যেভাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরি করে কোরিয়ান হ্যাকাররা
২০১২ সালে উত্তর কোরিয়ার হ্যাকাররা বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার চুরির পরিকল্পনা করে। নেহাত ভাগ্যজোরে ৮১ মিলিয়ন ডলার চুরির পর বিশাল অঙ্কের এই লেনদেন আটকে যায়। বাংলাদেশের আরও ৮৭০ মিলিয়ন ডলার (বাংলাদেশি মুদ্রায় ৭ হাজার ৩৭৮ কোটি টাকা) চুরি না করতে পারলেও কিন্তু পৃথিবীর সবচেয়ে গরিব ও বিচ্ছিন্ন দেশগুলোর একটি কীভাবে একদল সাইবার-অপরাধীকে এমন উঁচু দরের প্রশিক্ষণ দিতে পারল সেটিই উঠে এসেছে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা ফেডারেল ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশনের এক প্রতিবেদনে।
ঘটনার শুরু একটি ত্রুটিপূর্ণ প্রিন্টার থেকে। এমন ঘটনা অহরহই ঘটে আধুনিক জীবনে। তাই বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারাও ভেবেছিলেন এটি কোনো সাধারণ ত্রুটিই হবে। তখন একে বড় কোনো সমস্যা মনে হয়নি। কিন্তু প্রিন্টারটি সাধারণ কোনো প্রিন্টার ছিল না, তেমনি ব্যাংকটিও ছিল না কোনো সাধারণ ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংক দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক। দেশটির মূল্যবান মুদ্রা রিজার্ভে দায়িত্ব ব্যাংকটির ওপর ন্যস্ত।
এই অর্থ পাচারে ত্রুটিপূর্ণ প্রিন্টারটির ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যন্ত্রটি ছিল মতিঝিলে ব্যাংকের সদর দপ্তরের দশ তলায়, অত্যন্ত সুরক্ষিত একটি কক্ষে। প্রিন্টারটির কাজ ছিল ব্যাংকের মিলিয়ন মিলিয়ন ডলারের অর্থ লেনদেনের রেকর্ড প্রিন্ট করা।
২০১৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি এক কর্মকর্তা দেখলেন যন্ত্রটি কাজ করছে না। ডিউটি ম্যানেজার জুবায়ের বিন হুদা পরে পুলিশকে জানান, 'আমরা ভেবেছিলাম এটাও অন্যদিনের মতোই সাধারণ সমস্যা। এমন সমস্যা আগেও হয়েছে।'
তবে বাংলাদেশ ব্যাংক যে বড় ঝামেলায় পড়তে যাচ্ছে, তার প্রথম ইঙ্গিত ছিল এই ঘটনা। হ্যাকাররা ব্যাংকটির কম্পিউটার নেটওয়ার্কে ঢুকে পড়েছিল। সবচেয়ে দুঃসাহসী সাইবার আক্রমণ চলছিল সেই মুহূর্তে। আক্রমণের উদ্দেশ্য ছিল এক বিলিয়ন ডলার চুরি করা।
টাকা চুরির জন্য দলটি ভুয়া ব্যাংক অ্যাকাউন্ট, দাতব্য সংস্থা, ক্যাসিনো ও বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত বন্ধুদের সাহায্য নেয়।
কারা ছিল এই হ্যাকাররা? কোন দেশের নাগরিক তারা?
