যেকোনো মূল্যে অর্থনৈতিক উত্তরণ চায় ভারত
করোনাভাইরাস লকডাউনের কালে আমদানিতে ধ্বস নামায় বৈদেশিক মুদ্রা মজুদ বাড়ে ভারতের। মজুদের প্রধান উৎস মার্কিন ডলার হওয়ায়, তার পরিমাণ ছোঁয় নতুন উচ্চতা। তবে মহামারীর স্থবিরতা কাটিয়ে উত্তরণের নবীন যে সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে, তাতে ফের আকৃষ্ট হচ্ছেন বিনিয়োগকারীরা। তাই আবারও সবুজরঙা বিদেশি মুদ্রাটির ভারতমুখী প্রবাহ বাড়ার লক্ষ্মণ দেখা যাচ্ছে।
অর্থনীতির সমীকরণ জটিল ভারসাম্য রক্ষার লড়াই। যেমন; ভারতীয় ব্যাংকগুলোর জন্য প্রবাহ বাড়ার অর্থ হচ্ছে, তার ফলে ডলার দুর্বল হয়ে স্থানীয় মুদ্রা রুপির দর বাড়বে। বিশ্ব অর্থনীতির প্রতিযোগিতামূলক বাজারে ভারত যখন আবার আগের অবস্থায় ফিরতে চায়, তখন শক্তিশালী রুপি রপ্তানিতেও নেতিবাচক প্রভাব যোগ করবে।
ভারতের আর্থিক খাতে নীতি-নির্ধারকেরা শক্তিশালী রুপির উপর চোখ বন্ধ করে ভরসা রাখতে নারাজ। কিন্তু, এখন বাজার পরিস্থিতির কারণেই তারা প্রায় নিরুপায়। হয়তো বাধ্য হয়েই রুপির নতুন দরও তাদের ঠিক করতে হবে।
সেই ঘটনা এড়াতেই কেন্দ্রীয় ব্যাংক- আরবিআই রুপির বিনিময়ে ডলার কেনা শুরু করেছে বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে। একারণে আর্থিক ব্যবসাগুলোয় যোগ হয়েছে বিপুল অর্থ। ঝুঁকি তৈরি হয়েছে আরবিআই লক্ষ্যমাত্রার চাইতেও বেশি মূল্যস্ফীতির। এ যেন চীনের পরিস্থিতির বিপরীত চিত্র। দেশটিতে বাণিজ্যিক বিরোধ কেন্দ্র করে কমেছে আন্তঃব্যাংক তারল্য।
বিদ্যমান অর্থনৈতিক সূচকগুলো অনুসারে, মহামারীর ধাক্কা কাটিয়ে ওঠা প্রথম বৃহৎ অর্থনীতি হচ্ছে চীন। অন্যদিকে, ভারতে অর্থনৈতিক প্রণোদনার জোরেই এপর্যন্ত স্থবিরতা কাটিয়ে ওঠা কিছুটা হলেও সম্ভব হয়েছে। এই অবস্থায় ২০২১ সালেও আর্থিক নীতি নিয়ে আরবিআই চলতি বছরের মতো উদারহস্ত হলে দেশটির চাঙ্গা পুঁজিবাজারে অতি-মূল্যায়নের প্রভাব যোগ হবে।
অন্যদিকে, ১৩০ কোটির বিপুল জনতাকে কোভিড প্রতিরোধী টিকা দেওয়ার আগেই তারল্য হ্রাসের উদ্যোগ নিলে বিনিয়োগকারীদের আস্থা কমবে, ফলশ্রুতিতে দরপতনের শিকার হবে পুঁজিবাজার।
তাহলে এখন আরবিআই- এর করণীয় কী? আমার ধারণা, গুরুত্বপূর্ণ এই সময়ে নিয়ামক সংস্থাটি নিজেকে প্রবৃদ্ধির বিপক্ষ শক্তি হিসাবে দেখা হোক তা অবশ্যই চাইবে না। রাজনৈতিকভাবেও সেটা কাম্য নয়। তাই এখন আরবিআই'কে আরও নমনীয় মূল্যস্ফীতি লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করতে সম্মতি দেওয়ার কথা রাজনৈতিক মহলে শোনা যাচ্ছে। লক্ষ্যমাত্রা বেশি থাকলে আকস্মিকভাবে তারল্য সংকোচনের উদ্যোগ নেওয়ার ঝক্কিও কিছুটা দূর হবে।
