লবণাক্ততা বৃদ্ধির ফলে হুমকির মুখে মহিষ পালন
৫০ বছর বয়সী শামসুল আলমের পরিবারের প্রধান পেশা ছিল মহিষ পালন। কক্সবাজারের মহেশখালী দ্বীপের এই বাসিন্দা বর্তমানে পুরনো পেশা ছেড়ে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করেন।
"৩০ বছর আগে যখন আমার বাবা মারা যান, তখনও আমাদের প্রায় ১০০টি মহিষ ছিল। লোকসানের মুখে আমি মহিষ পালন ছেড়ে দিয়েছি," বলেন তিনি। তিনি জানান, ক্রমবর্ধমান লবণাক্ততার কারণে মহিষের খাবার পানির সংকট তৈরি হয়েছে, ফলে ধীরে ধীরে মহিষের সংখ্যাও কমে আসছে।
আরেকজন মহিষ পালক নুরুল আলমের ২০০০ সালে ৫০টি মহিষ ছিল। যেই জমি মহিষের চারণভূমি ছিল, সেই জমিতে তিনি বর্তমানে লবণ চাষ করছেন। বন্ধ্যাত্ব, অপুষ্টি, ঘন ঘন অসুস্থ হওয়া- ইত্যাদি বিভিন্ন সমস্যার কারণে ২০১০ সালের মধ্যেই তিনি সব মহিষ বিক্রি করে দেন।
"আমরা খেয়াল করলাম সময়ের সাথে মাঠের লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাচ্ছে। একারণে আমরা মহিষ পালন ছেড়ে লবণ চাষের দিকে ঝুঁকতে বাধ্য হয়েছি," দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলছিলেন কুতুবদিয়া দ্বীপের এই বাসিন্দা।
লবণাক্ততা বৃদ্ধির কারণে একই দ্বীপের মো. রেজাউল করিম তার বাথানকে লবণ মাঠে রূপ দিয়েছেন, এই মাঠ এর আগে প্রায় ১০০টি মহিষের চারণভূমি ছিল।
এসব দ্বীপ থেকে ধীরে ধীরে মহিষ নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে। এসব অঞ্চলের বাথানগুলোও ধীরে ধীরে লবণ মাঠে রূপান্তরিত হচ্ছে। অন্যান্য কারণের মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন রোগ, সাইক্লোন, বন্ধ্যাত্ব, অপুষ্টি ও চারণভূমির সংকট।
বাংলাদেশের দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলের উপকূলীয় দ্বীপ কুতুবদিয়ার বিস্তীর্ণ সবুজ তৃণভূমিতে ১৯৯০'র দশকে ৮ হাজারের বেশি মহিষ চড়ে বেড়াতো। দুই দশক পরই এ অঞ্চলে মহিষের সংখ্যা ৩৫৯ তে নেমে আসে। ২০২০ সালে এ সংখ্যা আরও কমে ১০২ এ দাঁড়ায়।
এক সময় উপকূলীয় অঞ্চলের অর্থনীতি ও সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল মহিষ। এ অঞ্চলের কর্মসংস্থানের উৎস, আমিষের প্রধান উৎস ছিল মহিষ। ওরস ও ঈদের মতো উপলক্ষে মহিষ উৎসর্গ করা হয়। এছাড়াও বিয়েসহ বিশেষ উৎসব অনুষ্ঠানে অতিথি আপ্যায়নের বিশেষ আকর্ষণ ছিল মহিষের দই।
এই হারে মহিষের সংখ্যা কমে যাওয়ায় এ অঞ্চলের মানুষ মহিষ পালন ছেড়ে লবণ চাষ, দিনমজুরি ও মাছ ধরার মতো পেশায় ঝুঁকছেন।
একারণেই দ্বীপের বিখ্যাত দইয়ের বাজার জৌলুস হারিয়েছে। আমিষ ও দুধের সংকটে বিপাকে পড়েছেন এ অঞ্চলের বাসিন্দারাও। উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের আমিষ ও দুধের চাহিদা পূরণ হতো মহিষের মাধ্যমেই।
