি-নির্ভরশীল হতে থাকে ইউরোপ ও এশিয়া। একই জ্বালানি উৎস থেকে প্রাপ্তির ওপর নির্ভরতা বাড়ায় তাদের সমান্তরাল চাহিদা। ইতিহাসে এই প্রথমবারের মতো বিশ্ব উপলদ্ধি করছে, বৈশ্বিক তেল বাজারের মতো প্রাকৃতিক গ্যাসেরও একটা প্রকৃত বাজার ব্যবস্থা আছে, যা চাহিদা ও জোগানের সুষম অবস্থানের ওপর নির্ভরশীল।
সাধারণত বাজার বড় হলে ভোক্তা পর্যায়ে মূল্য কমে। কিন্তু প্রাকৃতিক গ্যাসের চাহিদা এখন অস্বাভাবিক বেশি। এই চাহিদার ফলে গ্যাস হয়ে উঠেছে অত্যন্ত দামি।
ইউরোপে গ্যাসের ক্রমশ চড়া মূল্যের প্রধান কারণ রাশিয়া। মস্কো ইউক্রেনের মধ্যে দিয়ে যাওয়া পাইপলাইনে গ্যাস সরবরাহ কমানোর সিদ্ধান্ত নেওয়ায় পুরো মহাদেশ পড়ে বিপাকে। আসলে ইউরোপীয় ইউনিয়নকে সম্পর্কোন্নয়ন করতেই চাপ দিচ্ছে মস্কো। আর চাইছে নর্ড স্ট্রিম-২ পাইপলাইনে জোটটির অনুমোদন জিততে। এর মাধ্যমে ইউক্রেনকে এড়িয়ে সরাসরি ইউরোপে গ্যাস রপ্তানি করতে পারবে রুশ সরকার।
রাশিয়ার এ নীতিতে চাপে আছে প্রাকৃতিক গ্যাসের আরেক বড় উৎপাদক যুক্তরাষ্ট্র। অচিরেই হয়তো মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদ (কংগ্রেস) ভূশিলাস্তর থেকে গ্যাস উত্তোলকদের সহায়তা বৃদ্ধি করবে। সরকারি সহায়তায় শিলাস্তরে আটকে থাকা বাড়তি মিথেন মুক্ত করবে কোম্পানিগুলো, তবে একসময় এ প্রক্রিয়ায় যত গ্যাস পাওয়া যেত, এখন আর ততটা পাওয়া যাবে না।
কয়লা:
বিদ্যুৎ উৎপাদনই কয়লার গুরুত্বের প্রধান কারণ। বিশ্বব্যাপী কয়লাভিত্তিক কেন্দ্রগুলো অন্য যেকোনো জ্বালানিচালিত কেন্দ্রের চেয়ে বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে। চীন ও ভারতের মতো বিশ্বের প্রধান দুই জনবহুল দেশের বৈদ্যুতিক গ্রিডে সিংহভাগ বিদ্যুতের জোগান দেয় এই কয়লাই দেয়।
কয়লাকেও স্পর্শ করেছে আন্তর্জাতিক রাজনীতি। বিশ্ববাজারে এ জ্বালানির অন্যতম বড় সরবরাহকারী অস্ট্রেলিয়া, আর সবচেয়ে বড় ভোক্তা চীন। গত বছর অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী চীনের বিরুদ্ধে করোনাভাইরাসের উৎস অনুসন্ধানের উদ্দেশ্যে পরিচালিত এক তদন্তে বাধা দেওয়ার অভিযোগ তোলেন।
ক্ষুদ্ধ চীন অস্ট্রেলিয়া থেকে কয়লা কেনাই বন্ধ করে দেয়। কিন্তু হারানো সরবরাহ মেটাতে ইউরোপ ও এশিয়ার অন্য দেশ থেকে কেনা শুরু করে। কিন্তু চীনের কেনাকাটায় ওইসব অঞ্চলের নিজস্ব কয়লা পুড়িয়ে শক্তি উৎপাদনের সক্ষমতা কমে যায়। ফলে ভারতের মতো আরেক বৃহৎ কয়লা উৎপাদনকারী দেশের বিদ্যুৎকেন্দ্রে এখন মাত্র দুই-তিন দিনের মজুদ থাকার কথা জানানো হচ্ছে। অথচ আগে এ মজুদ অন্তত দুই সপ্তাহের থাকত।
জ্বালানি তেল:
