মহিষের দুধের মিষ্টির ঐতিহ্য হারিয়ে যাবে?
এক দশক আগেও যদি আপনি চট্টগ্রামের কাউকে জিজ্ঞেস করতেন, ওই অঞ্চলের সেরা মিষ্টি কোনটি, তাহলে নির্দ্বিধায় সবাই আপনাকে সাধু সুইটমিটের নামই বলত।
ষাটের দশক থেকে শুরু করে ২০০০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের প্রধান উপকূলীয় শহর চট্টগ্রামে সাধুর মিষ্টি ছিল ব্যাপক জনপ্রিয়। তাদের মিষ্টির অতুলনীয় স্বাদ ও বৈচিত্র্যই এর কারণ।
শহরের কোতোয়ালী এলাকায় কামনী কুমার দে প্রথম সাধু সুইটমিটের গোড়াপত্তন করেন ষাটের দশকে। সেই থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত তার ছেলে গোপাল কুমার দে দোকানটি পরিচালনা করেন।
এখানকার মিষ্টান্নের প্রধান উপকরণ- রাবড়ি, খিরসা ও ছানার মিষ্টি, যা মূলত আনোয়ারা, কর্ণফুলি ও বাঁশখালি উপকূলীয় অঞ্চল থেকে আসা মহিষের দুধ দিয়ে বানানো হয়।
কিন্তু ২০১০ সালের দিকে মহিষের সংখ্যা কমে যাওয়ায় সাধু সুইটমিট বেশ সংকটে পড়ে।
বাংলাদেশ কৃষি জরিপ অনুযায়ী, ২০০৩ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত দেশে মহিষের সংখ্যা ৫১ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। এর কারণ, মাটি ও পানিতে লবণাক্ততা বৃদ্ধি, চারণভূমি কমে যাওয়া, সাইক্লোন, ঝড় ও বজ্রপাতের কারণে সৃষ্ট খারাপ আবহাওয়া ও অন্যান্য মানবসৃষ্ট পরিবেশ দূষণের ফলে মহিষের নানা রোগবালাই ও বন্ধ্যাত্ব সৃষ্টি হয়েছে।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যানিমেল ব্রিডিং অ্যান্ড জেনেটিকস বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ ওমর ফারুক বলেন, 'বাংলাদেশের ৯০ শতাংশ ডেইরি মহিষ উপকূলীয় অঞ্চলগুলোতে রয়েছে। বিগত ১৫ বছরে দুধ উৎপাদনকারী মহিষের সংখ্যা প্রায় ৬০ শতাংশ কমে গিয়েছে, যার ফলে আমরা এখন মহিষের দুধ কম পাই।'
অধ্যাপক ওমর ফারুক মহিষ নিয়ে গবেষণায় বাংলাদেশে প্রথম সারির একজন গবেষক। তিনি আরও জানান, 'দেশীয় মহিষের মধ্যে একটি বিশেষ গুণ রয়েছে। এসব মহিষের দুধ থেকে তৈরি পনির ও দইয়ের স্বাদ শঙ্কর জাতের চেয়ে ভালো হয়।'
সাধু সুইটমিট মহিষের দুধের স্বল্পতা পূরণের চেষ্টা করেছিল এরসঙ্গে গরুর দুধ ও গুড়ো দুধ মিশিয়ে। কিন্তু তাতে মিষ্টির স্বাদে অনেক পরিবর্তন ঘটে যায়। মহিষের দুধের অভাবে তাই সাধু শেষ পর্যন্ত গরুর দুধ দিয়ে মিষ্টি বানানো শুরু করতে বাধ্য হয়।
আর সেইসঙ্গে আস্তে আস্তে সাধুর মহিষের দুধের মিষ্টান্নের খ্যাতিও শহরের বুক থেকে মুছে যায়।