বিশেষজ্ঞদের মতে ক্রমবর্ধমান লবণাক্ততা, উন্নয়ন কার্যক্রম ও আবহাওয়ার অবস্থা ইত্যাদি চারণভূমি ধ্বংসের জন্য দায়ী, এ অবস্থায় দেশি মহিষের টিকে থাকাও কঠিন হয়ে পড়েছে।
"মহিষদের সবুজ ঘাস ও খড় দিতে হয়, তারা জলাভূমিতে চড়ে বেড়াতে পছন্দ করে," বলেন কুতুবদিয়ার উপসহকারী প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা মোরশেদ আলম।
কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাওয়ার কারণে চারণভূমির লবণাক্ততা বৃদ্ধির ফলে মহিষরা অসুস্থ হয়ে পড়ে। এ অঞ্চলে জীবিকা নির্বাহের খুব বেশি বিকল্প না থাকায় মহিষ পালকরা লবণ চাষের প্রতি ঝুঁকে পড়েছেন। ফলে মহিষদের চারণভূমির পরিমাণও উল্লেখযোগ্য হারে কমে গেছে।
মোরশেদ আলম জানান, আনুমানিক ৯০ শতাংশ মহিষ পালকই বর্তমানে তাদের জমিতে লবণ চাষ করছেন।
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৯০-২০২০ সালের মধ্যে কুতুবদিয়ায় লবণ চাষ ছয় গুণ বেড়েছে।
১৯৯০ সালে এক হাজার একর জমিতে লবণ চাষ হত, সেসময় ৩০-৪০ হাজার টন লবণ উৎপাদিত হত। ২০২০ সালে এসে ৬ হাজার ৫০৫ একর জমিতে লবণ চাষ হয়, উৎপাদিত হয় ২ লাখ ৭ হাজার টন লবণ।
একটি জরিপের উদ্ধৃতি দিয়ে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যানিম্যাল ব্রিডিং অ্যান্ড জেনেটিক্স বিভাগের অধ্যাপক মো. ওমর ফারুক দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, ২০১৯ সালে বাংলাদেশে মহিষের সংখ্যা কমে ৩.৭৮ লাখে দাঁড়ায়। ২০০৩ সালের তুলনায় এ সংখ্যা অর্ধেকেরও কম।
"সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, ঝড়, সাইক্লোন, মাটিক্ষয় ইত্যাদি অস্বাভাবিক আবহাওয়াজনিত কারণে শুধু মানুষই নয়, মহিষরাও হুমকির মুখে পড়েছে," বলেন বাস্তুসংস্থান ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণবাদী ও বাংলাদেশ রিসোর্স সেন্টার ফর ইন্ডিজেনাস নলেজের (বারসিক) সমন্বয়ক পাভেল পার্থ।
জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যা নিয়ে কাজ করা গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পিপল অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টের পরিচালক আবদুর রহমান রানা জানান, মহিষের সংখ্যা কমে আসায় উপকূলীয় অঞ্চলের ৪.৩ কোটি মানুষের খাদ্য ত্যালিকা থেকেও মহিষের দই, দুধ ও মাংস উঠে যাচ্ছে। আমিষের চাহিদা মেটানোও কঠিন হয়ে পড়েছে।
মহিষের সংখ্যা কমে যাওয়ার কারণ
বাংলাদেশে প্রধানত নদীর মহিষ, জলাভূমির মহিষ এবং শংকর জাতের মহিষ- এ তিন ধরনের এশিয়ান মহিষ পাওয়া যায়।
চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, পটুয়াখালী, ভোলা, বরগুনা, বরিশাল, পিরোজপুর ও ঝালকাঠি- সাধারণত এসব অঞ্চলে নদীর মহিষ বেশি দেখা যায়। জলাভূমির মহিষের প্রধান আবাসস্থল সিলেট, হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ ও মৌলভীবাজার।
