মামলা যখন রাজস্ব ফাঁকির সহজ উপায়
দেশবন্ধু সুগার মিলস লিমিটেড, ব্রাজিল থেকে আমদানি করা আখের রস দিয়ে চিনি উৎপাদনের পর বাজারজাত করে। ২০১৬ সাল থেকে এ বছরের জানুযারি পর্যন্ত শুল্ক পরিশোধ না করায় প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে ৯৪৫ কোটি ২৬ লাখ টাকার রাজস্ব ফাঁকি দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে।
বিভিন্ন মামলা ও রিট পিটিশন দায়ের করে এসব পাওনা আদায়ের পথ বন্ধ রয়েছে।
সুপ্রিম কোর্ট ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সূত্রে জানা যায়, লাইসেন্সের শর্ত ভঙ্গ করে বন্ড গুদাম থেকে অবৈধভাবে কাঁচামাল অপসারণে এই রাজস্ব ফাঁকি দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
এই রাজস্ব আদায় আটকাতে হাইকোর্টে দায়ের করা দেশবন্ধুর সুগার মিলের তিনটি রিট, আপিল বিভাগে শুনানির অপেক্ষায় থাকা চারটি মামলা দ্রুত নিষ্পত্তিতে সাম্প্রতিক অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয়ে একটি চিঠি দিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)।
এনবিআরের ওই চিঠিতে বলা হয়, প্রতিষ্ঠানটির কাছে সরকারের সাকল্য পাওনা ৯৪৫ কোটি ২৬ লাখ টাকা। প্রথমে শুল্ক-করাদি পরিশোধ না করে কাঁচামাল বন্ড গুদাম থেকে অবৈধ অপসারণ এবং পরে বন্ড কমিশনারেট থেকে দাবিনামা ও বিচারাদেশ জারি করা হলে প্রতিষ্ঠানটি তার বিপরীতে মামলা করে বিপুল পরিমাণ সরকারি রাজস্ব পরিশোধ আটকে রাখার অপকৌশল গ্রহণ করছে।
চিঠিতে অ্যাটর্নি জেনারেলকে অনুরোধ করা হয় এসব মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য শুনানির উদ্যোগ নিতে।
দেশবন্ধু সুগার মিলসের বিরুদ্ধে এ সংক্রান্ত আরও ছয়টি মামলা এনবিআরের আপিল কমিশনের বিচারাধীন রয়েছে বলে চিঠিতে উল্লেখ করা হয়।
এনবিআরের চিঠি নিয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল এএম আমিন উদ্দিন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, চিঠি পাওয়ার পর অ্যাটর্নি জেনারেল অফিস দেশবন্ধু সুগার মিলের দায়ের করা রিট ও সিপি মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির উদ্যোগে নিচ্ছে। হাইকোর্টের নিয়মিত বেঞ্চ চালু হলে এসব মামলার চূড়ান্ত শুনানি করে নিষ্পত্তি করা সম্ভব হবে।
তিনি বলেন, শুধু দেশবন্ধু সুগার মিল নয়, রাজস্ব ফাঁকি দিতে হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগে আরো অনেকগুলো মামলা ও রিট নিষ্পত্তির বিষয়ে উদ্যোগ নিতে অনুরোধ জানিয়েছে এনবিআর। এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। এছাড়াও এসব মামলা পরিচালনার দায়িত্বে থাকা সংশ্লিষ্ট বেঞ্চের ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেলকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
শুধু দেশবন্ধু সুগার মিল নয়, সুপ্রিম কোর্ট ও এনবিআর থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, সারাদেশে কাস্টমস, এক্সাইজ, ভ্যাট, আয়কর ও বন্ড সংক্রান্ত ৩২,২৫৪ মামলার বিপরীতে রাজস্ব আটকে আছে ৪৯,৬৯৬ কোটি টাকা।
সুপ্রিম কোর্টে ৮,৮২৬ আপিল ও রিটের বিপরীতে ২৩,৯৫৮ কোটি টাকার রাজস্ব আটকে আছে
আপিল বিভাগে ৬৯১ আপিলে রাজস্ব জড়িত রয়েছে ৪,৭২৬ কোটি টাকা; হাইকোর্টে ৫,৩৪৭ টি রিটের বিপরীতে জড়িত ১৬,০০০ কোটি টাকা এবং হাইকোর্টে ট্যাক্স ও ভ্যাট আপিল ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে ২৭৮৮ আপিলের বিপরীতে জড়িত ৩২৩২ কোটি টাকা আটকা রয়েছে।
