মহামারিতে বেড়েছে রাজস্ব আয়, বড় কোম্পানিগুলোর ভূমিকা বেশি
করোনার কারণে অর্থনীতি স্বাভাবিক না থাকলেও আয়কর ও ভ্যাট সংগ্রহে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। সদ্য বিদায়ী অর্থবছরে আয়করে আগের বছরের তুলনায় ১৪.১১ শতাংশ এবং পণ্য ও সেবা থেকে আহরিত ভ্যাট থেকে ১০.৮২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি পেয়েছে এনবিআর।
এনবিআরের কর্মকর্তারা বলছেন, বিনা প্রশ্নে কালো টাকার সাদা করার সুযোগ, রাজস্ব ব্যবস্থা ডিজিটালাইজেশন, উৎসে কর আহরণে জোরদার ও রাজস্ব বোর্ডের মনিটরিং ব্যবস্থা শক্তিশালীকরণের ফলে রাজস্ব আহরণ বেড়েছে। যদিও করোনার কারণে গত বছর উভয় খাতেই নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি ছিল এনবিআরের।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, করোনার প্রথম ধাক্কা সামলে অনেকটাই গতি ফিরে পেয়েছিল অর্থনীতি। চলতি বছরের শুরু থেকেই আমদানি-রপ্তানি বেড়েছে, স্থানীয় উৎপাদন ও সরবরাহ–শৃঙ্খলেও গতি এসেছে। ফলে, রাজস্ব আদায়ও বেড়েছে। তবে আগের বছর নেতিবাচক থাকায় এবার প্রবৃদ্ধি বেশি মনে করছেন তারা।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, '২০১৯-২০ অর্থবছর রাজস্ব আহরণ অনেক কম হয়েছিল। এনবিআর এবার সেখান থেকে বের হয়ে এসেছে। তবে জিডিপির তুলনায় এটি অনেক কম। করোনার এই সময়ে মানুষের হাতে নগদ সহায়তা পৌঁছে দিতে রাজস্ব আহরণ লাগবে। এনবিআরকে অটোমেশনের মাধ্যমে রাজস্ব আহরণ আরো বাড়াতে হবে'।
এনবিআরের পরিসংখ্যান বিভাগের তথ্যানুযায়ী, রাজস্ব আহরণে সবচেয়ে ভালো করেছে আয়কর বিভাগ। সাময়িক হিসাবে ১৪.৮০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি নিয়ে আয়কর খাতে সর্বশেষ অর্থবছরের আহরণ ৮৫ হাজার কোটি টাকা। যদিও লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৯৭ হাজার কোটি টাকা।
আয়কর বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, আয়করের ৮৬ শতাংশই উৎসে কর হিসাবে কর্তন করা হয। ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক করদাতাদের আয়ের উৎস থেকে তা আদায় করায় এ খাতে ঘাটতি পড়েনি। তাছাড়া করোনা পরিস্থিতির মধ্যেও মনিটরিং কার্যক্রম জোরদার করায় আদায় বেড়েছে।
আয়কর থাতে সবচেয়ে বেশি রাজস্ব আহরণকারী প্রতিষ্ঠান লার্জ ট্যাক্সপেয়ার ইউনিট (এলটিইউ)। লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও বেশি রাজস্ব আদায় করেছে প্রতিষ্ঠানটি। ১৫.২২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি নিয়ে গেল বছর তাদের আহরণ ২৪০১১ কোটি টাকা। মোবাইল ফোন কোম্পানি, ব্যাংক বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান, ওষুধ, সিমেন্ট, সিরামিকসহ বৃহৎ প্রতিষ্ঠান থেকে আয়কর আদায় করে তারা। অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগের সুযোগও তাদের প্রবৃদ্ধিতে ভালো ভূমিকা রেখেছে বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা।
এলটিইউ'র কমিশনার মোঃ ইকবাল হোসেন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'অর্থনীতিতে নতুন করে চাহিদা তৈরি হওয়া এবং করদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের ফলে কর আদায়ে সাফল্য এসেছে'।
এলটিইউ এর পরেই রাজস্ব সবচেয়ে বেশি আসে ঢাকার করাঞ্চল-১ থেকে। কোম্পানির পাশাপাশি পেশাজীবীদের আয়কর আহরণ করে তারা। ১৫ শতাংশের কাছাকাছি প্রবৃদ্ধি পাওয়া এ করাঞ্চলের কর্মকর্তারা করদাতাদের সঙ্গে ব্যক্তিগত যোগাযোগের মাধ্যমে সফলতা পেয়েছেন।
করাঞ্চল-১ এর কমিশনার এ কে এম বদিউল আলম বলেন, 'লকডাউনে সব বন্ধ থাকলেও আমরা অফিস করেছি। উৎসে কর যথাসময়ে কেটেছি। করদাতাদের এসএমএস ও ই-মেইল যোগাযোগের মাধ্যমে তাগাদা দিয়ে কর আদায় করেছি। ফলে কর আদায়ে বড় অসুবিধা হয়নি'।
করোনার সংক্রমণ ঠেকাতে সরকার গত এক বছরে চলাচলে নানা বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। চলাচল সীমিত হওয়ায় ছোট প্রতিষ্ঠানের ব্যবসা কমেছে। তবে বড় প্রতিষ্ঠান ভালো ব্যবসা করেছে। ফলে সিরামিক, মোবাইল ফোন, ব্যাংক, বৃহৎ কনজিউমার প্রতিষ্ঠান থেকে ভ্যাট আদায় বেড়েছে এনবিআরের।
আয়করের মতোই ভ্যাট খাতেও বেশি সফলতা এসেছে বৃহৎ কোম্পানির কাছ থেকে ভ্যাট সংগ্রহের জন্য গঠিত লার্জ ট্যাক্স পেয়ার ইউনিট (ভ্যাট) থেকে। রাজস্ব বোর্ড সূত্র বলছে, ভ্যাট খাতে ৯৩ হাজার কোটি টাকার মধ্যে ৪৮৮৯২ কোটি টাকাই এসেছে ১৫৭টি বৃহৎ কোম্পানি থেকে। এ খাতে সামগ্রিক ১০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হলেও বৃহৎ কোম্পানি খাত থেকে রাজস্ব আহরণকারী এলটিইউর প্রবৃদ্ধি ১৬.৩২ শতাংশ।
মূলত বৃহৎ প্রতিষ্ঠানের ব্যবসায় প্রবৃদ্ধি ও নিজেদের মনিটরিং ব্যবস্থা শক্তিশালী হওয়ার কারণে এ সফলতা বলে মনে করছেন এনবিআর কর্মকর্তা। এলটিইউ কমিশনার ওয়াহিদা রহমান চৌধুরী বলেন, 'এই করোনার মধ্যে এলটিইউতে ভ্যাট ও করের জন্য নিবন্ধিত কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে ভ্যাট আদায়ে ১৬ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি আছে। এটি কর্মকর্তাদের প্রচেষ্টায় হয়েছে'।
করোনার মধ্যেও এ সফলতা ভালো হিসাবেই দেখছেন এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যানে মুহাম্মদ আবদুল মজিদ। তিনি বলেন, 'এই পরিস্থিতির মধ্যেও প্রবৃদ্ধি ইতিবাচক। ব্যক্তি করদাতাদের আয় কমে গেলেও এলটিইউতে থাকা বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবসায়ে বড় ধরণের প্রভাব পড়েনি। এর মধ্যে তাদেরকে কমপ্লায়েন্সের মধ্যে আনতে এনবিআরের চেষ্টা – সব মিলিয়ে তুলনামূলক ভালো প্রবৃদ্ধি হয়েছে'।