তদন্তকারীদের অনুসন্ধান আঙুল তুলেছে উত্তর কোরিয়া সরকারের দিকে।
এ ধরণের সাইবার অপরাধে উত্তর কোরিয়া যে মূল সন্দেহভাজন হতে পারে, এটা একটু আশ্চর্যের ব্যাপারই বটে। উত্তর কোরিয়া পৃথিবীর সবচেয়ে গরিব দেশগুলোর একটি। দেশটি বাকি বিশ্বের কাছ থেকে প্রযুক্তিগত, অর্থনৈতিকসহ প্রায় সব দিক থেকেই বিচ্ছিন্ন।
তবু এফবিআইয়ের মতে, বহু বছরের সুশৃঙ্খল প্রশিক্ষণের মাধ্যমে হ্যাকারদের দিয়ে হ্যাক করা হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এশিয়ার এক মিডলম্যানের মাধ্যমে, উত্তর কোরিয়া সরকারের সাহায্যে প্রশিক্ষণ পেয়েছে এই হ্যাকাররা।
উত্তর কোরিয়ার হ্যাকাররা ল্যাজারাস গ্রুপ নামে পরিচিত। বাইবেলের গল্পে ল্যাজারাস নামের এক ব্যক্তি ফিরে এসেছিল মৃতদের দেশ থেকে। তার সাথে কাজকর্মের মিল দাবি করে এ নাম নিয়েছে হ্যাকাররা।
দলটির ব্যাপারে তেমন কিছু জানা যায়নি। যদিও এফবিআই এক সন্দেহভাজনের ছবি আঁকিয়েছে। তার নাম পার্ক জিন-হিয়োক। তিনি পাক জিন-হেক ও পার্ক কোয়াং-জিং নামেও নিজের পরিচয় দেন। এফবিআই সূত্রে জানা গেছে, পার্ক জিন-হিয়োক পেশায় কম্পিউটার প্রোগ্রামার। উত্তর কোরিয়ার শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক। শিক্ষাজীবন শেষে চীনা বন্দর নগরী দালিয়ানে অবস্থিত চোসুন-এক্সপো নামে এক উত্তর কোরীয় কোম্পানিতে চাকরি নেন। অনলাইন গেম ও জুয়া খেলার প্রোগ্রাম বানানো ছিল তার কাজ।
দালিয়ানে থাকার সময় পার্ক জিন-হিয়োক একটি ইমেইল অ্যাড্রেস ও সিভি বানিয়ে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে নিজস্ব নেটওয়ার্ক গড়ে তোলেন।
জানা যায়, ২০০২-এর দিকে তিনি দালিয়ানে ছিলেন। ২০১৩-১৪ পর্যন্ত সেখানে যাতায়াত ছিল তার। তারপর এফবিআইয়ের সূত্রমতে, তার ইন্টারনেট কার্যক্রম চালানো হয় উত্তর কোরিয়ার রাজধানী পিয়ংইয়ং থেকে।
সংস্থাটি পার্কের ২০১১ সালের একটি ছবি উদ্ধার করেছে। ছবিটি চোসুন এক্সপোর এক ম্যানেজার এক ক্লায়েন্টের কাছে ছবিটি পাঠিয়েছিলেন। উদ্ধারকৃত ছবিটি একজন কোরীয় ব্যক্তির, ৩০ ছুঁই ছুঁই বয়স। পরনে কালো শার্ট ও চকোলেট-বাদামি রঙের স্যুট। প্রথম দেখায় মনে হবে, একেবারেই সাধারণ একজন মানুষ।
তবে এফবিআই বলছে, দিনের বেলায় পার্ক ছিলেন প্রোগ্রামার আর রাতে হ্যাকার। ২০১৮ সালের জুনে মার্কিন কর্তৃপক্ষ তার বিরুদ্ধে কম্পিউটারের অপব্যবহার ও জালিয়াতির অভিযোগ আনে। সেইসাথে ইমেইল অথবা বৈদ্যুতিক যোগাযোগমাধ্যমে জালিয়াতির অভিযোগও আনা হয় তার বিরুদ্ধে। ধরা পড়লে তাকে ২০ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হবে।
পার্ক কিন্তু রাতারাতি হ্যাকার বনে যাননি। হাজার হাজার উত্তর কোরীয়কে শৈশব থেকে সাইবার যোদ্ধা হওয়ার প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। এই পার্ক তাদেরই একজন। যেসব ১২ বছর বয়সি শিশু অঙ্কে ভালো হয়, তাদেরকে রাজধানীতে নিয়ে গিয়ে কঠোর প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।
আবার বাংলাদেশ ব্যাংকে ফিরে আসা যাক। কর্মকর্তারা প্রিন্টারটি বন্ধ করে ফের চালু করতেই কয়েকটা উদ্বেগজনক খবর পান। যন্ত্রটি থেকে বার্তা আসছিল যে নিউ ইয়র্কের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকে কিছু জরুরি বার্তা পাঠানো হয়েছে। এই ব্যাংকে বাংলাদেশ ব্যাংকের মার্কিন ডলারের অ্যাকাউন্ট আছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পুরো অ্যাকাউন্টের অর্থ ছাড় করতে নির্দেশনা পেয়েছে ফেডারেল ব্যাংক। মোট টাকার পরিমাণ প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার!
