সুদহারের সীমায় ব্যাহত হচ্ছে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি
দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোয় অতিরিক্ত তারল্য ও সে তুলনায় কম ঋণ হার থাকার পরও সুদহার সীমার কারণে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি দুর্বল অবস্থানেই রয়েছে। যা দেশের প্রত্যাশিত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের পথেও বাঁধা হয়ে উঠতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন ব্যাংকাররা।
দেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের (এফবিসিসিআই) উদ্যোগে ব্যাংকিং খাতের শীর্ষ নির্বাহী ও ব্যবসায়ীদের সভায় তারা এমন কথা বলেছেন।
এছাড়া, বিপুল পরিমাণ খেলাপি ঋণের চাপে ব্যাংকিং শিল্প মরণাপন্ন প্রায়, যা ব্যাংকের সামগ্রিক ব্যবসাকেও ক্ষতিগ্রস্ত করছে বলে তারা সেখানে মন্তব্য করেন।
আজ বৃহস্পতিবার সকালে রাজধানীর একটি হোটেলে 'বিরাজমান পরিস্থিতিতে দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রায় ব্যাংকিং খাতের ভূমিকা: সমস্যা ও সম্ভাবনা' শীর্ষক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের সঙ্গে এ মতবিনিময় সভার আয়োজন করে এফবিসিসিআই।
মতবিনিময় সভায় সভাপতিত্ব করেন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি জসিম উদ্দিন। আলোচনায় ব্যাংকারদের নেতৃত্ব দেন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্সের (এবিবি) চেয়ারম্যান ও ইস্টার্ন ব্যাংকের এমডি আলী রেজা ইফতেখার। মোট ৩২ জন ব্যাংকার বৈঠকে অংশ নেন।
আলী রেজা ইফতেখার বলেন, "ঋণ সীমার কারণে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি ৭-৮ শতাংশের মতো দুর্বল অবস্থানে রয়েছে। এ বাস্তবতায় চলতি অর্থবছরে (২০২১-২২) কেন্দ্রীয় ব্যাংক নির্ধারিত ১৪.৮ শতাংশের বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যমাত্রা অর্জন বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর জন্য চ্যালেঞ্জিং হবে। এত কম ঋণ প্রবৃদ্ধি নিয়ে দেশের প্রত্যাশিত অর্থনৈতিক বিকাশ ঘটানোও সম্ভব নয়।
উল্লেখ্য, গত জুলাইয়ে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি ছিল ৮.৩৮ শতাংশ, যা আগের মাসের ৮.৩৫ শতাংশের চাইতে সামান্য বেশি।
গেল অর্থবছরেও ১৪.৮ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে ৮.৪০ শতাংশ ঋণ প্রবৃদ্ধি হয়, অথচ এসময় সুদহার ছিল মাত্র ৬-৭ শতাংশ, যা সাম্প্রতিক ইতিহাসে অন্যতম কম।
মূলত গত বছরের ১ এপ্রিলে সুদহারে ৯ শতাংশের সীমা আরোপের পর থেকেই কমতে থাকে ঋণ প্রবৃদ্ধি।
এবিষয়ে ইফতেখার বলেন, মুক্তবাজার অর্থনীতিতে সুদহার নির্ধারিত করে দেওয়া উচিত নয়। বরং সেটি নির্ধারণের হাতে বাজারের হাতেই ছেড়ে দেওয়া দরকার।
"খরচসহ ব্যাংকের পক্ষে ৯ শতাংশ সুদে ক্ষুদ্র ও মাঝারি (এসএমই) খাতের প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। তাছাড়া, সব ধরনের ঋণে সমান সুদহার আরোপ করাও সঠিক সিদ্ধান্ত নয়," যোগ করেন তিনি।
ইফতেখার আরও বলেন, এটা সত্য যে ব্যাংকগুলি এসএমই খাতে ঋণ দিতে খুব একটা আগ্রহী নয়, কারণ বড় ঋণগ্রহীতাদের দেওয়া ছোট ব্যবসার চেয়ে সহজ। এসএমই খাতে ঋণদানে অনেক নথিপত্রের প্রয়োজন হয় এবং পর্যবেক্ষণের খরচও বেশি।