আপিল কমিশন ও ট্রাইব্যুনালের ২৩৭২৮ মামলার বিপরীতে আটকা ২৫৭৩৮ কোটি টাকা; কাস্টম এক্সাইজ ও ভ্যাট আপিল কমিশনে ১২,৬১৩ মামলার বিপরীতে ১০,৬৩৭ কোটি টাকা; কাস্টম এক্সাইজ ও ভ্যাট আপিল ট্রাইব্যুনাল মামলা ১০৩০৫ মামলায় ৮৬১২ কোটি টাকার রাজস্ব জড়িত রয়েছে। এছাড়াও আয়কর সংক্রান্ত ৫১০ মামলার আটকা রয়েছে ৬৪৮৯ কোটি টাকা।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর টিবিএসকে বলেন, রাজস্ব ফাঁকি দেওয়ার একটি সাধারণ উপায় হয়ে দাঁড়িয়েছে মামলা। বছরের পর বছর এসব মামলা ঝুলছে, কিন্তু নিষ্পত্তির কোন উদ্যোগ চোখে পড়ে না।
তিনি বলেন, কিছু দিন আগে এনবিআর অলটারনেটিভ ডিসপিউট রেজুলেশনের (এডিআর) মাধ্যমে রাজস্ব সংক্রান্ত অভিযোগ নিষ্পত্তির উদ্যোগ নিলেও তা কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। এখন সরকার এসব মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য আদালতের ওপর চাপ প্রয়োগ ছাড়া কোন পথ আপাতত দেখা যাচ্ছে না।
এসব মামলা নিষ্পত্তিতে এনবিআরের গাফিলতি রয়েছে আর রাজস্ব ফাঁকি দেওয়া ব্যবসায়ীরা এসব মামলা দীর্ঘমেয়াদী করতে নানাভাবে তৎপর। এই তৎপরতা ঠেকাতে সংশ্লিষ্টদের যথাযথ উদ্যোগ নেওয়ার কথা বলেন আহসান এইচ মনসুর।
ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানির জন্য বিভিন্ন মেশিন ও যন্ত্রাংশ আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান সোভিয়েত মেশিনারিজের বিরুদ্ধে ২০১০ সালে ১০৬ কোটি টাকা ভ্যাট ফাঁকির অভিযোগে মামলা করে রাজস্ব বোর্ড। ওই মামলায় কাস্টমস এক্সাইজ ও ভ্যাট আপিল কমিশন এবং ট্রাইব্যুনাল রাজস্ব বোর্ডের দাবির পক্ষে রায় যায়।
২০১৩ সালে প্রতিষ্ঠানটি কাস্টমস এক্সাইজ ও ভ্যাট আপিল ট্রাইব্যুনালের চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট করে।
রিটটি এখনো নিষ্পত্তির অপেক্ষায়।
প্রতিষ্ঠানটির পক্ষে আইনজীবী হুমায়ুন কবির টিবিএসকে বলেন, ওই রিটটি দায়েরের পর শুনানির জন্য হাইকোর্টের দৈনন্দিন কার্য তালিকায় না আসায় এখন পর্যন্ত শুনানি হচ্ছে না। ফলে রাজস্ব বোর্ডের দাবি করা ভ্যাটের বিষয়টি এখনো পেন্ডিং রয়েছে।
মামলা নিষ্পত্তি না হওয়ার কারণ
কোম্পানি আইন বিশেষজ্ঞ ব্যারিস্টার তানজীব-উল আলম টিবিএসকে বলেন, হাইকোর্টে দুইটি মাত্র বেঞ্চকে রাজস্ব সংক্রান্ত মামলা শুনানির এখতিয়ার দেওয়া হয়েছে। ওই বেঞ্চ দুইটিতে অন্যান্য দেওয়ানী মামলাও রয়েছে কয়েক হাজার। ফলে দেখা যায়, অন্যান্য মামলার শুনানিতে বেঞ্চগুলো বেশী মনোনিবেশ করছে।
তিনি বলেন, হাইকোর্টে একবারেই একটি বা দুইটি নির্দিষ্ট বেঞ্চ থাকা উচিত, যেখানে শুধুই রাজস্ব সংক্রান্ত মামলাগুলো নিষ্পত্তির উদ্যোগ নেওয়া হবে।
এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান নাসির উদ্দিন আহমেদ টিবিএসকে বলেন, এসব মামলা নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রতার জন্য অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিসের সঙ্গে এনবিআরের সমন্বয়ের অভাব রয়েছে। মামলা পরিচালনায় প্রয়োজনীয় তথ্য উপস্থাপন না হওয়া, শুনানির জন্য কার্যতালিকায় উঠানোর ক্ষেত্রে অ্যাটর্নি জেনারেল অফিসের কাঙ্ক্ষিত সহযোগিতা না পাওয়ার অভিযোগও রয়েছে।
