হাওরের অভিবাসী মহিষ তারা
লঞ্চটা আমাদেরকে কমধরপুরের এক ধানিজমির পাশে নামালো। সূর্য তখন অস্তাচলের পাট চোকানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। গজারিয়ার লঞ্চ টার্মিনাল এখান থেকে আরও মাইলখানেক দূরে। কিন্তু সারেংসাহেব নিপাট ভদ্রলোক; তার ভাষায় আমরা তার এলাকার 'অতিথি'। তাই আমাদের নামানোর জন্য এ আঘাটায় আস্ত লঞ্চটা থামিয়ে দিলেন তিনি।
সারেংয়ের এ দাক্ষিণ্যে আমাদের কমধরপুর বাজারে বাড়িটা খুঁজে পেতে মাত্র মিনিট দশেক লাগল। বাজারে অবশ্য ব্যস্ততার বালাই নেই। একটা টিনশেড-আধাপাকা ঘরে পাঁচজন মানুষের সন্ধান পাওয়া গেল।
ঘরের ভেতর দুখানা বিছানা। মোটামুটি বেশ দামি বলা যায়। দেখে মনে হলো, একটাতে তারা ঘুমান। আরেকটার ওপর কয়েক ডজন পনিরভর্তি পাত্র। কোনো কোনোটা থেকে এখনো রস বেরোচ্ছে, বাকিগুলো ডেলিভারি দেওয়ার জন্য প্রস্তুত।
বারান্দায় অ্যালুমিনিয়ামের বড় বড় পাত্র আর প্লাস্টিকের ঢাউস আকারের কনটেইনরা রাখা হয়েছে। এগুলোতে দুধ বহন করা হয়।
আমরা নিজেদের পরিচয় দিয়ে গমনের উদ্দেশ্য জানালাম তাদেরকে। তাদের নিয়োগকর্তাদের সঙ্গে যে আলাপ করেই এসেছি, সে কথাও বললাম। শুনেই তারা খুব শশব্যস্ত হয়ে উঠলেন। একটা মুরগি আমাদের জন্য জীবনোৎসর্গ করল। সে সঙ্গে এল মহিষের দুধ।
আতিথেয়তার তুলনা হয় না। কিন্তু আমাদের আর খাওয়ার সময় কই, শুধু উৎকণ্ঠার মধ্যে আছি—মহিষগুলো, সেগুলোর দুধ আর সেই দুধ থেকে বানানো পনির নিয়ে কখন তাদের সঙ্গে আলাপ করা যাবে।
আমাদের মতো এ মহিষগুলোও এ এলাকার 'অতিথি'। প্রতিবছর কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোণা ও সুনামগঞ্জের হাওরের পানি যখন কমে যায়, তখন এগুলোতে নতুন ধরনের এক অর্থনৈতিক কর্মযজ্ঞ শুরু হয়।
পানি কমে গিয়ে জেগে ওঠা জমিগুলো নানা কাজে ব্যবহার করা হয়। সব জমিতে চাষাবাদ হয় না, কোনোগুলো এমনি ফেলে রাখা হয়, অথবা সার দেওয়া হয় ঘাসগুলো যেন ভালোমতো জন্মায়।
প্রতিবছর ময়মনসিংহ জেলা থেকে মহিষপালকেরা আসেন এ চারণভূমিতে। এলাকাজুড়ে তখন মৌসুমি ব্যবসার একটি চক্র গড়ে ওঠে।
জমির মালিকদের থেকে জমি ইজারা নেন মহিষপালকেরা। স্থানীয় পনির উৎপাদকেরা এ রাখালদের থেকে মহিষের দুধ কেনার বায়না করে রাখেন। আর কিছু স্থানীয় মানুষ টাকার বিনিময়ে রাখাল ও মহিষের 'নিরাপত্তা দেয়'।
আমরা যে পনিরবিক্রেতাদের সান্নিধ্যে উঠেছি, তারা স্থানীয় বাজারে পাঁচ থেকে ছয় মাসের জন্য একটি ঘর ভাড়া নিয়েছেন। এখান থেকেই যাবতীয় কার্যক্রম পরিচালনা করেন তারা।
ভৈরব থেকে সুনামগঞ্জের সাচনা পর্যন্ত চলাচল করা লঞ্চটিতে আমরা ইটনা থেকে উঠি। ঘন কুয়াশার কারণে দেড় ঘণ্টা দেরিতে ছাড়ায় কমধরপুরে এসে আমাদের একটু তাড়াহুড়োর মধ্যে পড়তে হলো।
মুরগি রান্না হতে সময় লাগবে, তাই ওটা ছাড়াই দুটো নাকেমুখে গুঁজে বাজারের পাশে ধনু নদীতে একটা ছোট ইঞ্জিন নৌকায় চড়ে বসলাম আমরা। নৌকাচালক আমাদের গাইড হেলিম মিঞা, কমধরপুর বাজারের পনিরবিক্রেতা দলটির প্রধান তিনি।
