মহামারি পরবর্তী বিশ্বে ভোক্তা পরিস্থিতির ইঙ্গিত দিচ্ছে চীনের ক্রেতারা
গত বছর থেকে অধিকাংশ সময়জুড়ে কোভিড-১৯ সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে থাকলেও ব্যয়ের বিষয়ে সতর্ক রয়েছেন চীনা ভোক্তারা। দ্রুত বাড়তে থাকা চাহিদা স্তিমিত হয়ে পড়লে বৈশ্বিক ব্যয়ের গতিপ্রকৃতি কেমন হবে, বর্তমানে সেই ধারণাই তুলে ধরছে চীন।
ভোক্তাদের জন্য দেশটি কোনো প্রণোদনার উদ্যোগ না নিলেও কঠোরভাবে ভাইরাস দমনের ফলে চীনের অর্থনীতি দ্রুত স্বাভাবিক রূপে ফিরে আসে। চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে দেশটির পারিবারিক আয়ের প্রকৃত প্রবৃদ্ধির হার ১৩ দশমিক ৭ শতাংশে গিয়ে পৌঁছায়।
কিন্তু, তা সত্ত্বেও ভোক্তা চাহিদার পুনরুদ্ধার আশানুরূপ পর্যায়ে পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়। অর্থনীতিবিদরা এর পিছে দুটি প্রধান কারণ চিহ্নিত করেছেন। প্রথমত, মহামারির কারণে সঞ্চিত অর্থের অসম বিভাজন। দ্বিতীয়ত, মহামারির দীর্ঘসূত্রতা, যা মানুষকে পরিষেবা ভিত্তিক ব্যয় কমিয়ে সঞ্চয়প্রবণ করে তুলেছে। ফলে, বিশ্বের দ্বিতীয় অর্থনীতির দেশ চীন ভিন্নধারার ভি-আকৃতির অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের দিকে ঝুঁকছে।
যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্যের মতো চীনেও খুচরা বেচাবিক্রির বাজার মূল্য মহামারি-পূর্ব অবস্থার থেকে বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে, ইউরো অঞ্চলে ভোক্তা চাহিদার পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া অব্যাহত আছে। ব্লুমবার্গ ইকোনমিকসের সূত্রানুসারে, বিশ্বের বৃহত্তর অর্থনীতির ভোক্তা ও গ্রাহকরা কোভিড-চালিত লকডাউন চলাকালে বাড়তি সঞ্চয় হিসেবে ২.৯ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার পুঞ্জীভূত করে, যা ৬০ বছরের মধ্যে ২০২১ সালে বিশ্বের দ্রুততম প্রবৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করছে।
কিন্তু, প্রশ্ন হলো পরিষেবাভিত্তিক ব্যয় হ্রাস পাওয়ার কারণ কী। একইসঙ্গে, বিশ্বব্যাপী গ্রাহকদের আকাঙ্খার পুনরুদ্ধার কতটুকু টেকসই প্রমাণিত হবে সেই প্রশ্নও থেকে যায়।
বিশ্বে দৈনিক সর্বোচ্চ দুই কোটি মানুষকে টিকা বিতরণ করার পাশাপাশি এখন পর্যন্ত দেশের ৪০ শতাংশের বেশি জনগোষ্ঠীকে অন্তত এক ডোজ টিকা দিতে সক্ষম হয়েছে চীন। কিন্ত, দেশটির পরিস্থিতি থেকে ধারণা করা যায় যে, টিকাদান কর্মসূচীর সফলতা সত্ত্বেও ব্যয় পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া ধীর গতিতে হবে।
ব্যয় হ্রাস পাওয়া
ব্যবসা থেকে মহামারির নেতিবাচক প্রভাব দূর হতে এখনও দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেন চীনের ইউনান প্রদেশের দক্ষিণাঞ্চলের বিখ্যাত পর্যটন কেন্দ্র জিশুয়ানবানার পুরনো চায়ের দোকানের মালিক এবং চা-চাষী ২৬ বছর বয়সী লি ওয়েইয়াও।
"বর্তমানে পর্যটকদের সংখ্যা অনেক কম। একইসঙ্গে, যারা দোকানে আসেন, তারাও কিছু কিনতে খুব বেশি আগ্রহী নন," বলেন তিনি। মহামারির আগে তার বিক্রি ২০ হাজার ইউয়ান থাকলেও বর্তমানে তা দুই হাজারে নেমে এসেছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
