ব্যবসায়ীদের মধ্যে ভোক্তা ঠকানোর প্রবণতা বাড়ছেই
বিভিন্ন খাতের ব্যবসায়ীদের প্রতিনিয়ত নিয়মের মধ্যে আনার চেষ্টা করলেও এক দশকে খুব একটা সুবিধা করতে পারেনি জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর।
ব্যবসায়ীদের মধ্যে ভোক্তা ঠকানোর প্রবণতা বেড়েই চলছে। ফলে কেনাকাটা ও সেবা গ্রহণের ক্ষেত্রে ভোক্তার অধিকার কতটা রক্ষিত হচ্ছে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে ভোক্তাদের মধ্যে।
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের বাজার অভিযান, ভোক্তার অভিযোগসহ বিভিন্ন তথ্য পর্যালোচনা করে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, সারাদেশের বিভাগ, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের নিয়মিত বাজার মনিটরিং ও অভিযান পরিচালনা করছে প্রতিষ্ঠানটি। এতে প্রতিনিয়তই অপরাধ ধরা পড়ার পরিমাণ বাড়ছে। পণ্য ও সেবার মূল্য তালিকা প্রদর্শন না করা, নির্ধারিত মূল্যের বেশি নেয়া, ভেজাল পণ্য বিক্রি ও পণ্যের মোড়ক ব্যবহার না করে ব্যবসায়ীরা এখনো ভোক্তাদের ঠকিয়ে যাচ্ছে।
যদিও ব্যবসায়ীদের কাছে নিয়মিত প্রতারণার শিকার হলেও ভোক্তারা খুব যে বেশি আইনের সাহায্য নিচ্ছে তার প্রমাণ পাওয়া যায় না। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সেবা ও কেনাকাটায় ঠকার পর এখনো বেশিরভাগ মানুষই ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের কাছে বিচার চাইতে আসেন না।
ভোক্তার অধিকার নিয়ে কাজ করা কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) ভাইস প্রেসিডেন্ট এসএম নাজের হোসাইন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'অভিযানের পরিমাণ যত বাড়ছে, অপরাধীও ধরা পড়ছে তত বেশি। তার মানে শাস্তি দেয়ার পরও ব্যবসায়ীদের মধ্যে খুব একটা সচেতনতা বা পরিবর্তন আসেছে বলে মনে হচ্ছে না'।
তিনি বলেন, 'সর্বশেষ দুইবার ভারত সরকার পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করার পর দেশে কি পরিস্থিতি হয়েছিল তা সবারই জানা। চালের বাজার নিয়ে ব্যবসায়ীরা এখন ভোক্তাদের ঠকাচ্ছে। তারও কোন প্রতিকার হচ্ছে না। এ থেকেই পরিবর্তনটা বুঝা যায়'।
ভোক্তার অধিকার অক্ষুন্ন রাখার লক্ষ্য নিয়ে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর তাদের কার্যক্রম শুরু করেছিল ২০০৯ সালে। এরপর থেকে প্রতিষ্ঠানটি ধারাবাহিকভাবেই বাজারে তদারকি অভিযান বৃদ্ধি করে। ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে গ্রাহকের সংশ্লিষ্টতার পরিমাণ।
জানা গেছে, এক দশকে সেবা ও কেনাকাটায় প্রতারণার শিকার হয়ে প্রায় ৪০ হাজার মানুষ আইনের আশ্রয় নিয়েছে। এর ৯৫ শতাংশই গত পাঁচ বছরে। তবে মানুষের বিচার চাওয়ার এই সংখ্যাটা খুবই কম বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। কারণ বাজার অভিযানে অপরাধী ব্যবসায়ীদের ধরা পড়ার চিত্র প্রতিনিয়তই বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই সময়ে মোট ৯৭৩০৯ টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে শাস্তির আওতায় আনা হয়েছে।
অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, এই ব্যবসায়ীদের শাস্তি পাওয়ার পরিসংখ্যানটা গত ৪ বছরে দ্রুত গতিতে বাড়ছে। এর মধ্যে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৯৩০৬টি প্রতিষ্ঠান শাস্তি পেয়েছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে শাস্তি পাওয়া ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ২২২৪৪টিতে দাড়িয়েছে। অর্থাৎ চার বছরে এই পরিমাণ দ্বিগুণেরও বেশি।