নৌকা ধনু-বাউলাইন নদীর সংগমস্থলে পৌঁছে বামে পশ্চিমে মোড় নিল। পরের এক ঘণ্টা বর্তমানে শুকিয়ে যাওয়া হাওরের মাঝখানে দিয়ে চলল আমাদের নৌকা।
জেগে ওঠা জমিতে কেউ গরু চরাচ্ছেন, কেউ বা মাছ ধরার জাল নিয়ে ব্যস্ত। অনেকে ধানিজমিতে কাজ করছেন। কয়েকজন হাজারো হাঁসের দল তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছেন সামনের বিলে শামুক খাওয়ানোর জন্য।
মিলনপুরে পৌঁছে নৌকা থেকে নামলাম সবাই। দূরে একটা অস্থায়ী ঘর চোখে পড়ল। ওটা মহিষপালকদের আস্তানা বলে ধরে নিলাম। সামনে এগোতে দৃশ্যপট আরও পরিষ্কার হয়ে উঠল।
ঘরের সামনের জমিতে শয়ে শয়ে বাঁশের খুঁটি পোতা, প্রতিটার গায়ে দড়ি জড়ানো। পরে জেনেছি, ১৪০টা মহিষের জন্য ১৪০টা খুঁটি পোতা হয়েছে। সকালে এসব খুঁটিতে বেঁধে মহিষগুলোর দুধ দোয়ানো হয়।
কেবল ৩টা বাচ্চা মহিষ এ মুহূর্তে বাঁধা রয়েছে খুঁটিকে। দুটোর বয়স কেবল নয়দিন বলে জানালেন আমাদের স্বাগত জানানো লোকটি। অন্যটা আজকেই জন্মেছে।
কিন্তু মহিষের পাল কোথায়?
হেলিম মিঞা জানালেন, মহিষগুলোকে পাশের একটি হাওরে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু ঠিক কোথায় নেওয়া হয়েছে, সেটা তিনিও জানেন না। কারণ চারণভূমিতে টাটকা ঘাসের পরিমাণ শেষ হয়ে গেলে মহিষগুলোকে নতুন নতুন জায়গায় চরানোর জন্য নিয়ে যাওয়া হয়।
চারণদলের কর্তাকে ফোন করলেন হেলিম মিঞা। আমাদের ড্রোন আকাশে উড়ল একই সময়ে। মাটিতে থাকা দলটির তথ্য নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ কসরত করার পর অবশেষে মাইলখানেক দূরে একটা খালের মধ্যে পাওয়া গেল মোষপালটিকে। খালের পানিতে শরীর ঠান্ডা করছে সেগুলো।
আমরা রওনা দিলাম খালের উদ্দেশ্যে। সবার পায়ের জুতো বগলে আশ্রয় নিয়েছে। ধানক্ষেত, তৃণভূমি আর সেচের নালি মাড়িয়ে এগিয়ে চলল দলটি।
পৌঁছাতে পৌঁছাতে সূর্য পশ্চিমে আরেকটু হেলে পড়েছে। মহিষগুলো খালের ধারের জমিতে উঠে এসেছে শেষবারের মতো একপাক ঘাস খাওয়ার জন্য।
মহিষকে কৌতূহলী আর বুদ্ধিমান প্রাণী বলেই মনে হলো। অপরিচিত মানুষ দেখে ব্যাটার আমাদের দিকে বারবার ফিরে তাকাচ্ছে, বোধহয় বুঝতে চেষ্টা করছে আমাদের আগমনের হেতু।
ওখানে দেখা হলো রাখাল রুহুল আমিন, আনোয়ার ও জিয়ারুলের সঙ্গে। সবার বাড়ি ময়মনসিংহের ত্রিশালে।
দলে সবচেয়ে বয়স্ক রুহুল আমিন। ৩০ বছরের বেশি সময় এ পেশার সঙ্গে জড়িত তিনি। 'এখানে যখন প্রথম আসি, তখনো মুখে দাড়ি গজায়নি,' হেসে বললেন তিনি।
কিন্তু এ ঐতিহ্য আরও অতীতে প্রসারিত। 'আমার দাদা, চাচা, বাপ সবাই এখানে মহিষ নিয়ে আসতেন,' রুহুল বলেন।
অতীতে মহিষপালকেরা কিশোরগঞ্জের ইটনা ও মিঠামইনের মতো হাওরে তাদের গবাদিপশু নিয়ে আসতেন। এরপর হাওরে রাস্তাঘাট হওয়ায় এখানে জমিচাষের পরিধি বাড়ে। কারণ পথঘাট থাকায় উৎপাদিত ফসল সহজেই লোকালয়ে নিয়ে আসা যাচ্ছে।