তিনি বলেন, মামলা পরিচালনার জন্য এনবিআরের কোনো লিগ্যাল উইং নেই। রাজস্ব মামলা সম্পর্কে জ্ঞান রাখে কিংবা অ্যাটর্নি জেনারেল অফিসের সঙ্গে সমন্বয় করতে সক্ষম- এমন কর্মকর্তাও অপ্রতুল। এসব কারণে অনেক সময় কাঙ্ক্ষিত ফল আসে না কিংবা মামলায় দীর্ঘসূত্রতা তৈরি হয়।
কোনো প্রতিষ্ঠানের রিটের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট এনবিআরের আদেশ স্থগিত করার রায় দিলে এক মাসের মধ্যে সিএমপি (সিভিল মিসিলেনিয়াস পিটিশন) করতে হয়। অনেক সময়ই এনবিআরের সংশ্লিষ্ট বিভাগ এটি না করতে পারায় মামলা নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রতা তৈরি হয় বলে উল্লেখ করেন এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান।
এছাড়াও স্বল্পসময়ের জন্য এনবিআরের সমন্বয়ক কর্মকর্তা পদায়ন না হওয়া এবং এনবিআরের পর্যাপ্ত ট্রাইব্যুনাল না থাকা অন্যতম কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন নাসির উদ্দিন আহমেদ।
এনবিআরের আইনজীবী মো. লিয়াকত আলী টিবিএসকে বলেন, এনবিআর এসব মামলা নিষ্পত্তির জন্য সকল ধরনের উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু পাওনা আদায় ঠেকাতে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে মামলাগুলোর নিষ্পত্তিতে বিলম্ব করার জন্য আদালতের কাছে বার বার সময় নিচ্ছে। ফলে মামলা নিষ্পত্তিতে বিলম্ব হচ্ছে।
তবে দেশবন্ধু সুগার মিলের আইনজীবী ব্যারিস্টার শাহরিয়ার কবীর বলেন, দেশে চিনির চাহিদা পূরণ করছে বেসরকারী সুগার মিলগুলো। তারা সবাই বিদেশ থেকে র-সুগার আমদানি করে চিনি উৎপাদন করে। দেশবন্ধু ব্রাজিল থেকে এই কাঁচামাল আনে। বিদেশ থেকে র-সুগার আমদানির ওপর আগে কাস্টম ডিউটি ও আরডি ছিল না।
নতুন করে কাস্টম ডিউটি ও আরডি আরেপ করায় বেকায়দায় পড়েছে এই ব্যবসায়ীরা। দেশের প্রতিষ্ঠানের ব্যবসা সচল রাখতেই রিট করে এসব স্থগিত করা হয়েছে।
অর্থ মন্ত্রণালয়, আইন মন্ত্রণালয় ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে এসব রাজস্ব ফাঁকি ঠেকানোর উদ্যোগ নেওয়ার আহবান জানান বাংলাদেশ আইন কমিশনের চেয়ারম্যান সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক। তিনি টিবিএসকে বলেন, এসব রাজস্ব ফাঁকি ও মামলা হওয়ার পিছনে শুধু ব্যবসায়ীরাই দায়ী নয়। এরসাথে এনবিআরের অনেকেই জড়িত। এনবিআরের কর্মকর্তাদের দুর্নীতির কথা প্রায়শই শোনা যায়। এই দুর্নীতি প্রতিরোধ করতে হবে।
প্রধান বিচারপতিকে এসব মামলা নিষ্পত্তির উদ্যোগ নেওয়ার কথাও বলেন সাবেক এই প্রধান বিচারপতি।
এনবিআরের সদস্য (গ্রেড-১) আলমগীর হোসেন টিবিএসকে বলেন, ''রাজস্ব ফাঁকির মামলাগুলো দেখার জন্য আমাদের লিগ্যাল অ্যান্ড এনফোর্সমেন্ট নামে একটি বিভাগ রয়েছে। এ বিভাগ পুরানো মামলাগুলো নিয়মিত নজরদারি করেন। রাজস্ব বোর্ডের সদস্যের নেতৃত্বে কর কমিশনারগণ এ বিভাগে কাজ করেন। আয়কর বিভাগের মতো ভ্যাট এবং শুল্ক খাতেও এমনটি রয়েছে।"
"মামলা দ্রুত নিস্পত্তির জন্য এনবিআরের একটি এডিআর বিভাগ রয়েছে। এর মাধ্যমে আদালতের বাইরে উভয় পক্ষের পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে মামলা নিস্পত্তি হয়। আদালতে দ্রুত নিষ্পত্তির জন্যও অ্যাটর্নি জেনারেলের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছে আমাদের উইংগুলো," যোগ করেন আলমগীর হোসেন।