লকডাউনে বাধার মুখে খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প
চলমান কঠোর লকডাউনের মধ্যে খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প প্রতিষ্ঠানে উৎপাদন অব্যাহত থাকলেও দেশে-বিদেশে পণ্য বাজারজাতকরণ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বলে জানিয়েছেন খাত সংশ্লিষ্টরা।
অন্যদিকে, পরিবহন খরচ ও উৎপাদন খরচ বাড়লেও স্থানীয় বাজারে বিক্রি কমে গেছে। ফলে, কিছু প্রতিষ্ঠান পণ্যের উৎপাদন কমিয়ে আনছে এবং এর প্রভাব গিয়ে পড়ছে স্থানীয় কাঁচামাল সরবরাহকারীদের ওপর।
খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকারী শিল্পের বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, লকডাউনের মধ্যে খাদ্য পণ্য উৎপাদনকারী কারখানাগুলো চালু রয়েছে। কিন্তু, উৎপাদিত পণ্য ছোট ছোট গাড়িতে দোকানিদের কাছে পৌঁছাতে গিয়ে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর জেরার মুখে পড়তে হচ্ছে।
কোনও কোনও সময় পণ্য পরিবাহী ছোট ভ্যানগুলোকে দীর্ঘ সময় ধরে আটকে রাখা হচ্ছে, নির্ধারিত এলাকায় ভ্যানগুলো ঢুকতে পারছে না। এতে করে বাজারজাতকরণ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
এ বিষয়ে বসুন্ধরার চিফ অপারেটিং অফিসার (ব্র্যান্ড ও মার্কেটিং) জসীম উদ্দীন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "যারা দোকান পর্যন্ত পণ্য পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব পালন করছেন তাদেরকে হয়রানির সম্মুখীন হতে হচ্ছে। রাস্তায় আটকে রেখে জেরা করা হচ্ছে। কখনও কখনও ভ্যানগুলো চলাচল করতে দেওয়া হচ্ছে না। সেটা আবার কেন্দ্র থেকে ফোন করে ছাড়াতে হচ্ছে। ফলে নির্ধারিত সময়ে পণ্য পৌঁছানো সম্ভব হচ্ছে না।"
তিনি আরও বলেন, "কারখানাগুলোতে কোনও ধরনের সমস্যা হলে দেশি বিদেশি টেকনিশিয়ান দরকার পড়ে। কিন্তু লকডাউনে দ্রুত এর সমাধান করা সম্ভব হচ্ছে না। সব মিলিয়ে চাইলেও স্বাভাবিক সময়ের মত উৎপাদন করা যাচ্ছে না।"
অন্যদিকে, যারা পণ্য রপ্তানি করছে তাদের সমস্যা আরও প্রকট। কনটেইনার ও জাহাজ জটের কারণে সময়মতো পণ্য রপ্তানি করা যাচ্ছে না। যারা পণ্য চালান দিতে পারছেন তাদেরও কয়েকগুণ বেশি ভাড়া গুনতে হচ্ছে।
খাত সংশ্লিষ্টরা জানান, দেশের মধ্য পণ্য পরিবহন করতে হচ্ছে প্রায় দ্বিগুণ ভাড়ায়। অন্যদিকে, কয়েকগুণ বেশি ভাড়া দিয়েও রপ্তানির জন্য কনটেইনার মিলছে না। স্বাভাবিক সময়ে ২০ ফিটের একটি কনটেইনার দুবাই পাঠাতে ৩০০ থেকে ৩৫০ ডলার ভাড়া গুনতে হতো। কিন্তু এখন গুনতে হচ্ছে এক হাজার ১০০ ডলার।
এছাড়া, কাঁচামালের দাম গড়ে বেড়েছে ২০ থেকে ২৫ শতাংশ। সব মিলে উৎপাদন খরচ বেড়েছে, কিন্তু সে অনুযায়ী পণ্যের দাম বাড়েনি বলে দাবি করেন শিল্ক কারখানা সংশ্লিষ্টরা।
তারা আরও জানান, মানুষের সীমিত চলাফেরা, দোকানপাটের বিক্রির সময় নির্ধারণের কারণে পণ্যের চাহিদাও কমেছে। স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাজারজাতকরণ বাধার মুখে পড়ায় প্রতিষ্ঠানগুলো পণ্যের উৎপাদন কমিয়ে এনেছে। কিছু কিছু পণ্যের ক্ষেত্রে উৎপাদন কমে স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় প্রায় অর্ধেকে গিয়ে পৌঁছেছে। যার একটি হলো দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্য।