জীবাশ্ম জ্বালানি তেলের প্রধান ব্যবহার পরিবহন খাতে। কিন্তু অন্যান্য শিল্প প্রক্রিয়াতেও এটি গুরুত্বপূর্ণ। আংশিক হলেও বিশ্বের অনেকখানি বিদ্যুৎ-চাহিদা তেল পুড়িয়ে মেটানো হয়। জরুরি প্রয়োজনে এমন ব্যবহার আরো বাড়ে।
সেই তেলের বাজার এবার পড়েছে সরবরাহ স্বল্পতা ও উচ্চ চাহিদার মাঝখানে। কারণ, টিকাদানের সফলতার কারণে ইউরোপে ভোক্তা চাহিদা মহামারির আগের সময়ে ফিরেছে। আটলান্টিকের অপর পাড়ে মার্কিনীরাও গাঁটের পয়সা খরচে আবারও উদারহস্ত হচ্ছে। বাড়ছে তাদের বিমান ও গাড়িতে ভ্রমণ। এভাবে চাহিদা বাড়ায় দরবৃদ্ধি ঘটাই ছিল স্বাভাবিক।
সৌদি আরবের রাষ্ট্রায়ত্ত জ্বালানি কোম্পানি আরামকো সম্প্রতি স্বীকার করেছে যে, উচ্চমূল্যের কারণে অনেক গ্যাস উৎপাদক গ্রিড তেল উত্তোলনে রূপান্তরিত হয়েছে। গ্যাস থেকে তেল উত্তোলনে ঝুঁকে পড়ার এ ঘটনা ইঙ্গিত দেয় যে, বিশ্ব ওপেকের পরিকল্পিত সরবরাহ বৃদ্ধির চাইতেও বেশি পরিমাণে তেল কিনছে। অথচ চাহিদা বাড়লেও বাজারে নিজ নিয়ন্ত্রণের জানান দিয়ে ওপেক বলেছে, তারা পূর্বঘোষিত উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা আর বাড়াবে না।
এ পর্যন্ত নবায়নযোগ্য শক্তির উৎসগুলো ইউরোপ ছাড়া অন্যান্য দেশে এসব ঝামেলার বাইরে আছে। বিশ্বের অধিকাংশ দেশে প্রাকৃতিক গ্যাসের শূন্যতার চাহিদা পূরণে এগিয়ে আসছে নবায়নযোগ্য শক্তির উৎস। তবে চাহিদার তুলনায় পর্যাপ্ত যোগান নেই। ইউরোপ তার ব্যতিক্রম, মহাদেশটির ১৩ শতাংশ বিদ্যুৎ চাহিদা পূরণ করছে বায়ুশক্তি। কিন্তু চলতি বছর উপকূলীয় অঞ্চলে বাতাসের গতি স্তিমিত থাকায় উৎপাদন কমে গেছে। যা আরো বাজে রূপ দিচ্ছে গ্যাসের মরিয়া চাহিদাকে।
মনে রাখা দরকার, আজকের এ মুহূর্ত শুধু আমাদের জ্বালানি উৎস পরিবর্তন নীতির নয়, বরং অর্থনৈতিক চক্রেরও ত্রুটির ফসল। কোভিড-পরবর্তী অর্থনৈতিক কাঠামোয় টিকে থাকার চেষ্টা করছে অধিকাংশ জীবাশ্ম জ্বালানি উৎপাদক। অর্থাৎ এটাই তাদের সবচেয়ে সুসময়।
শিলাস্তর থেকে ফ্র্যাকিংয়ের মাধ্যমে তেল-গ্যাস উৎপাদক মার্কিন কোম্পানিগুলোও তার ফলে নিজেদের লাভজনক ব্যবসা হিসেবে জাহির করার সুযোগ পেয়েছে। কিন্তু ওপেক চাইছে ধীরে ধীরে সরবরাহ বাড়িয়ে সবাইকে প্রচলিত জ্বালানির অভাব হাড়ে হাড়ে বুঝিয়ে দিতে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এ খাতে বিনিয়োগ কমে আসাটাই এমন সিদ্ধান্তের পেছনে বড় ভূমিকা রেখেছে।
অন্যদিকে, রাশিয়া চাইছে দুলকি চালে সরবরাহ বাড়িয়ে ইউরোপের স্নায়ু দুর্বল করতে। রাশিয়ার গ্যাসের চাহিদা সবাইকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখানোই উদ্দেশ্য ভ্লাদিমির পুতিনের।
- সূত্র: দ্য আটলান্টিক থেকে অনূদিত