কর্তৃপক্ষ অবশ্য দ্বিমুখী চ্যালেঞ্জে অনেকটা উদভ্রান্ত। ডলার কমাতে তারাই বাণিজ্যিক ব্যাংকে বাড়তি তারল্য দিয়েছেন। তাদের আশা ছিল, সহজে অর্থপ্রাপ্তির সুযোগ শুধু বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের দুরাবস্থা হ্রাসে সহায়ক হবে তাই নয়, বরং সামগ্রিক অর্থনীতিতেও তা জান্তব গতি যোগ করবে।
তাইতো, আরবিআই চলতি বছরের প্রথম নয় মাসে ৫৮ বিলিয়ন ডলার কিনে নেয়। যেকারণে, এশিয়ার সবচেয়ে বাজে পারফর্মেন্স করা মুদ্রা হয়ে ওঠে ভারতীয় রুপি।
ভোক্তারা এর ফলে কী প্রভাবে পড়লেন? গত মাসে মূল্যস্ফীতির গতি ছিল কিছুটা কম ৬.৯%, কিন্তু তারপরও এটি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি। টানা আট মাসের মতো ২ - ৬% লক্ষ্যমাত্রা পরিধির চেয়ে বেশি মূল্যস্ফীতি নভেম্বরেও হয়।
এই অবস্থায় শক্তিশালী রুপি মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের সহায়ক হতে পারে; কিন্তু অতিরিক্ত তারল্য পরিস্থিতি আরও নাজুক করে তুলবে।
ভারতীয় মুদ্রার স্বল্পকালীন অবস্থানের পেছনে এগুলোই প্রধান যুক্তি। ২০২১ সালে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রক্ষণশীল পদক্ষেপ নিয়ে মুদ্রাস্ফীতির লাগাম টেনে ধরবে আর ভারতীয় রুপি হবে এশিয়ার সেরা পারফর্মার এমন আশায় বাজি ধরছেন মুদ্রা বাজারের ক্রেতারা।
নিয়ামক সংস্থাকে শক্তিশালী অবস্থান নিতেই হবে বলে মনে করেন তারা। গত জুনে সমাপ্ত প্রান্তিক পরিস্থিতিকে তারা এক্ষেত্রে উদাহরণ হিসেবে দেখান।
ওই সময়ে লকডাউনের কারণে অভ্যন্তরীণ চাহিদায় ধস নামে, কমে আমদানি। চলতি হিসাবে উদ্বৃত্ত পৌছায় ২০ বিলিয়ন ডলারে। তাই চাহিদা উত্তরণের বর্তমান ধারায় ২০২১ সালে রুপি অবমূল্যায়ন ঘটানোর মতো বাণিজ্য ঘাটতি দেখা দেবে না বলেই তারা আশা করছেন। এই সময়ে বিদেশি বিনিয়োগ আসতে থাকার কারণে বরং বিপরীত চিত্র দেখা যাবে।
সরকারি প্রতিষ্ঠান বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়া, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান অধিগ্রহণ এবং একীভুতকরণের ৬৫ বিলিয়ন ডলারের চুক্তি পাইপলাইনে রয়েছে। এগুলো কার্যকর যখন হবে তখন শিথিল মুদ্রানীতি নিয়ে বসে থাকার সুযোগ পাবে না আরবিআই। ফলে তারল্য নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ নিয়ে রুপিকে শক্তিশালী করতেই হবে।
(মূল থেকে সংক্ষেপিত)
- লেখক: শিল্প প্রতিষ্ঠান এবং আর্থিক সেবা ব্যবসা বিষয়ে ব্লুমবার্গে কলাম লেখক। তিনি ইতোপূর্বে রয়টার্সের ব্রেকিংভিউজেও লিখতেন।