লবণের সংকট নেই, তবু আমদানির চক্রান্তে মাঠে সিন্ডিকেট!
দেশে উৎপাদিত লবণের কোন ঘাটতি নেই। মিল-কারখানা, গর্তে এবং পাইপলাইন মিলে যা মজুত আছে তা দিয়ে আরো অন্তত ৫ মাস চলবে। এক মাস পরেই নতুন লবণ মৌসুম। তবু সরকারকে ভুল তথ্য দিয়ে বিদেশি লবণ আমদানির চক্রান্ত করছে সিন্ডিকেট। তাদের কারণে দেশীয় লবণশিল্প মাথা উচু করে দাঁড়াতে পারছে না। বারবার মার খাচ্ছে দেশের লবণ। ন্যায্য মজুরি বঞ্চিত হচ্ছে প্রান্তিক লবণ চাষীরা।
বিসিক কক্সবাজার অফিস সূত্র মতে, গত ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মাঠ পর্যায়ে সাড়ে ৪ লাখ এবং মিল-কারখানায় দেড় লাখ মিলে প্রায় ৬ লাখ মেট্রিক টন লবণ মজুত আছে। পাইপ লাইনে (বিভিন্ন খুচরা মজুতদার) জমা রয়েছে আরো অন্তত এক লাখ মেট্রিক টন।
আগামী তিন মাসের চাহিদা অনুযায়ী লবণ দরকার হবে সাড়ে ৫ লাখ মে. টন। বিপরীতে মজুত আছে ৭ লাখ মে.টন। সুতরাং দেশে লবণের কোন সংকট নেই। আমদানির প্রয়োজন পড়বে না।
অভিযোগ উঠেছে, ইতোমধ্যে আমদানিকারক পুরনো চক্রটি আবারো মাঠে নেমেছে। তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে ভুঁইফোড় কিছু লবণ মিল মালিক। সবাই মিলে শক্ত সিন্ডিকেট বেঁধেছে। প্রয়োজনে তারা জায়গা মতো 'বিনিয়োগ' করবে। বিদেশি লবণ আমদানির অনুমতি আদায়ে জোর তদবিরে নেমেছে তারা।
সূত্র জানিয়েছে, ইতোমধ্যে সরকারকে ২ লাখ মে.টন লবণ আমদানির প্রস্তাবনা পেশ করা হয়েছে। সেই প্রস্তাবনা কতটুকু যৌক্তিক তা অনুসন্ধানে মাঠ জরিপ করছে বিসিক। তাদের প্রতিবেদনের পরই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে, এমনটি আভাস মিলেছে।
তথ্যমতে, মাঠ পর্যায়ে কেজিতে লবণের দাম ৫ টাকা। কিন্তু প্যাকেটজাত করে বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৩৫-৪০ টাকা পর্যন্ত। খুচরা মূল্যে রয়ে যাচ্ছে বিরাট ফারাক। দালাল-মধ্যস্বত্বভোগীদের পকেট ভারি হলেও বঞ্চিত হচ্ছে চাষীরা। এই মূহূর্তে সরকারের কঠোর হস্তক্ষেপই পারে দেশের অতি গুরুত্বপূর্ণ এই খাতকে বাঁচাতে।
এদিকে, দেশে উৎপাদিত লবণ চাহিদা মিটিয়ে উদ্বৃত্ত থাকার পরও অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের বিদেশি লবণ আমদানির ষড়যন্ত্র রুখতে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চেয়েছে কক্সবাজার লবণচাষী ও ব্যবসায়ী সংগ্রাম পরিষদ। শনিবার (৯ অক্টোবর) বিকালে কক্সবাজার প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে লিখিত বক্তব্যে সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট শহিদ উল্লাহ বলেন, দেশের মানুষের চাহিদা মিটিয়ে এখনও ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চাহিদার চেয়েও বেশি লবণ মজুত রয়েছে, সেখানে লবণ মালিক সমিতি নামের একটি অকার্যকর সিন্ডিকেট আবারও সরকারকে ভুল তথ্য দিয়ে বিদেশি লবণ আমদানির পাঁয়তারা করছে। এই মুহূর্তে দেশীয় লবণশিল্প বিরোধী ষড়যন্ত্র বন্ধ করতে হবে।
তিনি বলেন, কক্সবাজার ও বাঁশখালীর কিছু অংশ নিয়ে প্রায় ৫৭ হাজার ২৭০ একর জমিতে প্রায় ৫৫ হাজার লবণচাষী রয়েছেন। এছাড়াও লবণের উপর বিভিন্ন ব্যবসা করে জীবিকা নির্বাহ করেন আরও ৮০ শতাংশ মানুষ। ফলে দেশীয় লবণ শিল্প ধ্বংস হয়ে গেলে হাজার হাজার মানুষ বেকার হয়ে পড়বেন, যাদের অন্য কোন পেশা নেই।
