রোবটের কাছে চাকরি হারিয়ে মানুষ কোথায় যাবে?
যুক্তরাষ্ট্রের মতো শিল্পোন্নত দেশে চাকরির বাজার নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে জনমনে, যার কারণও সঙ্গত। বর্তমান দুনিয়ার প্রেক্ষাপটে প্রযুক্তি ও বাণিজ্য বিরোধ বদলে দিচ্ছে উৎপাদনের ব্যবস্থা। তাই অনেক কর্মী এক সময় চাকরি হারাবেন এটাই নয়া বাস্তবতা। কিন্তু, তাই বলে তো আর যুগের হাওয়া বদলকে থামিয়ে রাখা যায় না। সরকারেরও উচিত সম্পূর্ণ অর্থনীতি অচল করে ফেলার বদলে চাকরি হারানো মানুষ যেন দ্রুত নতুন চাকরি খুঁজে পান- সে ব্যাপারে সহায়তা দেওয়া। এতে করে কর্মীরাও আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার দুর্ভোগমুক্ত থাকবেন।
মার্কিনীরা অনেক বছর ধরে শুনে আসছেন উন্নত শ্রেণির রোবটেরা তাদের সকল কাজ কেড়ে নিতে আসছে। মহামারি এ ভয়কে বাস্তবতার জমিনের আরও কাছে নামিয়ে আনে। কারণ, সরবরাহ বিঘ্ন এড়াতে ব্যবসায়িক উদ্যোক্তারা শ্রমিক সাশ্রয়ী স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র স্থাপনে বিনিয়োগ বাড়াতে বাধ্য হয়েছেন।
রেস্তরাঁয় কিউআর কোড ব্যবহার করে খাবার অর্ডার করার মতো উদ্ভাবনী তরিকা নিঃসন্দেহে উৎপাদনশীলতা বাড়াচ্ছে, যা অর্থনীতির জন্যে যেমন ভালো; ঠিক তেমনি এক সময় হয়তো বেতন বাড়াবে। কিন্তু, শিল্পে শ্রম সংকট সমাধানের প্রাথমিক ধাক্কা কেটে যাওয়ার পর স্বয়ংক্রিয়তার যে যুগ আসবে, সেখানে হয়তো চাকরির বিজ্ঞাপন কমে যাবে অনেকাংশে। কারণ, ততোদিনে কমবে মানব কর্মীর চাহিদাও।
দীর্ঘমেয়াদে তাতে সমস্যা তেমন নেই; মানুষজনও এক সময় নতুন চাকরি খুঁজে পাবে। কারণ, শ্রম সাশ্রয়ী উদ্ভাবনগুলো যে সম্পদ সৃষ্টি করবে, তাতে আপনা থেকেই বাড়বে চাহিদা। সে চাহিদা পূরণে বিকশিত ও বিস্তৃত হবে নতুন শিল্প; যেখানে কাজের সুযোগ পাবেন ইতঃপূর্বে চাকরি হারানো কর্মীরা। শিল্প বিপ্লবের পর থেকে যন্ত্র ও মানবিক কর্মক্ষেত্রের পরিবেশে সব সময় এমন ধারাবাহিকতা দেখা গেছে। তবে শঙ্কা হলো; মানুষের আবিষ্কৃত প্রযুক্তির ঢেউ এবার যদি এতোই উন্নত হয় যে কোনো কর্মীরই দরকার হবে না- তাহলেই সমূহ বিপদ। কিন্তু, এখনই তেমনটা ঘটার সম্ভাবনাও খুবই কম। তাই নির্ভার হয়ে বলা যায়, নতুন চাকরি অন্য খাতের হাত ধরে আবারো ফিরে আসবে।
তবে অতি-দীর্ঘ মেয়াদের হিসাব টানলে; এক সময় আমরা সকলেই মারা যাব, তাই আমাদের স্বল্প মেয়াদী ভাবনাকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া উচিত- একদা এমন পরামর্শ দিয়েছিলেন প্রখ্যাত ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ জন মেনার্ড কেইনস। এবং অধুনা বাস্তবতাও তাই।
চাকরির বাজারে স্বল্প মেয়াদী ঘটনা নিয়েই মানুষকে ভাবতে হচ্ছে। স্বল্প মেয়াদে এধরনের চাকরি হারিয়ে যাওয়ার গতি নিয়ে কর্মীদের সঙ্গত কারণেই ভীতসন্ত্রস্ত হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। কর্মসংস্থান হারালো কর্মী ও তাদের পরিবার অনেক মূল্য দেয়: অনিশ্চয়তার মধ্যে এরপর কী করা উচিত- তা নিয়ে যেমন দুশ্চিন্তার অন্ত থাকে না, তেমনি স্বাস্থ্য বিমার সুরক্ষা হারানো এবং নতুন কোনো স্থানে কাজের খোঁজে সপরিবারে চলে যাওয়ার খরচও বোঝাস্বরূপ ঘাড়ে এসে চাপে।