একারণেই এখাতের জন্য সরকার ঘোষিত প্রণোদনা ঋণের শতভাগ ছাড়করণ করা সম্ভব হচ্ছে না বলে উল্লেখ করেন তিনি।
খেলাপি ঋণ প্রসঙ্গে এবিবি চেয়ারম্যান বলেন, বর্তমানে খেলাপি ঋণহার ১০ শতাংশের বেশি, যা অস্বাভাবিক রকমের বেশি। এ সময় খেলাপি ঋণ আদায়ে এফবিসিসিআইয়ের সহযোগিতা চান আলী রেজা ইফতেখার।
ব্যবসাবাণিজ্যের দীর্ঘমেয়াদী অর্থায়ন নিশ্চিত করতে তিনি বন্ড বাজারকে উন্নয়নের পরামর্শও দেন।
এসময় এফবিসিসিআই সভাপতি জসিম উদ্দিন বলেছেন, বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি ঘিরে অচলাবস্থা কেন দূর হচ্ছে না তা নিয়ে একটি বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন।
যৌক্তিক কারণে যেসব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সময়মতো ঋণ পরিশোধ করতে পারেনি, তাদের সমর্থন দিতে তিনি ব্যাংকারদের প্রতি অনুরোধ করেন। পাশাপাশি ইচ্ছেকৃত ঋণ খেলাপিদের প্রতি ব্যবস্থা নেওয়ার ওপরেও গুরুত্ব দিয়ে তিনি বলেন, 'ইচ্ছেকৃত কিছু ঋণ খেলাপির কারণে আমরা অসংখ্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে দরকারি ঋণের অভাবে ভুগতে দিতে পারি না।'
তিনি বলেন, ব্যাঙ্কগুলি যদি এখন ঋণ বিতরণ না করে, তাহলে তারা নিকট ভবিষ্যতে ঋণগ্রহীতাদেরও পাবে না, কারণ ছোট ব্যবসাগুলি সব শেষ হয়ে যাবে। তখন টাকা নিয়ে ব্যাংকগুলো কী করবে? প্রশ্ন রাখেন এফবিসিসিআই সভাপতি।
মতবিনিময় সভায় এবিবির সেক্রেটারি ও সিটি ব্যাংকের এমডি মাশরুর আরেফিনও বলেছেন যে, সব ধরনের সুদহার একই হওয়ার কারণে বেসরকারি ঋণপ্রবাহ ধীরগতির হয়ে পড়েছে।
তাঁর মতে, এসএমই লোনের জন্যেও ৯ শতাংশ সুদ সীমা থাকায় ব্যাংকগুলো লোকসানের ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। তাই বাধ্য হয়েই সরকারি সঞ্চয়পত্র ও বন্ডের মতো নিরাপদ উৎসে বিনিয়োগ করতে উৎসাহী হচ্ছে। ১২-১৩ শতাংশ মুনাফা না পেলে স্বাভাবিকভাবেই ব্যাংক এসএমই খাতের চাইতে বড় বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দিতে চাইবে।
আমানতকারীকে দেওয়া সুদ, অন্যান্য পরিচালনা খরচ যোগ করার পর বর্তমানে নির্ধারিত সুদহারে ঋণ দিয়ে ব্যাংকগুলো উচ্চ মুনাফা করছে এমন দাবি সত্য নয়, বরং বাস্তবতা অনেকটাই ভিন্ন।
মাশরুর আরেফিন জানান, বর্তমানে অধিকাংশ ব্যাংকের আমানত ও ঋণের সুদহারের মধ্যে ব্যবধান (স্প্রেড) ৩ শতাংশেরও কম।
এনিয়ে তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করে বলেছেন, তারা শুধুমাত্র মন্দ ঋণসহ খরচের হিসাব করেছেন, কিন্তু ব্যাংকগুলোকে খেলাপিসহ সব ধরনের ঋণের খরচ হিসাব করতে হয়।
উদাহরণস্বরূপ; তিনি বলেন তাঁর ব্যাংকের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ৪.৭৫ শতাংশ ব্যবধান হিসাব করলেও প্রকৃত স্প্রেড ৩.৮ শতাংশ।
ব্র্যাক ব্যাংকের এমডি ও প্রধান নির্বাহী সেলিম আর এফ হোসেন বলেন, এসএমই খাতের ক্রেডিট গ্যারান্টি স্কিমটি সম্পূর্ণ অকার্যকর। নীতিমালা সংক্রান্ত জটিলতার কারণে ব্যাংকগুলো এতে উৎসাহ পায় না।
স্কিমটি কার্যকর করার জন্য তিনি নীতিমালা সহজ করার দাবি করেন।