বাংলাদেশের উপকূলীয় ও হাওড় অঞ্চলেই ৭৫-৮০ শতাংশ মহিষ পালন হয়। দুই অঞ্চলেই জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব লক্ষণীয়।
মহিষের সংখ্যা কমে আসার প্রধান কারণগুলো নির্ধারণে অন্তত ২০ জন উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা, ভেটেরিনারি সার্জন ও এ অঞ্চলের বেশ কয়েকজন কৃষকের সঙ্গে কথা বলেছেন এ প্রতিবেদনটির প্রতিবেদক।
উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ও ভেটেরিনারি মেডিসিন চিকিৎসক ডা. মো. ফখরুল ইসলাম বলেন, মাটি ও পানির অতিরিক্ত লবণাক্ততা মহিষদের বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হওয়ার জন্য দায়ী।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) গবেষক ও প্রাণী বিজ্ঞানের অধ্যাপক ডা. একেএম আহসান কবির টিবিএস-কে বলেন, লবণাক্ততা মহিষদের বন্ধ্যাত্বর কারণ হতে পারে, যার ফলস্বরূপ দেশে মহিষ প্রজননে সংকট দেখা দিয়েছে।
বাংলাদেশের লাল তীর লাইভস্টক ও জাপানের মাই ইউনিভার্সিটির সঙ্গে তার যৌথ গবেষণায় দেখা যায়, যেসব অঞ্চলে লবণাক্ততা বাড়ছে, সেসব অঞ্চলের মহিষের মাংসের লবণাক্ত স্বাদও তুলনামূলক বেশি।
ভবিষ্যতে লবণাক্ততা সমস্যা বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা আরও প্রবল।
বাংলাদেশ মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের পূর্বাভাস অনুযায়ী, ২০৫০ সাল নাগাদ বাগেরহাট, বরগুনা, বরিশাল, ভোলা, খুলনা, ঝালকাঠি, পিরোজপুর ও সাতক্ষীরাসহ দেশের বিভিন্ন জেলার লবণাক্ততা ৫৫ শতাংশেরও বেশি বৃদ্ধি পাবে।
চারণভূমির পরিমাণ কমে যাওয়াও মহিষদের জন্য বড় হুমকির কারণ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন মহিষের চারণভূমিকে বাণিজ্যিক লবণ চাষের ক্ষেত্রে রূপান্তর, রাসায়নিক পদার্থ ভিত্তিক কৃষিকাজ এবং করপোরেট উন্নয়ন কার্যক্রম ও অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার মতো মেগা প্রকল্পই এর কারণ।
"সম্প্রতি মহেশখালী, কুতুবদিয়া, মাতারবাড়ি, সোনাদিয়া, কক্সবাজার ও মিরসরাইয়ের মতো এলাকার উন্নয়ন প্রকল্প বড় হুমকির কারণ," বলেন বাকৃবির ডা. মো. ওমর ফারুক।
অ্যানথ্রাক্স, ব্ল্যাক কোয়ার্টার, হেমোরেজিক সেপটিসেমিয়া ও ফুট অ্যান্ড মাউথ ডিজিজ ইত্যাদি বিভিন্ন রোগের কারণেও মাংস ও দুধ উৎপাদন কমছে। ফলে মহিষ পালনে নিরুৎসাহিত হচ্ছেন অনেকেই।
ভোলা জেলার ভেদুরিয়া ইউনিয়নের একজন মহিষ পালক মো. আলমগীর হোসেন বলেন, "নদীর লবণাক্ত পানি পান করার কারণে আমার তিনটি মহিষের ডায়রিয়া হয় ও রোগে ভুগে তারা মারা যায়,"
প্রয়োজনীয় উদ্যোগের অভাব
মহিষের সংখ্যা কমে আসায় কৃত্রিম গর্ভাধান, নতুন ল্যাবরেটরি স্থাপন, নতুন ফার্ম তৈরি বা পুরনো ফার্মের সংস্কার- ইত্যাদি বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর।
