রংপুরে কফি চাষের উজ্জ্বল স্বপ্ন
রংপুরে চায়ের চাষ হচ্ছে অনেক আগে থেকেই। এর সঙ্গে যোগ হল কফি। আর এই কফি চাষের পথপ্রদর্শক হলেন রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার গোয়ালবাড়ি গ্রামের যুবক মোখলেছুর রহমান।
তিনি ২০১৭ সালে কক্সবাজারের একটি নার্সারি থেকে ৮শ কফি গাছের চারা নিয়ে এসে তার ২৮ শতক জমিতে কফির চাষ শুরু করেন। বর্তমানে তার বাগানে টিকে আছে ৪৫০টির মতো গাছ।
গাছগুলোর বয়স পঁচিশ বছরের উপরে, একবার ফল থেকে আড়াই লক্ষ টাকার কফি বীজ বিক্রি করেছেন। একটি গাছে ফল ধরে প্রায় তিন হাজার। আর একটি ফল থেকে বীজ আসে বারোটা। তাতে অন্তত ২০ থেকে ৩০ জনের কফি পাওয়া যায়।
মোখলেছুর রহমান জানান, তার গাছের বয়স তিরিশ পূরণ হলে আরও ফলন বাড়বে তখন প্রায় কোটি টাকার মতো কফি তিনি বিক্রি করতে পারবেন।
তিনি বলেন, 'দেড় বছরে বাগানের অল্প কিছু গাছে প্রথম কফি ফুল ফোটে। তারপর কফিগুটি। পরিপক্ক হওয়ার পর ৬ কেজি শুকনো কফি বীজ পাই আমি। এই বীজ পরিস্কার করে রোদে শুকিয়ে উপরের পাতলা শক্ত আবরণটি ভেঙ্গে ফেলি, তারপর গুড়ো কফি।'
কফির এই সফল চাষে তিনি এখন আশা করছেন কফির বাণিজ্যিক চাষাবাদের, তিনি কৃষি বিভাগের সঙ্গে যোগাযোগ করে পরামর্শও নিচ্ছেন নিয়মিত।
কৃষিবিভাগ থেকে জানা যাচ্ছে, মোখলেছুর রহমানের ৪৫০টি গাছের প্রায় সব কটিতেই ফল ধরেছে এবং এ বছর সবকটি গাছ থেকে প্রথমে ৩০ কেজি শুকনো কফি বীজ পাবেন বলে তিনি আশা করছেন।
মোখলেছুর রহমানের কফি বাগানের দেখাদেখি তারগঞ্জেই এখন প্রায় এক বিঘার কফি বাগান হয়েছে। চারা নিয়ে এলাকায় কফি চাষে আগ্রহী কৃষকের সংখ্যাও বাড়ছে দিনকে দিন। চাষীরা মনে করছেন কফি চাষ করে অর্থনৈতিক ভাবে লাভের মুখ দেখা সম্ভব। তবে কফি চাষের জন্য একটা লম্বা সময় অপেক্ষা করতে হয়। পরিপূর্ণ ফলনে যেতে বেশ সময় লাগে।
কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ থেকে আরও জানা যায়, উত্তরাঞ্চলে এখন ব্যাপকভাবে চা চাষ হচ্ছে, রংপুরের এই অঞ্চলের মাটি চা ও কফি চাষের জন্য যথেষ্ট উপযুক্ত। এ কারণে আগ্রহী কফি চাষীকে তারা সব রকম সহয়তা দিচ্ছেন।
রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক সরোয়ারুল আলম জানান, রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলাসহ বেশ কয়েকটি উপজেলার মাটি জলবায়ুর কারণেই কফি চাষের উপযোগী। কফি চাষ করতে অমিয় মাটর (কম খরা সম্পন্ন মাটি) প্রয়োজন হয়। তাই এ অঞ্চলের মাটি বাণিজ্যিকভাবে কফি চাষ উপযোগী। রংপুরে কফি চাষ জনপ্রিয় করতে কৃষি বিভাগও কফির চারা উৎপাদন করছে।
তিনি আরও বলেন, আগামী ৫ বছরে এ অঞ্চলের উৎপাদিত কফি দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানি করাও সম্ভব হবে।
রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার গোয়ালবাড়ী গ্রামের দেলোয়ার রহমান জানান, মোখলেসুর রহমানের কফি চাষ দেখে তিনিও ৩০ শতক জমিতে চারা রোপন করছেন। আর এক বছর পরই তার গাছে কফি আসবে।
তিনি আরও জানান, শুধু এই তারাগঞ্জ উপজেলায় নয় রংপুরের অন্য উপজেলায়গুলোও কফি চাষের দিকে ঝুঁকছে। ফলে আর কয়েক বছরের মধ্যেই রংপুর অঞ্চলে ব্যপক কফি চাষ হবে বলে দেলোয়ার রহমান মনে করেন।
গোয়ালবাড়ি গ্রামের আরেক কফি চাষি মাহাবুবার রহমান জানান, তার ছেলেকে নিয়ে কফিচাষ শুরু করেছেন। তার বাগানের গাছেও এখন ছোট ছোট ফল এসেছে।
এখানকার কৃষি বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলেও জানা যায়, এ অঞ্চলে চা চাষ শুরু হয়েছে খুব বেশী দিন হয় না, উত্তরাঞ্চলে চা চাষের সফলতা থেকেই বোঝা যায় এখানে কফি চাষেরও উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে। আর দেশের পার্বত্য জেলাগুলোতেও বেশকিছু কফি বাগান গড়ে উঠেছে। সেখানকার কফি এখন দেশের বড় বড় সুপার শপে পাওয়া যাচ্ছে।
তারাগঞ্জ উপজেলা কৃষি অফিস থেকে জানা গেছে, কফি চাষের জন্য উষ্ণ (২০-৩০ ডিগ্রি সে. তাপমাত্রা) ও আর্দ্র জলবায়ু এবং বার্ষিক ১৫০-২০০ সে.মি. বৃষ্টিপাত প্রয়োজন। আর ফল পরিপক্ক হওয়ার সময় শুস্ক আবহাওয়া প্রয়োজন পড়ে। মৃদু অম্লধর্মী এবং লৌহ, পটাশ, নাইট্রোজেন ও জৈবসমৃদ্ধ উর্বর লালচে দো-আঁশমাটি কফি চাষের পক্ষে আদর্শ। এছাড়াও তীব্র সূর্যালোকের হাত থেকে কফি গাছকে রক্ষার জন্য বাগানের মধ্যে ছায়া প্রদানকারী যেমন- ইপিল, একাশিয়া, কলা প্রভৃতি গাছ লাগানো প্রয়োজন। আবহাওয়াগতভাবে রংপুর আদর্শ।
তারাগঞ্জ উপজেলা কৃষি অফিসার উর্মি তাবাসসুম বলেন, এখানকার মাটি এবং জলবায়ু চা ও কফি চাষের উপযোগী। কৃষকরা নায্যমূল্যে কফি বাজারজাত করতে পারলে তারাগঞ্জে কফি চাষে আরও চাষী ঝুঁকে পড়বে।
তারাগঞ্জ উপজেলার কফি দেশের চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি আমদানী নির্ভরতা কমাতেও বিশেষ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে বলে মনে করেন এই কর্মকর্তা।