মালিকপক্ষ নতুন একটি মেশিন বসালেন এবং সেটির উৎপাদন শুরু হওয়া মাত্রই চাকরি হারানো কর্মীদের অন্যত্র চলে যেতে হচ্ছে, তাদের জীবনযাত্রা সংকটে পড়ছে; এমন দৃশ্যপট চরম অন্যায্যই মনে হয়। এ অবস্থায় জনমনের ভীতি প্রযুক্তির বিকাশকে পরিত্যাগের চাপ সৃষ্টি করলে জাতীয় অর্থনৈতিক উত্তরণ বাধাগ্রস্ত হতে পারে।
তাই এসব ঝুঁকি ও মূল্যদানকে প্রশমিত করতে নানা উপায়ে সরকার সহায়তা করতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় স্বাস্থ্য বিমা এমন সহায়তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। এর মাধ্যমে চাকরি হারালেও কর্মী চিকিৎসা সেবা পাওয়ার সুযোগ বঞ্চিত যেন না হন- তেমন উদ্যোগ নেওয়া যায়। ফলে কর্মস্থল পরিবর্তন নিয়ে কর্মীদের উদ্বেগ কমবে, এমনকি তারা অন্যত্র আরও ভালো চাকরির সন্ধান করার সময়েও স্বস্তিতে থাকবেন। এমন সহায়তার আরেকটি বড় উদাহরণ; ডাচ সরকারের 'ফ্লেক্সিকিউরিটি' ব্যবস্থা, যার আওতায় কর্মীদের শিক্ষা, পুনঃপ্রশিক্ষণ ও চাকরি খোঁজার সহায়তা দেওয়া হয়।
তবে এমন ব্যবস্থা মার্কিন কর্মী গোষ্ঠীর নির্দিষ্ট কোনো ধরনের চাকরি হারানোর ভয় কমালেও, সম্পূর্ণরূপে নতুন পেশা বেঁচে নেওয়ার সংশয় ও উদ্বেগ মুক্ত করবে না।
যখন এক বা একাধিক শিল্পের প্রতিটি স্তরে প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের কারণে শ্রমের চাহিদা কমে, তখন কর্মীদের শুধু নতুন কর্মদাতা খুঁজতে হয় না, বরং সম্পূর্ণ নতুন পেশায় যাওয়ার প্রয়োজন হয়। রেস্তোরার সাধারণ একজন ওয়েটার বা ক্যাশিয়ারের জন্যেও নতুন পেশার সন্ধান করার ভাবনা তাই ভীতিজনকও বটে।
চাকরি হারানোর দুশ্চিন্তাগ্রস্ত প্রায় সকলের মনে তাই একটাই প্রশ্ন: বেকার কর্মীদের জন্য কোন ধরনের নতুন চাকরির সুযোগ তৈরি হবে?
অতীতে যখন কর্ম এতোটা বিশেষায়িত হয়নি, তখন এই প্রশ্নের উত্তর সহজে দেওয়া যেত। সে সময় কৃষি খামারে চাকরি হারানো মানুষ কারখানায় যোগ দিত। কারখানায় তাদের প্রয়োজন ফুরালে, করতে পারতেন নথিপত্রের কাজ বা অন্য কিছু। সাম্প্রতিক দশকগুলোয় নানান প্রকার স্থানীয় পরিষেবা যেমন; খাবার ডেলিভারি, স্বাস্থ্য সেবা, অবসর ও আতিথেয়তার খাত প্রায় একই রকম কিন্তু ভিন্ন ভাবে চাকরির সুযোগ প্রদান করেছে। তখন আরও ভালো কাজের সুযোগ যাদের নেই- তাদের সিংহভাগই টেবিলে খাবার পরিবেশন, অতিথিশালার কর্মী বা চিকিৎসকের কার্যালয়ে অপেক্ষমাণ রোগীর সাড়ি নির্ধারণের মতো ছোটখাট কাজ করেছেন।
কর্মীদের শেষ আশ্রয়:
মহামারি আঘাত হানার আগে খাদ্য পরিবেশন, অবকাশ ও স্বাস্থ্য খাতে নিয়োজিত কর্মীর সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছিল।
