ভাইরাসের হুমকি হ্রাস পায়নি, বিশ্ব অর্থনীতি নিয়ে প্রত্যাশার পর্যালোচনা প্রয়োজন
আগামী বছর নাগাদ করোনাভাইরাস প্রতিরোধী টিকা বাজারে আসবে এমন প্রত্যাশা রয়েছে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে। সেই সুবাদে ২০২১ সালে বিশ্ব অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াবে- সে আশাতেও বুক বেঁধেছেন অনেকে। বিজ্ঞানীরা অবশ্য এতটা আশাবাদী নন। সামনে অনেক দীর্ঘ এবং বন্ধুর পথ পাড়ি দিতে হবে, এমন আশঙ্কা তাদের। ফলে সময় এসেছে বাস্তবতার নিরিখে প্রত্যাশার লাগাম টেনে ধরার।
১৯৩০ এর দশকের মহা-মন্দার পর সবচেয়ে খারাপ অবস্থার মুখে পড়েছে বিশ্ব অর্থনীতি- অতিমারির এসময়ে। এবাররের মন্দা পূর্ববর্তী ওই সময়ের চাইতেও বাজে আকার ধারণ করবে, এমন সতর্কতা অনেক আগে থেকেই দিয়ে আসছেন বরেণ্য অর্থনীতিবিদেরা। তারপরও, টিকা ঘিরে কিছুটা প্রত্যাশা তো থাকেই।
সমস্যা হলো; প্রথমদিকে বাজারে আসা টিকা কতটুকু ফলপ্রসূ হবে, তা কারো জানা নেই। পৃথিবীর ৭শ' কোটি বাসিন্দাকে তা সরবরাহ করা সহজ হবে কিনা এবং তারা স্বেচ্ছায় টিকা নিতে চাইবেন কিনা- তাও অনিশ্চিত।
অথচ বিশ্ব অর্থনীতির ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে মৌলিক এসব প্রশ্নের উত্তরে। ইউরোপ মহাদেশ-সহ বিশ্বের নানা স্থানে যখন আসন্ন শীতের আগেই করোনাভাইরাস সংক্রমণের নতুন ঢেউ আঘাত হানছে- তখন এর গুরুত্ব আরও বাড়ে।
স্বাস্থ্যগত নিরাপত্তার সরকারি পদক্ষেপে বিশ্ব অর্থনীতি ফের লকডাউন ও শাটডাউনের ফেরে পড়তে পারে, এমন দুর্ভাবনা জোরালো আকার ধারণ করছে। যতটুকু স্বাভাবিক অবস্থা ফিরেছে ব্যবসা-বাণিজ্য এবং দৈনন্দিন চলাফেরায়- তা আবারও ব্যাহত হতে পারে। বিপদের কোনো সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়। পুঁজিবাজারে এসব কিছুর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে সবার আগে।
কানাডাভিত্তিক পুঁজিবাজার ও সম্পদ ব্যবস্থাপক ম্যানুলাইফ ইনভেস্টমেন্ট বিশ্বব্যাপী ৬৬ হাজার কোটি ডলারের বিনিয়োগ ব্যবস্থাপনায় জড়িত। সংস্থাটির একজন পোর্টফলিও ম্যানেজার ক্রিস চ্যাপমানের মতে, সফল টিকা বাজারে আসলেও তা অর্থনীতি পুনর্জীবিত করার জাদুকরি সমাধান হতে পারবে না।
আংশিক উন্নতির সংশোধনী পূর্বাভাস:
চলতি বছর পুরো পৃথিবীর মোট উৎপাদন ও সেবা প্রবৃদ্ধি (জিডিপি) ৫ দশমিক ২ শতাংশ সংকোচনে পড়বে- বলে গত জুনে দেওয়া ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুক শীর্ষক পূর্বাভাস প্রতিবেদনে জানিয়েছিল আইএমএফ। অক্টোবর সংশোধনীতে সেখান থেকে আংশিক উন্নতির অনুমান করে ৪.৪ শতাংশ সংকোচনের কথা বলা হয়েছে।
ওয়াশিংটন ভিত্তিক দাতাগোষ্ঠীটির প্রধান অর্থনীতিবিদ গীতা গোপীনাথ সংশোধনীর বিষয়ে জানান, নানা দেশের সরকারের দেওয়া ১২ লাখ কোটি মার্কিন ডলার সমমূল্যের অর্থ সহায়তা ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষতি অনেকটা কমাতে সক্ষম হয়। তাছাড়া, কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর শিথিল মুদ্রানীতিও এক্ষেত্রে সাহায্য করেছে। এসব পদক্ষেপ অব্যাহত রাখার প্রতি তিনি বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেন। তবে অর্থনীতি উত্তরণের মূল চাবিকাঠি ভাইরাসের বিরুদ্ধে জয়ী হওয়ার উপরই নির্ভর করছে, বলে তিনি উল্লেখ করেন।
''জীবাণুর প্রকোপ আবারও বাড়ছে। ফলে অনেক অঞ্চলেই স্থানীয়ভাবে লকডাউন ফিরে এসেছে। পরিস্থিতি যদি আরও খারাপের দিকে যায় এবং টিকা বা চিকিৎসার নতুন পদ্ধতিগুলো কাজ না করে- তাহলে অর্থনৈতিক কার্যক্রমে তার মারাত্মক প্রভাব পড়বে। আর্থিক খাত এবং পুঁজিবাজারে যার কারণে ভয়ঙ্কর অরাজকতা দেখা দিতে পারে,'' সতর্ক করেন গোপীনাথ।
