ভোক্তারা খুবই অসহিষ্ণু, অল্পতে ধৈর্য হারিয়ে ফেলেন: এএইচএম সফিকুজ্জামান
দেশের ভোক্তা শ্রেণী কোনো একটা ঘটনার বিস্তারিত না জেনেই অসহিষ্ণু আচরণ করেন এবং অল্পতেই ধৈর্য হারিয়ে ফেলেন। যে কারণে কিছু প্রতিষ্ঠানকে অপরাধ না করেও বিব্রতকর পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হচ্ছে বলে মনে করছেন ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এএইচএম সফিকুজ্জামান।
সম্প্রতি সুলতান'স ডাইনের ঘটনা প্রসঙ্গে এএইচএম সফিকুজ্জামান বলেন, "আমরা জাতিগতভাবেই একটু বেশি রিঅ্যাক্টিভ, যে কোন বিষয়ে আমরা বেশি রি-অ্যাকশন দেখাই। প্রকৃত ঘটনা কিন্তু ভিন্ন হতেও পারে। কিন্তু বিষয়টা হলো ঘটনা প্রমাণের আগেই আমরা একটা ট্রায়াল দিয়ে দিচ্ছি। যেমনটা মিডিয়া যখন কিছু করে সেটাকে মিডিয়া ট্রায়াল বলে, এখন যা হলো তা সোশ্যাল মিডিয়া ট্রায়াল।"
"ভোক্তাদের বিহেভিরিয়াল প্যাটার্নের কারণে প্রতি বছরই কিন্তু রোজার আগে প্যানিক তৈরি হয়, যেটা সবসময়েই আমাদের ক্ষতি করে। রোজার আগে কয়েকটি পণ্যের ডিমান্ড বেড়ে যায়। যে অনুযায়ী পণ্যের যোগানও থাকে পর্যাপ্ত। কিন্তু সবাই যখন অতিরিক্ত কেনাকাটা শুরু করে, তখন বিক্রেতারা সুযোগটা নেন, ক্ষতি হয় ভোক্তার।"
ভোক্তাদের এই অবস্থার মধ্যেই অন্যান্য বছরের মতো এবারও সারাদেশে ভোক্তার অধিকারের বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে ১৫ মার্চ বিশ্ব ভোক্তা অধিকার দিবস পালন হচ্ছে। এবারের প্রতিপাদ্য 'নিরাপদ জ্বালানি, ভোক্তাবান্ধব পৃথিবী'।
তবে ভোক্তারা যে তাদের অধিকারের বিষয়ে আগের চেয়ে বেশি সচেতন সে কথাও টিবিএসকে জানালেন এএইচএম সফিকুজ্জামান। তিনি বলেন, "অনেক বিষয়ে এখন আর ভোক্তাদের অভিযোগ করতে হচ্ছে না, কারণ যেখানে সমস্যা হচ্ছে সেখানেই সেটার সমাধান হচ্ছে। যখন কোন দোকানে গিয়ে ভোক্তার অধিকার ক্ষুণ্ণ হচ্ছে, তখন তারা প্রতিষ্ঠানে বলছে আমরা ভোক্তার ১৬১২১ হটলাইন নাম্বারে ফোন দিব যদি আমাদের সেবা বা পণ্য ঠিকঠাক না দেওয়া হয়। তখন অনস্পট বিষয়গুলোর সমাধান হচ্ছে। এটার কারণ কিন্তু একটাই, তারা নিজেদের অধিকার সম্বন্ধে সচেতন হচ্ছে। এটা পজিটিভ পরিবর্তন। যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তারাও কিন্তু তখন সমাধান দিচ্ছে।"
"ভোক্তাদের সচেতন করার জন্য বিশেষ করে তাদের অধিকার সম্বন্ধে জানানো হচ্ছে, যাতে করে কোন ঘটনা ঘটলে সেটার প্রতিকার তারা পায়। সে বিষয়ে অধিদপ্তর জোরালোভাবে কাজ করছে। অফিসিয়াল ফেইসবুক পেইজ, ইউটিউব চ্যানেলে যেসব অভিযানের ভিডিও দেওয়া হচ্ছে সেগুলো কিন্তু মিলিয়ন মিলিয়ন ভিউ হচ্ছে, ভোক্তারা জানছে, সচেতন হচ্ছে। অধিদপ্তরও আসলে এটাই চাচ্ছে।"
"আবার যারা অভিযোগ করবেন তাদের বিষয়গুলোও আমরা সহজ করে দিচ্ছি। আমাদের হটলাইন নাম্বারে ফোন করলে সেটাকে অভিযোগ আকারে সমন্বয়ের জন্য কাজ করা হচ্ছে। ইতোমধ্যেই আমরা সিসিএমএস অ্যাপ চালু করেছি। যেখানে সারাদেশের যেকোন জায়গা থেকেই ভোক্তারা অভিযোগ করতে পারবেন। যদিও এটা ঢাকাতে পাইলট হিসেবে চলছে। তবে সারাদেশেই এটা কার্যকরে কাজ চলছে। তখন আসলে সবাই ডিজিটালি অভিযোগ করতে পারবে, আবার সমস্ত আপডেটও পাবে তাদের মোবাইল ফোনের মাধ্যমে।
ভোক্তারা যদি সচেতন না হন, তবে পরিবর্তন আসতে সময় লাগবে বলে জানান মহাপরিচালক। তিনি বলেন, "একটা তিন-চার সদস্যের পরিবারে মাসে কিন্তু ১ কেজির বেশি লবণ লাগে না। অথচ লবণ নিয়ে যখন গুজব তৈরি হয়েছিল তখন কিন্তু সবাই ৮-১০ কেজি করে লবণ কিনতে হুমড়ি খেয়ে পড়েছিল। অথচ দেখেন যুক্তরাজ্যে এখন এক লিটার তেল, তিনটির বেশি টমেটো কেনা যাচ্ছে না একসঙ্গে। তারা কিন্তু এটা মেনে নিয়েছে, কারণ সেখানে সংকট। ভোক্তাদের এই ম্যাচিউরিটিটা দরকার।"