"বর্তমানে আমি শুধু প্রয়োজনীয় জিনিস কিনে থাকি। একসময় ভীষণ স্মার্টফোন-প্রেমী ছিলাম। সবসময় সর্বশেষ মডেলের ফোন কিনতাম। কিন্তু, এখন আমি যতদিন সম্ভব পুরনো ফোন দিয়েই কাজ চালাব। পাশাপাশি, এখন বেশিরভাগ সময় শুধু সাধারণ কাপড়ই কিনি।"
ব্লুমবার্গের অর্থনীতিবিদরা যা বলছেন
"চীনের প্রবৃদ্ধি সত্ত্বেও, ভোগব্যয় পুরোপুরি আগের অবস্থায় ফিরতে সময় লাগবে। ২০২১ সালের প্রথম ছয় মাসের মধ্যে চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যবর্তী ব্যবধান দূর করা সম্ভব হবে না। বেকারত্বের হার হ্রাস এবং আয়বৃদ্ধি খরচ বাড়াতে উৎসাহিত করবে। তবে, মহামারিজনিত অনিশ্চয়তা এবং অবকাঠামোগত প্রতিবন্ধকতা পুনরুদ্ধার গতিকে নিয়ন্ত্রণ করবে। ২০২১ সালের শেষ নাগাদ ভোগব্যয় মহামারি-পূর্ব পর্যায়ে পৌঁছাবে বলে আমরা আশা করি,"-চ্যাঙ শু, ব্লুমবার্গের এশিয়া বিষয়ক প্রধান অর্থনীতিবিদ।
৫০টির বেশি শহরে পিপল'স ব্যাংক অব চায়না কর্তৃক পরিচালিত এক জরিপে অংশগ্রহণকারী ২০ হাজার আমানতকারীর মধ্যে ব্যয়ের ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বনের প্রবণতা দেখা গেছে। চলতি বছরের প্রথম তিন মাস ধরে পরিচালিত এই জরিপে ৪৯ শতাংশ অংশগ্রহণকারী সঞ্চয় বৃদ্ধি করছেন বলে জানান। অথচ, ২০১৯ সালের শেষ তিন মাসে এই হার ছিল ৪৬ শতাংশ। মাত্র ২২ শতাংশ জানান যে, তারা বেশি খরচ করছেন। ২০১৯ সালের এই হার ছিল ২৮ শতাংশ।
ভবিষ্যৎ আয়ের ক্ষেত্রে অংশগ্রহণকারীদের আত্মবিশ্বাস নির্ণয়কারী সূচকের মান ছিল ৫১। ২০২০ সালের প্রথম তিন মাসের তুলনায় তা বৃদ্ধি পেয়েছে। তখন এই সূচক ছিল ৪৫.৯। কিন্তু, ২০১৯ সালের শেষ তিন মাসে এই সূচকের মান ছিল ৫৩.১। অর্থাৎ, আমানতকারীদের আত্মবিশ্বাস এখন পর্যন্ত মহামারি-পূর্ব পর্যায়ে পৌঁছায়নি।
নানজিংয়ের ২৯ বছর বয়সী কফি শপের কর্মচারী জনি সান বলেন, "মহামারির আগের তুলনায় এখন আমি ঘরে বেশি সময় কাটাই। বছর শেষে আমি ঘরে থাকতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। একসময় নাইটক্লাবে যেতে পছন্দ করতাম। কিন্তু, এখন আর সেই প্রয়োজনীয়তা অনুভব করি না।"
বেচাবিক্রি
করপোরেট নির্বাহীরা ব্যবসায়িক পুনরুদ্ধারের কথা বললেও, পুরোদমে ব্যবসায়িক আত্মবিশ্বাস ফিরে পেতে এখনো দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেন।
চীনের বৃহত্তম রেস্টুরেন্ট ব্যবসার চেইন ইয়াম চায়না হোল্ডিংস ইঙ্কের প্রধান ফিন্যান্সিয়াল অফিসার অ্যান্ডি ইউং বলেন, "দোকানের বেচাবিক্রি পুরোপুরি মহামারি-পূর্ব পর্যায়ে ফিরতে এখনও বহু সময়ের প্রয়োজন বলে আমরা মনে করি।"
এপ্রিলে চীনের খুচরা বিক্রির হার ১৭ দশমিক ৭ শতাংশে পৌঁছায়। প্রত্যাশিত ২৫ শতাংশের তুলনায় এই হার নিতান্তই কম। দুই বছরের গড় হিসাবের ভিত্তিতে মার্চে ৬ দশমিক ৩ শতাংশ থেকে এপ্রিল প্রবৃদ্ধির হার হ্রাস পেয়ে ৪ দশমিক ৩ শতাংশে নেমে আসে। পণ্যের পেছনে ব্যয় কিংবা ক্যাটারিং পরিষেবা উভয়ই হ্রাস পেতে থাকায় বিনিয়োগের পরিবর্তে গ্রাহকদের চাহিদা প্রবৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখবে এমন ধারণা কমতে শুরু করেছে।