চ্যাপম্যান জানান, ''খুব বেশি প্রত্যাশার মতো অবস্থা নয় এখন। অতিমারি পূর্ব প্রবৃদ্ধির অবস্থানে ফিরতে আসলে এক বছরের বেশি সময় লাগবেই। তাছাড়া, এই উত্তরণের পথ সহজ নয়। প্রাদুর্ভাব মাঝেমধ্যেই বাধা হয়ে দাঁড়ানোয়, ওই অবস্থায় ফেরার সময়ও বাড়বে। তারপরও, আগামী বছর সফল টিকা আসবে, এমন একটা প্রত্যাশা কাজ করছে পুঁজিবাজারে।''
সময় যখন নির্মম:
সঙ্কটের মাত্রাও নজিরবিহীন এবার। তাই শুধুমাত্র প্রত্যাশা- বাণিজ্যিক পরিবেশে পুঁজি সঞ্চালন বাড়াবে না। নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি, উৎপাদন কাজ, বিনিয়োগের জন্য স্থিতিশীল পরিবেশ এজন্য অপরিহার্য।
গত কয়েক দশকে বিশ্ব অর্থনীতি সঙ্কটকালে নির্ভর করেছে নানা দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং অর্থমন্ত্রীদের দেওয়া প্রণোদনা প্যাকেজের উপর। ওই সূত্র অনুসারে, পর্যাপ্ত পরিমাণে অর্থ সরবরাহ করলেই ধীরে ধীরে অর্থনীতি ফিরে আসতো প্রবৃদ্ধির ধারাবাহিক চক্রে।
সোনালী সেদিন, সেই সূত্র- এখন বাতিল আর অকেজো। এটা অন্য এক সময়। শুধু মানুষের জীবন-মৃত্যু নয়, সভ্যতার মুদ্রা ব্যবস্থা, ব্যাংকিং, পুঁজিবাজার, সেবা প্রতিষ্ঠান আর বাণিজ্যিক সংস্থা-সবার জন্য এটা অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার লড়াই।
পুঁজিবাজার নিয়ে দৃষ্টিভঙ্গির আঙ্গিকও বদলেছে। আশার আলো খুঁজতে প্রতিনিয়ত ভ্যাকসিন ট্রায়াল আর নতুন চিকিৎসা পদ্ধতি নিয়ে বিজ্ঞানীদের প্রকাশিত গবেষণা তথ্যে নজর রাখছেন বিনিয়োগকারীরা। পাশাপাশি ওয়াশিংটন, বেইজিং এবং ইউরোপের নানা দেশের রাজধানীগুলো থেকে দেওয়া প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণার প্রতিও তাদের নজর থাকছে।
তবে ভ্যাকসিন আবিষ্কারে যত দেরি হবে, তার প্রভাবও বিনিয়োগকারীদের আস্থাতে পড়বে। পুঁজি সঞ্চালন নিয়ে তারা যত সংযত হবেন, অর্থনীতির সম্প্রসারণও ততোই দুর্বল হবে, এটাই বাস্তবতা।
বিজ্ঞান অচিরেই হয়তো যুগান্তকারী কোনো সমাধান আবিষ্কার করবে আগামী দিনে। কিন্তু, তার সম্পূর্ণ নিশ্চয়তা কোথায়?
সবকিছু নিয়ে নিরাশ হওয়ার কারণও অবশ্য নেই। সফল ভ্যাকসিন বাজারে আসা এবং তা যদি পৃথিবীর সকল স্বাস্থ্যকর্মীকে দেওয়া সম্ভব হয়, সেটাও আরোগ্যের পথে এক বিরাট অগ্রগতি যোগ করবে নিঃসন্দেহে। সবচেয়ে বেশি সংক্রমণের ঝুঁকির মুখে থাকা জনগোষ্ঠীকেও প্রথমেই টিকা দেওয়া প্রয়োজন। এদুটি ক্ষেত্রে সফলতা যোগ করা গেলেই, অর্থনীতি ঘিরে আস্থা বাড়বে। স্বাভাবিক হওয়া শুরু করবে দৈনন্দিন জীবনযাত্রা।
ফলে ২০২০ সালে যেসব পরিবার ভবিষ্যতের কথা ভেবে টাকাকড়ি জমিয়েছে, তাদের অনেকেই ২০২১ সালে বিনিয়োগ করবে নিঃসন্দেহে।
অর্থনীতি একটি নিরবিচ্ছিন্ন চক্র। সমাজের সকল শ্রেণি- এর সঙ্গে জড়িত। প্রাক-মহামারি অবস্থায় ফেরার মতো উদ্দীপনা অচিরেই আশা করাটা তাই যুক্তিসঙ্গত নয়।
বিনিয়োগ পরিবেশে স্বস্তির নিঃশ্বাস পড়বে, রোগ মোকাবিলায় সফলতাকে কেন্দ্র করে। সচল অর্থনীতিতে ফিরতে কোভিড নিরাময়ের যে বিকল্প নেই, সেকথা লকডাউনের কালেই জানিয়ে দিয়েছিলেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান ড. তেদ্রোস আধানম ঘেব্রেয়েসুস।
কোভিড-১৯ প্রতিরোধকে তিনি জীবন ও জীবিকা বাঁচানোর সংগ্রাম বলেই, উল্লেখ করেন এসময়।
- সূত্র: ব্লুমবার্গ অবলম্বনে
- অনুবাদ: নূর মাজিদ