দেশীয় লবণ চাষীরা যখন আগামী মৌসুমের লবণ উৎপাদনের জন্য মাঠে নেমে পড়েছে, ঠিক ওই সময়ে একটি অসাধু চক্র আগামী মৌসুমে দেশে লবণের সংকট হতে পারে- এমন তালবাহানা তুলে সরকারের উচ্চ মহলে ও স্থানীয় প্রশাসনে ভুল তথ্য দিয়ে বিদেশী লবণ আমদানির ষড়যন্ত্র শুরু করেছে।
বিগত দুই-তিন বছর যেখানে লবণ চাষীরা ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না, সেখানে এই চক্রান্তকারী মুনাফালোভীদের ষড়যন্ত্র সফল হলে দেশীয় লবণ চাষীরা মাঠ ছেড়েই উঠে যাবেন। এতে ধ্বংস হবে স্বয়ংসম্পূর্ণ দেশীয় লবণ শিল্প।
সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ লবণ চাষী সমিতির সাধারণ সম্পাদক শহিদুল ইসলাম, উজানটিয়া ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক মেম্বার সিরাজুল মোস্তফা, লবণচাষী শুয়াইবুল ইসলাম সবুজসহ সংশ্লিষ্টরা বক্তব্য দেন।
তারা জানান, দেশে প্রতিবছরের চাহিদা মিটিয়ে আরও প্রচুর পরিমাণ লবণ মজুুদ থাকলেও একটি অসাধু সিন্ডিকেট লবণের কৃত্রিম মূল্য বৃদ্ধি করে বাজেটে প্রভাব ফেলার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলেন। যার কারণে গত ২১ জুন কক্সবাজারের জেলা প্রশাসকের সভাপতিত্বে ভার্চুয়াল সভার (জুম মিটিং) আয়োজন করে ভোক্তা, লবণ চাষী ও ব্যবসায়ীদের মতামত নেয়া হয়।
ওই সভায় বিসিক জানায়, দেশে ২০২১ সালে লবণের চাহিদা ১৯ লাখ ৪৩ হাজার মেট্রিক টন। আর দেশে ২০২১ সালে লবণ উৎপাদন হয় ১৬ লাখ ৫১ হাজার মেট্রিক টন। এছাড়াও ২০২০ সালে ৩ লাখ ৪৮ লাখ মেট্রিক টন লবণ উদ্বৃত্ত ছিলো। বর্তমানে ১৯ লাখ ৯৯ হাজার মেট্রিক টন মজুদ আছে, যা ২০২১ সালের চাহিদা পূরণ করে আরও ৫১ হাজার মেট্রিক টন লবণ উদ্বৃত্ত রয়েছে। ওই সভায় এসব তথ্য উঠে আসলে অসাধু ব্যবসায়ীদের সেই চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্র নস্যাৎ হয়ে যায়।
লবণ চাষীদের বক্তব্য হলো- এখন দেশীয় লবণ চাষীরা যখন আগামী মৌসুমের উৎপাদনের জন্য মাঠে নামতে শুরু করেছেন, ঠিক ওই সময়ে 'লবণ মিল মালিক সমিতি' নামে অসাধু একটি সিন্ডিকেট দেশে লবণের সংকট সৃষ্টি হতে পারে- এমন ভুল তথ্য দিয়ে আবারও বিদেশি লবণ আমদানির চক্রান্ত শুরু করেছেন। যদিও এদের সাথে লবণ কেনার কখনও সম্পর্ক ছিল না। বরং সরকারের কাছ থেকে বিদেশী লবণ আমদানির পারমিট নিয়ে সেই পারমিট কালো বাজারে বিক্রি করে মুনাফা লাভের চেষ্টায় আছে সিন্ডিকেটটি।
সরকার বিদেশী লবণের উপর কর আরোপ ও অসাধু ব্যবসায়ীদের কৃত্রিম দাম বৃদ্ধির অপচেষ্টা বন্ধ করে দেয়ার পর যখন লবণ চাষী ও ব্যবসায়ীরা আশায় বুক বেঁধে আগামী মৌসুমের জন্য লবণ উৎপাদনে মাঠে নেমে পড়ছেন, তখন আবারও ওই চক্র নতুন করে ষড়যন্ত্র শুরু করেছে।
ইতোমধ্যে কুতুবদিয়া, রাজাখালী, বাঁশখালী, পেকুয়া ও টেকনাফের কিছু কিছু এলাকায় লবণ চাষীরা লবণ উৎপাদন কার্যক্রম শুরু করে দিয়েছেন। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে চলতি বছরের মতো আগামী মৌসুমেও চাহিদার চেয়ে বেশি লবণ উৎপাদন করতে পারবেন চাষীরা। এমনকি আগামি ডিসেম্বর মাসের প্রথম দিকে নতুন উৎপাদিত লবণ বিক্রিও করতে পারবেন বলে আশা লবণচাষীদের।
কিন্তু ওই অসাধু চক্রটি সরকার ও প্রশাসনকে বিভ্রান্ত করে, আগামী ডিসেম্বরের মধ্যেই লবণের সংকট তৈরি হবে উল্লেখ করে বানোয়াট তথ্যের ভিত্তিতে সরকার হতে বিদেশী লবণ আমদানির অনুমতি নিতে মরিয়া। তাদের মূল লক্ষ্য দেশীয় লবণ শিল্প ধ্বংস করা।