এর ফলে রাখালেরা প্রতি বছর তাদের মহিষ নিয়ে আরও উত্তরে সরে গিয়েছেন। বর্তমানে তারা সুনামগঞ্জ ও নেত্রকোণার হাওরে তাদের মহিষ চরান। কিন্তু ব্যবসার কাজকারবারে এখনো অষ্টগ্রামের মতো এলাকার মানুষদের সঙ্গেই জড়িত তারা।
পানি শুকিয়ে গেলে অক্টোবর-নভেম্বরে এখানে আসেন মহিষপালকেরা। নিজেদের এলাকা থেকে মহিষ নিয়ে হাওরে আসতে সাতদিনের মতো লাগে। এ সময় তারা খাল, মাঠ আর অসংখ্য গ্রাম ডিঙিয়ে হাওরে পৌঁছান।
কিন্তু এত কষ্ট করে এ ভ্রমণ কেন, জানতে চাই তাদের কাছে।
'মহিষের অনেক খাবার দরকার হয়। আমাদের ওখানে এত খড় নেই,' বলেন জিয়ারুল। ২০ বছর ধরে রাখাল তিনি।
'অগ্রহায়ণের বন্যায় পশুখাদ্যের আকাল পড়েছিল। খুব সস্তা দামে ৩টা মহিষ বিক্রি করে দিয়েছিলাম বাধ্য হয়ে,' বলেন এ রাখাল।
শুকনো মৌসুমে হাওরের বেশিরভাগ জমি চাষাবাদের জন্য ব্যবহৃত হলেও উঁচু অংশগুলোতে সেচ দেওয়া কষ্টকর বলে সেগুলোতে ফসলের চাষ করা হয় না। এ জমিই তৃণভূমি হিসেবে কাজে লাগে।
মহিষপালকেরা জানান, এ বছর হাওরেরা রাখালদের অন্তত পাঁচটি দল এসেছে। সবমিলিয়ে মহিষের সংখ্যা বারোশ।
আমরা যে দলটির আতিথ্য গ্রহণ করেছি, তাদের আকার ছোট বলেই প্রতীয়মান হলো। সবচেয়ে বড় দলটিতে মোট মহিষের সংখ্যা সাড়ে ৩০০টি।
পাঁচ দলের মধ্যে ৪টির নিশান-এর পনিরের ব্যবসার সঙ্গে সমঝোতা রয়েছে। এ কোম্পানিটি দিনে চার–পাঁচ মণ মহিষের দুধ সংগ্রহ করে। এ পরিমাণ দুধ থেকে ২০–২২ কেজি পনির তৈরি করা যায় বলে জানালেন হেলিম মিঞা।
সকালে দুধ সংগ্রহ করা সহজ কাজ নয়। দোয়ানোর পর এ দুধ কাঁধে করে কয়েক মাইল বয়ে নিয়ে যেতে হয়।
রুহুল আমিন আর জিয়ারুল তাদের সারাজীবন ধরে একই কাজ করে আসছেন। তবে বয়সে সবচেয়ে ছোট আনোয়ার আলাদা কিছু করার চেষ্টা করেছিলেন।
'২০০৭ সালে কিছু মহিষ বেচে আমি বিদেশ যাই। ১২ বছর পর দেশে ফিরে আরও কিছু মহিষ কিনি,' জানান আনোয়ার। ২০১৯ সাল থেকে রাখালের পেশায় আবারও ফিরে আসেন তিনি।
এ কাজই করে যাবেন না-কি অন্য কোনো পরিকল্পনা আছে জিজ্ঞেস করলে আনোয়ার জানান, আর কিছু না পাওয়া পর্যন্ত তিনি এ পেশাতেই থাকবেন।
মহিষ চরাতে ভালো লাগে কি না জানতে চাইলে রুহুল ও জিয়ারুল দুজনেই বললেন, 'কয়েক প্রজন্ম ধরে এটাই করছি আমরা, এ কাজটাই শিখেছি।'
তাদের দুজনেরই ১৫–২০টি করে মহিষ আছে। বাকি মহিষগুলো ময়মনসিংহের অন্য মালিকদের, এ রাখালদের জিম্মায় দিয়ে তারা এলাকাতেই থেকে গিয়েছেন।
এক থেকে দুই বছর হলে পুরুষ মহিষ বিক্রি করা যায়। দামও ভালোই পাওয়া যায়। ধনী না হলেও ময়মনসিংহের গ্রামে ভালোই আছেন বলে জানালেন রাখালেরা।
তবে হাওরের মাঝে বাঁশের তৈরি এসব অস্থায়ী ঘরে থাকাটা আরামদায়ক নয়, কিন্তু এ মহিষপালকেরা সেটাকে মেনে নিয়েছেন।
প্রখর রোদ আর ঠান্ডা রাত্তির এ লোকগুলোর হৃদয়কে কঠিন করে তোলেনি। ফেরার সময় তারা আমাদেরকে তাদের কুঁড়েঘরে খেতে ডাকলেন। কিন্তু বেলা পড়ে এল বলে সে নিমন্ত্রণ রক্ষা করা গেল না।