বর্তমানে কামনী কুমার দের আত্মীয়-স্বজন ও সাবেক কর্মীরা কিছু দোকান চালান, যেখানে গরুর দুধের মিষ্টি তৈরি হয়। তবে উপকূলীয় অঞ্চলগুলোতে এখনো কিছু দোকানে মহিষের দুধের তৈরি মিষ্টান্ন পাওয়া যায়।
সাধু সুইটমিটের সাবেক কর্মী সুকেন্দ্র মজুমদার বলেন, '১৯৯০ সালের দিকে যখন আমরা খিরসা বানাতাম, তার গন্ধ পুরো এলাকায় ছড়িয়ে পড়ত। প্রতিদিন আমরা ৪০০ কেজির মতো মিষ্টি বিক্রি করতাম।'
সাধুর হয়ে ৪০ বছর কাজ করেছেন সুকেন্দ্র। বর্তমানে তিনি কোতোয়ালী অঞ্চলে একই নামের একটি মিষ্টির দোকান চালান।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে তিনি জানান, মহিষের দুধের স্বল্পতার কারণে তারা রাবড়ি, প্যারা সন্দেশ ও খিরসা বানানো অনেক আগেই বন্ধ করে দিয়েছেন। এখন তিনি প্রতিদিন ১০০ কেজির মতো গরুর দুধের তৈরি মিষ্টি বিক্রি করতে পারেন।
উপকূলীয় অঞ্চলগুলোতে মিষ্টান্ন ও মইষের দই (মহিষের দই) ফেরিওয়ালারা জানান, মহিষের সংখ্যা কমে যাওয়ায় এখন এই ব্যবসায়ে খরচ অনেক বেড়ে গেছে।
সন্দ্বীপের 'বিনয় মিষ্টি মুখ'-এর মালিক রাহুল সাহা বলেন, 'খরচ বেড়ে যাওয়ায় আমাদের মিষ্টির আকার পরিবর্তন করতে হয়েছে। গরুর দুধ দিয়ে রসগোল্লা বানালে তার স্বাদও অন্য রকম হয়ে যায়। তবে বিয়ে-শাদির মতো উৎসবের কারণে এখনো দই-মিষ্টির ভালো চাহিদা রয়েছে।'
'১০ কেজি মহিষের দুধ থেকে আমরা মিষ্টি তৈরির মূল উপকরণ ছানা ২ কেজির মতো তৈরি করতে পারি। আর ১০ কেজি গরুর দুধ থেকে ১ কেজি ছানা বানানো যায়। কিন্তু মহিষের দুধ প্রতি কেজি ১০০-১৩০ টাকা, অন্যদিকে গরুর দুধ ৬৫-৮০ টাকা করে বিক্রি হয়', রাহুল জানালেন।
পটিয়ার সাংবাদিক মুস্তফা নাঈম বলেন, 'চট্টগ্রামের সাধু ও পটিয়ার সিদ্ধেশ্বরী আমাদের সংস্কৃতির একটা বড় অংশ ছিল।' উদাহরণস্বরূপ তিনি বলেন, মিষ্টির দোকানে বসে যে সাহিত্য-আড্ডা হতো, মিষ্টির দোকানগুলো বন্ধ হবার সঙ্গে সঙ্গে সেগুলোও হারিয়ে গেছে।
'মহিষ আমাদের একটি পুরনো অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিষয়,' বলেন জলবায়ু ও পরিবেশগত পরিবর্তন বিশেষজ্ঞ পাভেল পার্থ। উপকূলীয় অঞ্চলের ৪ দশমিক ৬ কোটি মানুষের জীবন ও জীবিকার সঙ্গে মহিষের গুরুত্বপূর্ণ সংযোগ রয়েছে।
'শুধু যে মহিষের দুধই মিষ্টান্ন তৈরিতে ব্যবহৃত হয়, তা নয়; ওরস বা মুসলমানদের অন্যান্য ধর্মীয় উৎসবে মহিষ কুরবানি দেওয়া হয়। এছাড়াও অতিথি আপ্যায়নের রীতি হিসেবে মহিষের দুধের দই খেতে দেওয়াটাও জামদানি, শীতল পাটি কিংবা ইলিশ মাছের মতোই আমাদের সংস্কৃতির অংশ হয়ে গেছে। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনজনিত নানা সমস্যার কারণে এখন এই পণ্যগুলো আমাদের সমাজ থেকে প্রায় হারিয়েই যাচ্ছে,' বললেন পার্থ।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যানিমেল সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক এ কে এম আহসান কবির, যিনি মহিষ নিয়েও গবেষণা করেছেন, তিনি জানালেন, উপকূল অঞ্চলে প্রধানত বেড়ে ওঠা মহিষগুলো সমুদ্রের পানির মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় ভাঙনের শিকার হয়েছে। সেইসঙ্গে পানিতে লবণাক্ততা বেড়ে গেছে, যা তাদের জন্মদান ও দুধ উৎপাদন ক্ষমতা কমিয়ে দিতে পারে।
অন্যদিকে, গরু উপকূল অঞ্চলের বাইরেও লালন পালন করা যায় এবং মানুষ মিয়ানমার ও ভারত থেকেও অবৈধ উপায়ে গরু নিয়ে আসে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
ইন্ডিপেনডেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের ডেপুটি ডিরেক্টর অধ্যাপক মিজান আর খান বলেন, 'উপকূলীয় মানুষজন মূলত তাদের প্রোটিনের চাহিদা মেটাতে এবং কর্মসংস্থানের জন্য মহিষের ওপর নির্ভর করে।'
চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপকূলের অন্যতম মাজার তালসারা দরবার শরীফের মোহাম্মদ মামুন শাজাদা একটি উদাহরণ দিয়ে বলেন, 'এক দশক আগে ভক্তরা ৭০ শতাংশের মতো মহিষ এবং ৩০ শতাংশ অন্যান্য পশু দান হিসেবে দিত। এখন তারা ৩০ শতাংশের মতো মহিষ দেয় এবং অন্যান্য পশু দেয় ৭০ শতাংশ। কারণ, এখন মহিষের সংখ্যা অনেক কমে গেছে।'
বেড়েছে দুধ আমদানির পরিমাণ
বিগত ১৫ বছরে দুধ উৎপাদনকারী মহিষের সংখ্যা আড়াই লাখ থেকে এক লাখে নেমে এসেছে বলে জানান ডিপার্টমেন্ট লিভস্টক সার্ভিসের বাফালো ডেভলপমেন্ট প্রজেক্ট-২-এ কনসালটেন্ট হিসেবে কাজ করা অধ্যাপক মোহাম্মদ ওমর ফারুক।
আর এই সংখ্যা কমে যাওয়ায় দেশের মোট দুধ উৎপাদনে মহিষের দুধের অবদান ৪ শতাংশ থেকে ২ শতাংশে নেমে গিয়েছে। ফলে বাংলাদেশকে এখন আমদানিকৃত দুধের ওপর আরও বেশি নির্ভর করতে হচ্ছে।
চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউস সূত্রে জানা যায়, গত ১০ বছরে গুড়ো দুধ ও ক্রিম দুধের আমদানির পরিমাণ বেড়েছে ১৬৮ শতাংশ।
২০১১ সালে বাংলাদেশ চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে ১ হাজার ২২০ কোটি টাকা ব্যয়ে ৩৫ হাজার ৮৫২ টন গুড়ো দুধ আমদানি করা হয়েছে। ২০২০ সালে ৩ হাজার ২৩২ কোটি টাকা ব্যয়ে ৯৬ হাজার ১১ টন গুড়ো দুধ আমদানি করা হয়েছে। প্রতি বছরই আমদানির পরিমাণ বাড়ছে।
[প্রতিবেদনটি আর্থ জার্নালিজম নেটওয়ার্কের গ্রান্ট ফেলোশিপের অধীনে একটি গবেষণার ওপর ভিত্তি করে তৈরি]