আকিজ ফুড অ্যান্ড বেভারেজ লিমিটেডের ডেইরি বিভাগের চিফ অপারেটিং অফিসার মোহাম্মদ মোসলেহ উদ্দীন টিবিএসকে বলেন, "গ্রোসারি দোকানগুলোতে দুধ ও দুদ্ধজাত পণ্য নেওয়া কমিয়ে দিয়েছে। কারণ তারা কতক্ষণ দোকান খোলা রাখতে পারবেন সে বিষয়ে নিশ্চিত নন। আবার দোকানে যারা পণ্য নিয়ে যাচ্ছেন তারা বাধার মুখে পড়ছে বলে বাজারজাতকরণ ব্যাহত হচ্ছে। মানুষের চলাফেরাও সীমিত। সব মিলিয়ে উৎপাদন করলেও পণ্য খুব একটা বিক্রি করা যাচ্ছে না। পণ্য বিক্রি হচ্ছে না বলে উৎপাদনও প্রায় অর্ধেকে নামিয়ে আনতে হয়েছে।"
তিনি বলেন, "আমরা যদি উৎপাদন কমিয়ে দেই তার প্রভাব সরাসরি খামারিদের ওপর পড়বে। কারণ তারা তো দুধের উৎপাদন বন্ধ করতে পারবে না।"
প্রাণ আরএফএল গ্রুপের পরিচালক কামরুজ্জামান কামাল (বিপণন) টিবিএসকে বলেন, "স্থানীয় বাজারের চেয়ে বেশি সমস্যার মধ্যে পড়তে হচ্ছে রপ্তানির ক্ষেত্রে। অন্তত চারগুণ বেশি খরচ করতে হচ্ছে পণ্য রপ্তানিতে। তারপরও কনটেইনার পাওয়া যাচ্ছে না, জাহাজীকরণ করা যাচ্ছে না।"
সংশ্লিষ্টরা জানান, খাদ্য পণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প কারখানা খোলা থাকলেও প্যাকেজিংয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কারখানাগুলো বন্ধ রয়েছে। এই কারখানাগুলো বিভিন্ন ধরনের প্যাকেট, কার্টুন, লেবেল তৈরি করে থাকে।
বড় কিছু কোম্পানির কাছে এসব মজুদ থাকলেও ছোট ও মাঝারি কারখানাগুলোর কাছে দীর্ঘদিনের মজুদ থাকে না। ফলে দ্রুত ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজের এই কারখানাগুলো যদি খুলে দেওয়া না হয়, তবে উৎপাদিত পণ্য প্যাকেজিংয়ের অভাবে বাজারজাত করা বন্ধ হয়ে যাবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ অ্যাগ্রো প্রসেসরস অ্যাসোসিয়েশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট সৈয়দ মোহাম্মদ শোয়েব হাসান টিবিএসকে বলেন, "লকডাউনে প্যাকেজিং ইন্ডাস্ট্রি বন্ধ থাকলে ব্যাপক সমস্যার মধ্যে পড়তে হবে। কারণ বেশিরভাগ কোম্পানির কাছেই খুব কম প্যাকেজিং মেটেরিয়াল মজুদ থাকে।"
তিনি বলেন, "এখনই আমরা রপ্তানি পণ্যের ক্ষেত্রে ভালো মানের কার্টুন দিতে পারছি না। প্যাকেজিং ভালো না হলে পণ্যের কোয়ালিটিতেও সমস্যা তৈরি হবে। এটা ভবিষ্যতে সমস্যা তৈরি করবে। এ কারণে প্যাকেজিং ইন্ডাস্ট্রি খুলে দেওয়া খুব জরুরি।"
এদিকে, শাক-সবজি, মাছ, মাংস ও ডিম পরিবহনের ক্ষেত্রে পথে কোন বাধা নেই বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। তব্ পরিবহন ভাড়া বেড়ে যাওয়ার প্রভাবে এসব পণ্য ক্রেতাকে বাড়তি দাম দিয়ে কিনতে হচ্ছে।
কারওয়ানবাজারের সবজির আড়তদার মোস্তফা কামাল জানান, "প্রায় দ্বিগুণ ভাড়া দিয়ে পণ্য আনতে হচ্ছে ঢাকায়। এর প্রভাব তো পণ্যের দামের ওপর পড়বেই।"