এই অবস্থার মধ্যে 'মুজিববর্ষে শপথ করি, প্লাষ্টিক দূষণ রোধ করি' স্লোগান সামনে রেখে আজ বিশ্ব ভোক্তা অধিকার দিবস উৎযাপন করছে সরকার। বাংলাদেশসহ বিশ্বের ১২০টি দেশ এই দিবসটি উদযাপন করছে। কনজ্যুমার্স ইন্টারন্যাশনাল নামের সংগঠনের উদ্যোগে ১৯৮৩ সাল থেকে প্রতি বছর ১৫ মার্চ বিশ্ব ভোক্তা অধিকার দিবস পালিত হয়ে আসছে।
ব্যবসায়ীদের মধ্যে অপরাধের প্রবণতা বৃদ্ধির কারণ জানতে চাইলে বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি মো. হেলাল উদ্দিন টিবিএসকে বলেন, 'এমন কোনো পেশা নাই, যেখানে দু-চারজন খারাপ ব্যবসায়ী নাই। তাদের জন্য আইন আছে, সাজার ব্যবস্থা আছে। যারা অপরাধ করছে তারা সাজা পাচ্ছে।'
তবে তিনি দাবি করেন, এখনো ব্যবসায়ীরা অনেক ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের মানবিক দিক বিবেচনা করে দাম বাড়ায় না।
দুই দফা পেঁয়াজের দাম বৃদ্ধির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'যখন পণ্য নিয়ে বিভিন্ন সংকট তৈরি হয় তখন বাজারে অধিদপ্তর খুব একটা কার্যকরী ভুমিকা রাখতে পারে না। যে কারণে ব্যবসায়ীদের মধ্যেও অপরাধ করার সাহস আসে'।
ক্যাবের ভাইস প্রেসিডেন্ট এসএম নাজের হোসাইন বলেন, 'আমরা বিভিন্ন জায়গায় যে হারে ক্যাম্পেইন করেছি, তাতে আরও বেশি মানুষের সংশ্লিষ্টতা আশা করেছিলাম। মানুষ সচেতন হলেই কেবল তার সমস্যার প্রতিকার পাবে। যদি সচেতন না হয়, তাহলে অপরাধ বাড়বেই'।
অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেলে অভিযোগকারীকে জরিমানার ২৫ শতাংশ অর্থ নগদ প্রদান করে অধিদপ্তর। তাতেও মানুষের অংশগ্রহণ এত কম কেন জানতে চাইলে অধিদপ্তরের ঢাকা বিভাগীয় কার্যালয়ের উপপরিচালক মন্জুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার টিবিএসকে বলেন, 'আমরা ভোক্তা ও ব্যবসায়ীদের সমান তালে সচেতন করছি তাদের দায়িত্ব ও অধিকারের বিষয়ে। তারপরও ভোক্তারা যদি অভিযোগ নিয়ে না আসে তাহলে আমাদের কাজের গতি আরও বাড়াতে হবে'।
এদিকে বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে যদি বাংলাদেশের ভোক্তাস্বার্থ বাস্তবায়নের দিক বিবেচনা করা হয়, তার অবস্থান কোথায় এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, 'হঠাৎ করেই কোনো ব্যবসায়ী গোষ্ঠী যদি কারসাজির চেষ্টা করে পদক্ষেপ গ্রহণ করে আমরা কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করি। আমাদের দ্রুত বাজার নিয়ন্ত্রণের সক্ষমতা রয়েছে। বাজারে অভিযানের পরিমাণ কয়েকগুণ বেড়েছে'।
টিবিএস কথা বলেছে বেশ কিছু ভোক্তার সঙ্গে। তারা কোথাও প্রতারিত হলে অধিদপ্তরে যান কিনা জানতে চাইলে ঝিগাতলার বাসিন্দা শরিফুল ইসলাম টিবিএসকে বলেন, 'দেশে পেঁয়াজ, লবন, আলু ও ভোজ্য তেলের দাম বিনা কারনে লাগামহীন হয়ে যায়, তখন ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তরের কোনো কার্যকরী ভূমিকা পালন করতে দেখা যায়না। তাদের কাছে একটি ছোট কারণে বিচার নিয়ে যেতে ইচ্ছে করে না'।
রামপুরার এক ভোক্তা মোহাম্মদ আল-আমীন টিবিএসকে বলেন, 'অনেক সময় ছোটখাট কারণে ব্যবসায়ীর প্রতারণার শিকার হলেও বিচার চাইতে যাওয়ায় আগ্রহ হয় না। যদিও বিচারে জিতলে প্রতিষ্ঠানটি টাকাও দেয়'।