২০১০– ২০১৭ সালের মধ্যে ৭৭ কোটি টাকার মহিষ উন্নয়ন প্রকল্প-১ এর আওতায় কৃত্রিম গর্ভাধানের জন্য ইতালিয়ান ভূমধ্যসাগরীয় মহিষের ২০ হাজার ডোজ সিমেন আমদানি করা হয়।
৩৯টি উপজেলায় ২ হাজার ডোজ দেওয়া হয়, মহিষ পালকদের পশু পালনের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।
"জনবল সংকটের কারণে আমরা সেবার সব ডোজ সিমেন ব্যবহার করতে পারিনি। আমরা মাত্র ৫৫ শতাংশ ক্ষেত্রে সফলতা পেয়েছি," বলেন ওই প্রকল্পের পরিচালক তোকাব্বার হোসেন।
১৬২ কোটি টাকার মহিষ উন্নয়ন প্রকল্প-২ তে আগের প্রকল্পের পুরনো মহিষের সিমেনের মজুদ ব্যবহার করা হচ্ছে। ২০১৮ সালে শুরু হওয়া এ প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হবে ২০২৩ সালের নভেম্বরে।
"শংকর প্রজাতির নতুন এক হাজার মহিষ জন্মেছে," বলেন দ্বিতীয় প্রকল্পের পরামর্শদাতা মো. ওমর ফারুক।
২০০টি উপজেলার ৬ হাজার মহিষ পালককে প্রশিক্ষণ দেওয়ার ও প্রজননের জন্য ভারত থেকে ১০টি ষাঁড় আমদানির লক্ষ্যে এগোচ্ছে প্রকল্পের কাজ।
তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, এসব পদক্ষেপ দেশি মহিষদের রক্ষায় সহায়ক হবে না।
সেন্টার ফর পিপল অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টের পরিচালক আবদুর রহমান রানা বলেন, মাংস ও দুধের চাহিদা পূরণের জন্য মহিষের সংখ্যা বাড়াতে কোটি কোটি টাকা খরচ করছে বাংলাদেশ, কিন্তু এক্ষেত্রে মহিষের খাদ্য ও বাসস্থানের ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বিবেচনা করা হচ্ছে না।
অধ্যাপক একেএম আহসান কবির বলেন, "বিশেষত উপকূলীয় অঞ্চলের জলবায়ু পরিবর্তন বিবেচনায় রেখে মহিষের অভিযোজন প্রকল্প হাতে নেওয়ার সময় এসেছে,"
দেশি মহিষ উপকূলীয় পরিবেশের সঙ্গে অভ্যস্ত, বাথানের মতো বিস্তৃত পরিবেশে মহিষ চড়ে বেড়ায়। শংকর প্রজাতির মহিষগুলো এ পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারবে না বলে জানান তিনি।
"মহিষের সংখ্যা কমে যাওয়া ও জলবায়ু পরিবর্তনের মধ্যে সম্পর্ক নিরূপণে ও এ সমস্যা সমাধানের উপায় খুঁজে বের করতে দ্রুত এ বিষয়টি নিয়ে জরুরি ভিত্তিতে গবেষণা প্রয়োজন," বলেন ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের পরিচালক সালিমুল হক।
"দেশি মহিষের দুধ বিশেষ গুণসম্পন্ন। শংকর জাতের মহিষের দুধ থেকে তৈরি দই-পনিরের চেয়ে চট্টগ্রামের সমুদ্র তীরবর্তী দ্বীপ ও ভোলা, বরিশালের উপকূলবর্তী অঞ্চলের দেশি মহিষের দুধ থেকে তৈরি দই ও পনিরের স্বাদও বেশি," বলেন মো. ওমর ফারুক।
প্রজাতি সংরক্ষণ ও উন্নয়নের কর্মসূচি না নেওয়া হলে, দেশি মহিষ বেশিদিন টিকে থাকবে না বলে সতর্ক করেন তিনি।
তিনি আরও জানান, শংকর প্রজাতির মহিষের আবাসস্থল হিসেবে সমুদ্র তীরবর্তী দ্বীপের পরিবেশ উপযুক্ত নয়।
"আমাদের দেশি মহিষদের বিলুপ্তি থেকে রক্ষা করতে প্রজাতি সংরক্ষণ ও উন্নয়ন কর্মসূচি হাতে নেওয়ার পরামর্শ থাকবে আমার," বলেন তিনি।