সঙ্গে সঙ্গে ফেডারেল ব্যাংকের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করে বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু হ্যাকারদের নিখুঁত সময়জ্ঞানের কারণে তা সম্ভব হয়নি।
হ্যাকিং শুরু হয়েছিল বাংলাদেশ সময় ৪ ফেব্রুয়ারি, বৃহস্পতিবার রাত ৮টায়। তখন নিউইয়র্কে বৃহস্পতিবার সকাল। রাত আটটায় বাংলাদেশে ব্যাংকিং কার্যক্রম বন্ধ ছিল, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে তখন সব কার্যক্রম চলছে পুরোদমে। পরদিন শুক্র ও শনিবার বাংলাদেশে দুদিন সাপ্তাহিক ছুটি। শনিবারে যখন বাংলাদেশে চুরির ঘটনা জানাজানি হয়, ততক্ষণে নিউইয়র্কের সাপ্তাহিক ছুটি শুরু হয়ে গেছে।
কাজটি সুপরিকল্পিতভাবে করেছিল হ্যাকাররা। এর ফলে তারা চুরির পর প্রায় ৩ দিন সময় পায়।
এর পর হ্যাকাররা আর দারুণ একটা বুদ্ধি খাটায়। ফেড, অর্থাৎ ফেডারেল ব্যাংক থেকে টাকা বের করার পর ওটা অন্য কোথাও সরিয়ে নেওয়ার দরকার পড়ল। এই কাজের জন্য তারা ফিলিপাইনের ম্যানিলায় একটা অ্যাকাউন্ট খুলে রেখেছিল। টাকাটা তারা ওখানে পাঠিয়ে দেয়। ২০১৬-র ৭ ফেব্রুয়ারি, বৃহস্পতিবার ছিল চান্দ্র বছরের প্রথম দিন। এশিয়াজুড়ে ছুটির দিন।
তিন দেশের এই সময় ব্যবধানকে কাজে লাগিয়ে হ্যাকাররা টাকা পাচারের জন্য পুরো পাঁচ দিন পেয়ে যায়।
বিস্তর সময় নিয়ে এই পুরো কাজের পরিকল্পনা করেছিল তারা। জানা গেছে, পুরো একটা বছর তারা বাংলাদেশ ব্যাংকের কম্পিউটার সিস্টেমে ঘুরে বেড়িয়েছে।
২০১৫-র জানুয়ারিতে একটি নিরীহদর্শন ইমেইল যায় বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মচারীদের কাছে। মেইলটি গিয়েছিল রাসেল আহলাম নামের এক চাকরিপ্রার্থীর কাছ থেকে। তাতে একটি ওয়েবসাইট থেকে তার সিভি ডাউনলোড করার অনুরোধ ছিল। কিন্তু বাস্তবে এই নামে কোনো ব্যক্তির অস্তিত্ব নেই। এটি আসলে ল্যাজারাস গ্রুপের ব্যবহৃত একটি ছদ্মনাম। বাংলাদেশ ব্যাংকের অন্তত একজন এই ফাঁদে পা দেন। ডকুমেন্টটি ডাউনলোড করে ওটার মধ্যে থাকা ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হয় তার কম্পিউটার।
ব্যাংকের সিস্টেমে ঢুকে যাওয়ার পর ল্যাজারাস গ্রুপটি নানা কম্পিউটারে ঘুরে ঘুরে বিলিয়ন ডলারে প্রবেশাধিকার হাতিয়ে নেয়। তারপর হুট করে চুপ মেরে যায় দলটি।
ব্যাংকে সন্দেহজনক ইমেইল পাঠানোর পরও পুরো এক বছর চুপ করে বসে ছিল কেন হ্যাকাররা? ধরার পড়ার ঝুঁকি নিয়ে পুরোটা সময় ব্যাংকের সিস্টেমে লুকিয়ে ছিল কেন?