কিন্তু, শিল্পগুলো বিভাজিত হওয়া শুরু করায় কর্মের বিশেষায়িতকরণ নতুন গতি পায়। তাই কর্মী চাহিদার পরবর্তী বিপ্লব কোন খাতে দেখা দেবে তা অনুমান করা কঠিন হয়ে পড়েছে। এখনকার যুগে কোনো শিল্পের বিকাশ মানেই সেখানে কর্মসংস্থানের নিশ্চিত সুযোগ নয়, বরং নির্দিষ্ট রূপে ওই শিল্পে আপনি কোন ভূমিকাটি রাখতে পারবেন- তার ওপর নির্ভর করছে জীবিকার সুযোগ। এমন বিশেষায়িত যোগ্যতা না থাকলে তার জন্য আলাদা প্রশিক্ষণও আপনাকে সক্ষম করে তুলবে। তাই আগামীদিনের পরিকল্পনা করাটাও বহুমাত্রায় জটিল। যন্ত্রায়নের যুগে সবচেয়ে কম বেতনের বা টুকিটাকি কাজ করার জন্যেও কোম্পানিগুলো এখন সহজে কর্মী নিয়োগ দেয় না, যা সমস্যাকে আরও বহুগুণে বাড়িয়ে তুলেছে।
নিয়োগের এই সমস্যাটি সমাধানেও সরকারি সহায়তা দেওয়ার অবকাশ রয়েছে। আগামী ১০ বছরে কোন কোন পেশার দ্রুত বৃদ্ধি ঘটবে শতাংশ হারে তার একটি পূর্বাভাস দিয়ে থাকে মার্কিন সরকারের শ্রম পরিসংখ্যান ব্যুরো। এছাড়া, যেসব খাতে মোট কর্মসংস্থানের সবচেয়ে বেশি নিয়োগ হবে তারও আভাস দেয় সংস্থাটি। সরকারি ও তথ্য পরিষেবা জনগণকে ভবিষ্যতের কর্ম পরিবেশ সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণাও দিতে পারে। তবে এজন্য বিশেষ কিছু পরিবর্তনও প্রয়োজন।
কর্মসংস্থান যেভাবে নিশ্চিত হবে:
নানান ধরনের পেশাতেই সবচেয়ে বেশি কর্মী ও সহকারীর প্রয়োজন হচ্ছে। এব্যাপারে আরও বিস্তারিত তথ্য রয়েছে শ্রম পরিসংখ্যান ব্যুরোর ওয়েবসাইটে যুক্ত লিঙ্কসমূহে। সেখানে কোন পেশা বেঁছে নিতে কোন ধরনের পুনঃপ্রশিক্ষণ প্রয়োজন তারও ধারণা দেওয়া হয়েছে।
তবে কোভিড-১৯ মহামারির মতো অপ্রত্যাশিত ঘটনায় সরকারি আভাস অনেকটাই বদলে যায়। কিন্তু, তারপরও সেখানে এমন অনেক তথ্যই আছে যা গড়পড়তা একজন কর্মী জানলে উপকৃত হবেন। এনিয়ে সরকার আরেকটু তৎপর হয়ে সাধারণ মানুষকে ওয়েবসাইটে যুক্ত করতে মোবাইল অ্যাপ চালু করতে পারে। দ্বিতীয়ত, কর্মসংস্থানের বিস্তারিত তথ্যদানের জন্য নিয়োগদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোকেও অর্থ দানের মাধ্যমে উৎসাহিত করতে পারে সরকার। তথ্যগুলো সুবিন্যস্ত করে চাকরি পাওয়ার যোগ্যতা নিয়ে সুনির্দিষ্ট ভিডিও টিউটরিয়েল তৈরি, ইউটিউব চ্যানেলগুলোতে সেগুলোর বিজ্ঞাপন দান, কোরা ও রেডিটের মতো অনলাইন তথ্য জানার মাধ্যমে সেগুলোর বিতরণ জরুরি। তৃতীয়ত, চাকরির অবস্থান নিয়ে একটি মানচিত্রও তৈরি করতে পারে কর্তৃপক্ষ।
চতুর্থত, কোম্পানিগুলো নিজে থেকে নিয়োগের জন্য বিপুল প্রচারণা চালানো নিয়ে মাথা ঘামায় না। তাই একটি আইন করে সকল কোম্পানির নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি সরকারি পোর্টালে প্রদর্শন বাধ্যতামূলক করা উচিত।
এ ধরনের বুদ্ধিদীপ্ত ও যুগোপযোগী কৌশল কর্মীদের প্রযুক্তিগত পরিবর্তনকে ভয় নয় বরং তার সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলতে উৎসাহিত করবে। সরকার যদি মানুষকে তাদের ভবিষ্যৎ কর্মস্থল নিয়ে পরিকল্পনায় সহায়তা দিতে থাকে, তাহলে কর্মীরা অর্থনীতির আকস্মিক অভিঘাতগুলো আরও সহজে মোকাবিলা করতে পারবেন। সবশেষে, জাতীয় স্বাস্থ্য বিমা, শিক্ষা ও পুনঃপ্রশিক্ষণসহ বিস্তৃত একটি বেকারত্ব বিমার সমন্বিত সুরক্ষা জাল প্রণয়ন করা গেলে মার্কিনীদের চাকরি হারানোর আতঙ্ক অতীত ইতিহাসে পরিণত হবে।
- সূত্র: ব্লুমবার্গ