তবে, চীনের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের বিষয়টি এখনো স্পষ্ট নয়। অনলাইনের ক্রয়ের পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়ায় ধারণা করা হচ্ছে যে, চাহিদার পরিবর্তে গ্রাহকদের ব্যয় করার ধরন পরিবর্তিত হয়েছে। গত মাসে, চীনের পরিসংখ্যান ব্যুরোর মুখপাত্র ফু লিংঘুই জানান, ভাইরাস নিয়ন্ত্রণ এবং কর্মসংস্থান পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে থাকলে ব্যয়ের পুনরুদ্ধারও অব্যাহত থাকবে।
বাইডুর সংকলিত একটি সূচক অনুসারে, চীনে বেকারদের সংখ্যা মহামারির আগের পর্যায়ে নেমে এসেছে। ব্লুমবার্গ ইকোনমিকসের মতে, পারিবারিক আয়ও স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসছে।
মহামারি সৃষ্ট ক্ষত
নিউ ইয়র্কের কলাম্বিয়া বিজনেস স্কুলের চীনা বিশেষজ্ঞ এবং এশিয়ান ডেভলপমেন্ট ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ শ্যাং-জিন ওয়েই বলেন, প্রধান সহযোগীদের চেয়ে চীনের প্রণোদনা পরিকল্পনার ভিন্নতার কারণেই ব্যয়ভিত্তিক পুনরুদ্ধারে অধিকাংশ পার্থক্যের সৃষ্টি হয়েছে। একইসঙ্গে, বাইরে খাওয়া এবং অন্যান্য ভোগ ব্যবস্থার পুনরুদ্ধারে বিনিয়োগের মাধ্যমে পুনরুদ্ধার সম্ভব বলে তিনি মন্তব্য করেন।
"ব্যয়ের প্রবৃদ্ধি জিডিপি প্রবৃদ্ধির ন্যায় ব্যাপক না হওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। তবে, অধিকাংশ মানুষ টিকা গ্রহণ করলে ব্যয় বৃদ্ধির হারও বাড়বে বলে আমি আশা করি," বলেন তিনি।
কিন্তু, তা সত্ত্বেও মহামারি কিছু ক্ষত সৃষ্টি করেছে যা পূরণে সময়ের প্রয়োজন।
পারিবারিক সঞ্চয়ের পরিমাণ সামগ্রিকভাবে উচ্চ হলেও, তা সমানভাবে বিন্যস্ত নয়। এসব সঞ্চয়ের কিছু অংশ সম্পত্তি কিংবা বিলাসবহুল সামগ্রীর পেছনে ব্যয় করা হচ্ছে। সেমন, মাঝারি মানের গাড়ির চেয়ে বিলাসবহুল গাড়ির চাহিদা বৃদ্ধি পেয়েছে।
ব্লুমবার্গ ইকোনমিক্সের মতে, গত বছর নিম্নস্তরের ৪০ শতাংশ উপার্জনকারী যারা বিবেচনা অনুযায়ী ব্যয় করেন, তাদের আয়ের পরিমাণ স্বচ্ছল গোষ্ঠীর তুলনায় সবথেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ব্লুমবার্গের অনুমান অনুসারে, রিটেইল বিক্রির পরিমাণ চলতি বছর ৯ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়ে বছরের শেষ নাগাদ ক্রমশ স্বাভাবিক পর্যায়ে পৌঁছাতে পারে।
এছাড়া, ভাইরাসের আকস্মিক পুনরুত্থানও গ্রাহকের মনস্তত্ত্বে প্রভাব ফেলে। চীনের গুয়াংডং প্রদেশে ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব বাড়ায় পুনরায় সামাজিক দূরত্ব আরোপিত হয়েছে।
"কিছু সংখ্যক ক্রেতা ব্যয়ের বিষয়ে ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করেন। অন্যদিকে, অনেকেই আগামী কয়েক বছরের ব্যাপারে অনিশ্চিত এবং ব্যয়ের বিষয়ে রক্ষণশীল," বলেন চংকিং লিকারের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা তাও সিকুয়ান। "উভয় জিনিসই ঘটছে," বলেন তিনি।
- ব্লুমবার্গ অবলম্বনে