কারণ সম্ভবত টাকা পাচারের পথ ঠিক করার জন্য তাদের সময়ের দরকার ছিল।
২০১৫ সালে মে-তে, বাংলাদেশ ব্যাংকের সিস্টেমে ঢোকার কয়েক মাস পর, ম্যানিলার জুপিটার স্ট্রিটের আরসিবিসি ব্যাংক শাখায় চারটি অ্যাকাউন্ট খোলে হ্যাকারদের সহযোগীরা। কাজটির পর সন্দেহজনক কয়েকটি চিহ্ন দেখা দেয়। হিসাব খোলার জন্য ব্যবহৃত ড্রাইভিং লাইসেন্সগুলো ছিল ভুয়া। সব আবেদনকারীই একই পদে একই বেতনে চাকরি করেন বলে লেখেন, যদিও তারা চাকরি করতেন ভিন্ন ভিন্ন কোম্পানিতে। কিন্তু ব্যাপারটা কারও চোখেই পড়েনি। কয়েক মাস হিসাবগুলো ৫০০ ডলার নিয়ে অলস পড়ে থাকে।
২০১৬-র ফেব্রুয়ারিতে হ্যাকাররা চূড়ান্ত প্রস্তুতি সম্পন্ন করে।
তবে একটা শেষ বাধা ছিল তাদের সামনে—বাংলাদেশ ব্যাংকের দশ তলার প্রিন্টার। বাংলাদেশ ব্যাংক তার নিজস্ব সমস্ত লেনদেনের সমস্ত রেকর্ড তাৎক্ষণিক কাগুজে দলিলে সংরক্ষণ করে। লেনদেনের এই রেকর্ডের কারণে হ্যাকারদের কুকীর্তি সঙ্গে সঙ্গে ফাঁস হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি ছিল। সেজন্য তারা ওই প্রিন্টারকে নিয়ন্ত্রণকারী সফটওয়্যারকে হ্যাক করে তারপর কাজে নামে।
সব গুছিয়ে এনে ২০১৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি তারা কাজে নামে। মোট ৩৫টি বার্তা পাঠিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিউ ইয়র্ক ফেড অ্যাকাউন্ট থেকে ৯৫১ মিলিয়ন ডলার স্থানান্তর করে নেয় তারা।
টাকা চুরির ঘটনা জানাজানি হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সাইবার বিশেষজ্ঞ রাকেশ আস্তানার শরণাপন্ন হয় বাংলাদেশ ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর তখনও আশাবাদী ছিলেন যে টাকাটা পুনরুদ্ধার করতে পারবেন। সেজন্য হ্যাকের ঘটনা কেবল জনগণ নয়, সরকারের কাছ থেকেও গোপন রাখেন তিনি।
রাকেশ অনুসন্ধান করে জানতে পারেন চোরেরা বাংলাদেশ ব্যাংকের সিস্টেমের মূল অংশ, 'সুইফট'-এ ঢুকে পড়েছিল। ব্যাংক কর্তৃপক্ষ অচিরেই জানতে পারেন যে টাকা ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়। কিছু টাকা ইতিমধ্যে ফিলিপাইনে পৌঁছে গেছে। সেখান থেকে টাকা ফিরিয়ে আনার জন্য আদালতের আদেশ প্রয়োজন। আদালতের আদেশ যেহেতু প্রকাশ্য দলিল, কাজেই ঘটনাটা গোটা দুনিয়ায় জানাজানি হয়ে গেল। এর ফলে প্রায় তৎক্ষণাৎ পদত্যাগ করতে হয় বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকে।
ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক থেকে এত বড় অর্থ পাচারের ঘটনায় রীতিমতো আতঙ্কিত হয়ে পড়েন যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস সদস্য ক্যারোলিন ম্যালোনি। তিনি ফেডের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানতে পারেন, প্রায় পুরো টাকাটাই পাচার হয়ে যাওয়া ঠেকানো গেছে ছোট্ট কাকতালীয় ঘটনার কল্যাণে।
আরসিবিসি ব্যাংকের যে শাখায় টাকা স্থানান্তরের চেষ্টা করেছিল হ্যাকাররা, সেটি জুপিটার স্ট্রিটে। অন্যান্য ব্যাংক রেখে আরসিবিসিকে বেছে নেওয়ায় একশো মিলিয়ন ডলারের মূল্য চুকাতে হয়েছে তাদের। একটি অর্ডারের ঠিকানায় 'জুপিটার' শব্দটি লেখা থাকায় টাকা স্থানান্তর বন্ধ করে দেয় ফেড। কারণ, এই নামে আমেরিকার নিষেধাজ্ঞা পাওয়া একটি ইরানী জাহাজ আছে।
এই একটি শব্দই ফেডের স্বয়ংক্রিয় কম্পিউটার সিস্টেমে অ্যালার্ম বাজিয়ে দেয়। অর্থ স্থানান্তর আবার খতিয়ে দেখা শুরু হয়, বেশিরভাগ স্থানান্তর কার্যক্রমই বন্ধ করে দেয়া হয়। তবে ১০১ মিলিয়ন ডলারের পাঁচটি স্থানান্তর সম্পন্ন হয়ে যায়।
এই টাকার ২০ মিলিয়ন ডলার গেছে শালিকা ফাউন্ডেশন নামে একটি শ্রীলঙ্কান দাতব্য সংস্থায়। সংস্থাটির প্রতিষ্ঠাতা শালিকা পেরেরা বলেন, তিনি ভেবেছিলেন টাকাগুলো আসলেই অনুদান হিসেবে এসেছিল। কিন্তু এবারও ছোট্ট একটা ভুল হ্যাকারদের প্ল্যান ভেস্তে দেয়। টাকা স্থানান্তর হয়েছিল 'শালিকা ফান্ডেশন'-এ (Fundation)। এক তীক্ষ্ণচোখ ব্যাংক কর্মকর্তা ছোট্ট এই বানান ভুলটি ধরে ফেলেন। সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ হয়ে যায় অর্থ স্থানান্তর।
ফলে ৮১ মিলিয়ন ডলার সরাতে পারে হ্যাকাররা। পুরো ৯৫১ মিলিয়ন ডলার ( বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা) না হারালেও, এই ৮১ মিলিয়ন টাকা হারিয়ে ভীষণ ধাক্কা খায় বাংলাদেশ। এই টাকা ফেরানোর উদ্যোগ নেওয়ার আগেই হ্যাকাররা ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যায়।
৫ ফেব্রুয়ারি শুক্রবার, আরসিবিসির জুপিটার স্ট্রিটে খোলা চারটি অ্যাকাউন্ট আচমকা ফের সক্রিয় হয়ে ওঠে।
পাচার করা টাকাগুলো বিভিন্ন অ্যাকাউন্টে লেনদেন করে, একটি মুদ্রা বিনিময় ফার্মে পাঠিয়ে, তারপর স্থানীয় মুদ্রায় রূপান্তরিত করে আবার ব্যাংকে জমা করা হয়। অর্থ পাচারের এক সুনিপুণ কায়দা এটি।
এরপরও তদন্তকারীদের পক্ষে টাকা পাচারের পথ শনাক্ত করা সম্ভব ছিল। একেবারে উধাও হয়ে যাওয়ার জন্য টাকাগুলোকে ব্যাংকিং সিস্টেম থেকে সরিয়ে ফেলতে হতো।
বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে টাকা চুরি করে চোরেরা পরবর্তী ধাপের কাজ সম্পন্ন করে ম্যানিলার প্রমোদ ভবন 'সোলেয়ার'-এ। এখানকার ক্যাসিনোতে কাজটা সারে তারা। চুরির ৫০ মিলিয়ন ডলার তারা সলেয়ার ও আরেকটি ক্যাসিনো 'মাইডাস'-এর অ্যাকাউন্টে জমা রাখে। তদন্তকারীদের মতে, বাকি ৩১ মিলিয়ন ডলার শু উইক্যাং নামের এক চীনা ব্যক্তিকে পরিশোধ করা হয়। তবে তার খোঁজ আর পাওয়া যায়নি।
ক্যাসিনো ব্যবহার করা হয়েছিল অর্থ পাচারের পথ যেন শনাক্ত করা না যায়। চুরির টাকাগুলো ক্যাসিনো চিপে রূপান্তরিত করে, জুয়ার টেবিলে পাঠিয়ে ফের নগদ টাকায় রূপান্তর করার পর এই টাকার উৎস বের করা প্রায় অসম্ভব।
প্রশ্ন জাগতে পারে, টাকাটা জুয়ার টেবিলে খোয়ানোর ভয় ছিল না চোরেদের? মোটেই না।
প্রথম কারণ, হ্যাকাররা প্রাইভেট রুম বুক করে নিজেদের লোক দিয়ে ভরে দিয়েছিল পুরো কামরা। অর্থাৎ জুয়া খেলেছে তাদের নিজেদের লোকেরাই।
দ্বিতীয় কারণ, চুরির টাকা দিয়ে তারা ব্যাকারাট খেলেছে। এশিয়ার জনপ্রিয় এই খেলাটি খুবই সহজ। বাজিতে দুটো ফল আসা নিশ্চিত। এই খেলায় অভিজ্ঞরা প্রায় ৯০ শতাংশ টাকা তুলে আনতে পারেন।
কয়েক সপ্তাহ ম্যানিলার ক্যাসিনোতে বসে থেকে টাকা সাদা করতে লাগল অপরাধীরা।
এই সময়ের মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা ম্যানিলা ঘুরে গেছেন। টাকা পাচারের পথ প্রায় খুঁজে বের করে ফেলেছেন। ক্যাসিনো কর্তৃপক্ষ বলেছে টাকাগুলো বৈধ জুয়াড়িরা জমা দিয়েছে। জুয়া খেলার সম্পূর্ণ অধিকার তাদের ছিল। সোলেয়ার ক্যাসিনো দাবি করেছে, তাদের এখানে চুরির অর্থ লেনদেন হচ্ছে এ ব্যাপারে তাদের কোনো ধারণা ছিল না।
চুরি যাওয়া অর্থ থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক ১৬ মিলিয়ন ডলার উদ্ধার করতে পেরেছে। টাকাটা উদ্ধার হয়েছে মাইডাস ক্যাসিনোতে কিম উং নামে এক ব্যক্তির কাছ থেকে। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হলেও পরবর্তীতে সে অভিযোগ তুলে নেয়া হয়। বাকি ৩৪ মিলিয়ন ডলার ম্যাকাও হয়ে পাচার হয়।
ম্যাকাওয়ে নির্বাসিত ছিলেন উত্তর কোরিয়ার সর্বোচ্চ নেতা কিম জং-উনের সৎ ভাই কিম জং-নাম। এখানে এক নারী গুপ্তচরকে রেখেও প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। ১৯৮৭ সালে তিনি একটি কোরিয়ান বিমান উড়িয়ে দেন বোমা মেরে।
যাহোক, সোলেয়ারে জুয়ার আয়োজন করা অনেকের খোঁজ পাওয়া যায় ম্যাকাওয়ে। যে দুটো কোম্পানি সোলেয়ারে প্রাইভেট রুম বুক করেছিল, ওগুলোও ম্যাকাওভিত্তিক। অনুসন্ধানকারীদের বিশ্বাস, উত্তর কোরিয়ায় পাঠানোর আগে চুরি যাওয়া টাকার বেশিরভাগই চীন নিয়ন্ত্রিত এই ম্যাকাওয়ে ছিল।