আবার এক শ্রেণীর ভোক্তা রয়েছে যারা বিভিন্ন উদ্দেশ্য নিয়ে অভিযোগ করেন। কারণ অভিযোগ করে সেটা প্রমাণ হলে টাকা পাওয়া যায়। এটাকে ব্যবহার করে অনেকে ইল মোটিভ (অসৎ উদ্দেশ্য) নিয়েও অভিযোগ করেন। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ আইনে আছে বলে জানালেন এএইচএম সফিকুজ্জামান।
তিনি বলেন, "এখন যারা রেস্টুরেন্টের ঘটনা ফেসবুকে ভাইরাল করেছে তাদের উদ্দেশ্য কী সেটা আমরা জানি না। যদি ইল মোটিভ থাকে তবে যারা ভিক্টিম হয়েছে তারা ডিজিটাল অ্যাক্টে মামলা করতে পারে। সেটা পুরোপুরি তাদের বিষয়।"
"তবে ছোটখাটো বিষয়ে অভিযোগ করার বদলে এখন বড় বড় বিষয় ও ঘটনা নিয়েও ভোক্তারা অভিযোগ করছেন। যেমন কনস্ট্রাকশন, রেল সহ বিভিন্ন বিষয় সামনে আসছে। কিন্তু আমাদেরও কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। যেমন আমরা ই-কমার্সের অভিযোগের সমাধান করতে পারছি না। আবার রিটের কারণে মোবাইল ফোন সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানের অভিযোগের সমাধান করতে পারছি না। অথচ কলড্রপ, প্যাকেজের নির্দিষ্ট দামের বিপরীতে বেশি টাকা নেওয়া সহ নানান অভিযোগ রয়েছে। এজন্য ২০০৯ সালের ভোক্তা আইনেও পরিবর্তন এনে নতুন নতুন সেক্টর যোগ করার চেষ্টা করা হচ্ছে।"
"ভোক্তাদের সর্বোচ্চ সেবা দেওয়ার প্রতিশ্রুতির বিষয়ে অধিদপ্তর সবসময়ই অঙ্গীকারাবদ্ধ। তবে আমাদেরও সীমাবদ্ধতা আছে। এক দশক পেরিয়ে গেলেও আমাদের জনবলের সীমাবদ্ধতা আছে। হেডকোয়ার্টার, বিভাগীয় এবং জেলায় আমাদের অফিস রয়েছে। তবে প্রতিটি জেলায় একজন করে কর্মকর্তা রয়েছেন। সেখানে এটা খুবই চ্যালেঞ্জিং। এ কারণে আমরা ৪৬৫ জন নতুন নিয়োগের বিষয় নিয়ে কাজ করছি।"
অধিদপ্তরের মহাপরিচালক জানান, "যে বিষয়ে আমাদের কাজ করার সুযোগ নেই সেখানে সংশ্লিষ্ট বিভাগ বা মন্ত্রণালয়কে আমরা রিকমেন্ড করে থাকি। যেমন এলপিজির বাজার নিয়ন্ত্রণে এনার্জি রেগুলেটর কমিশনকে বলেছি। আবার যখন পোল্ট্রির উৎপাদন খরচ ১৩০-১৬০ টাকার মধ্যে, তখন সেটা উৎপাদনকারী বিক্রি করছে ২০৭ টাকায়। যেখানে বাজারে মুরগি বিক্রি হচ্ছে ২৫০ টাকায়, অথচ এটা ২০০ টাকার বেশি হওয়ার কথা নয়। এ বিষয়গুলো প্রাণীসম্পদ মন্ত্রণালয়কে জানানো হয়েছে। তারা কাজ করছে।"
"আবার আসন্ন রমজানের বাজার নিয়ে অধিদপ্তর আরও তিনমাস আগে থেকেই কাজ শুরু করেছে। যেহেতু কোভিড পরবর্তী রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে ডলারের দাম বেড়েছে, সেখানে পণ্যের দাম স্বাভাবিকভাবেই বাড়বে। কিন্তু সেটা যাতে যৌক্তিক থাকে সেজন্য আমরা সরবরাহ পরিস্থিতি ঠিক রাখতে কাজ করেছি। যাদের এলসির সমস্যা ছিল সেগুলো কেইস টু কেইস আমরা এলসি করতে সহযোগিতা করেছি।"
এএইচএম সফিকুজ্জামান জানান, "এবার ভিন্নভাবে বাজার মনিটরিং করা হবে। আমরা এর জন্য ব্যবসায়ী কমিউনিটিকে সঙ্গে নিয়েছি। সবার সঙ্গে মিটিং করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, প্রতিটি বাজার কমিটি আলাদা আলাদা বাজারের নিয়ন্ত্রণে কাজ করবে। যদি কোন কমিটি ব্যর্থ হয়, তাদের সব ধরনের নিবন্ধন বাতিল সহ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।"
এদিকে অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে অভিযোগ নিষ্পত্তির হার কমে গেছে। চলতি অর্থবছরের ২৮ ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত ১৫,৬৮৮টি অভিযোগ জমা হয়েছে, যেখানে এখনো ৫,১২০টি অভিযোগের নিষ্পত্তি হয়নি।