হিমায়িত মাছে সরগরম বাগেরহাট
সাগরে মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞা থাকায় বাগেরহাটে হিমায়িত মাছে সরগরম সামুদ্রিক মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র। প্রতিদিন আলো ফোটার আগেই ক্রেতা-বিক্রেতাদের হাঁকডাকে মুখরিত হয়ে ওঠে হিমায়িত মাছের অবতরণ কেন্দ্র। শুধু বাগেরহাট জেলায়ই নয় পিরোজপুর, গোপালগঞ্জ থেকে পাইকাররা এই হিমায়িত মাছ কিনতে আসেন এই মাছ বাজারে। দেশীয় সামুদ্রিক মাছের চেয়ে হিমায়িত মাছের দাম কম থাকায় পাইকারদের পাশাপাশি স্থানীয়রাও এই মাছ ক্রয় করে।
সম্প্রতি সরেজমিনে বাগেরহাট দড়াটানা নদীর তীরে অবস্থিত সামুদ্রিক মাছের অবতরণ কেন্দ্র কেবি বাজারে গিয়ে দেখা যায় মাছ পরিবহনের জন্য ব্যবহৃত ফ্রিজিং গাড়ি থেকে প্যাকেটজাত বিভিন্ন প্রকার সামুদ্রিক মাছ নামানো হচ্ছে। শ্রমিকরা বাজারের বিভিন্ন আড়তের সামনে সারি দিয়ে রাখছেন এসব মাছের প্যাকেট। পাইকাররা প্যাকেট খুলে মাছ দেখছেন, পরে দরদাম করে কিনে নিয়ে পরিবহনযোগে ফিরছেন নিজেদের গন্তব্যে।
বাগেরহাট মৎস্য আড়ত সূত্রে জানা গেছে, জাপান, ওমান ও চীন থেকে আমদানিকৃত বছরে প্রায় ৫০ কোটি টাকার হিমায়িত মাছ বিক্রি হয় এই পাইকারি মৎস্য হাটে।প্রতিদিন এই মাছের সাথে আড়তের প্রায় দেড় থেকে দুইশ শ্রমিক তাদের জীবন জীবিকা নির্বাহ করে। এছাড়া তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এই ব্যবসার সাথে জড়িত রয়েছে।
শ্রমিক আবু সত্তার বলেন, 'প্রায় ২৫ বছর ধরে এই মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রে শ্রমিক হিসেবে কাজ করি। মাঝে মধ্যে মাছ কম থাকায় আয়ও কম হয়। তারপরেও আমার পরিবারের ৬ সদস্য নিয়ে খেয়ে-পরে ভালো আছি। আমাদের এখানে দুইশ'র উপরে শ্রমিক রয়েছে'।
সামুদ্রিক মাছের মধ্যে রয়েছে রূপচাঁদা, চন্দনা, ঢেলা, ফাইস্যা, ডুংকুর, টেংরা, সাদা চেলা, মোচন টেংরা, কাউয়া, কলম্বো, আর্জিনা, বাইলা, চইটকা, বোতল, বৌ মাছ, পাতা কাউয়া, মাইকেল, কোয়েল, ভাঙ্গান, চিতল, আড়াই সুতাসহ ইত্যাদি। দশ ও বিশ কেজি ওজনের দুই ধরনের প্যাকেটে বিক্রি হয় হিমায়িত এই মাছ। চাহিদা অনুযায়ী মাছের সরবরাহ হয় এখানে। বছরে অধিকাংশ সময়ে এই মাছের চাহিদা থাকলেও সাগরে মাছ ধরা নিষেধাজ্ঞাকালীন সময়ে চাহিদা বেড়ে যায় অনেকাংশে।
বাগেরহাটের চিতলমারী থেকে মাছ কিনতে আসা বেপারী বিষ্ণুপাত্র বলেন, 'প্রায় ১৪ বছর ধরে এই মাছ বাজার থেকে মাছ ক্রয় করি। দশ কেজি ওজনের প্যাকেটে থাকা ফাইস্যা মাছের কেজি ১২০-১৩০ টাকা দরে, কলম্বো মাছের কেজি ৮০-৯০ টাকায় ক্রয় করে গ্রামের বিভিন্ন এলাকায় ভ্যানে করে বিক্রি করি। দৈনিক ৪০০-৫০০ টাকা আয় হয়। তাই দিয়েই চলে সংসার'।
পিরোজপুরের নাজিরপুর এলাকা থেকে আসা অপর এক মাছ ব্যবসায়ী মানিক মোল্লা বলেন, 'প্রতিদিন ভোর ৪টায় মোটর সাইকেলে করে বাগেরহাট কেবি মাছ বাজারে হিমায়িত সামুদ্রিক মাছ কেনার জন্য আসি। ভোর ৫টা থেকে মাছ নিলামে ক্রয় করে নিয়ে ফিরে যাই। সেখানে স্থানীয় হাটে এইসব মাছ বিক্রি করি। অবরোধ চলাকালে দেশীয় সামুদ্রিক মাছ ধরা নিষিদ্ধ থাকায় বর্তমানে হিমায়িত মাছের চাহিদা অনেক বেশি'। তবে দেশীয় সামুদ্রিক মাছের চেয়ে হিমায়িত মাছের দাম কেজিতে দুই থেকে আড়াইশো টাকা কম বলে জানান তিনি।
শহিদুল ইসলাম নামের স্থানীয় এক মাছ ক্রেতা বলেন, 'সামুদ্রিক মাছ খাওয়ায় অভ্যস্ত থাকায় প্রায় এই হাটে মাছ ক্রয় করতে আসি। তবে দেশীয় সামুদ্রিক মাছের যে স্বাদ এই মাছ অত বেশি সুস্বাদু নয়। তারপরেও অভ্যাসের জন্য এই মাছ কিনতে বাধ্য হই'।
বাগেরহাট উপকূলীয় মৎস্যজীবী সমিতির সভাপতি শেখ ইদ্রিস আলী বলেন, 'ওমান, জাপান ও চায়না থেকে জাহাজে করে চট্টগ্রাম বন্দরে আসে। সেখান থেকে আমদানিকারকরা পরিবহনযোগে খুলনাসহ বিভিন্ন জেলায় নিয়ে যান। পরে ব্যবসায়ীরা আমদানিকারকদের কাছ থেকে ক্রয় করে ফ্রিজিং (শীতাতাপ নিয়ন্ত্রিত) গাড়িতে করে এই মাছ বাগেরহাট আড়তে নিয়ে আসে। সাগরে মাছ কম ধরা পড়ায় এবং বেশিরভাগ সময় মাছ আহরণে নিষেধাজ্ঞা থাকার কারণে এই মাছের চাহিদা বেড়েই চলছে'।
বাগেরহাট কেবি বাজার মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র আড়তদার সমিতির সভাপতি আবেদ আলী বলেন, 'বছরজুড়েই এই আড়তে হিমায়িত মাছ বিক্রি হচ্ছে। তবে সাগরে অবরোধকালীন সময়ে মাছ ধরা বন্ধ থাকার কারণে এই মাছের চাহিদা খুব বেশি থাকে'।
করোনাকালীন সময়ে প্রতিদিন প্রায় ২০ থেকে ২২ মেঃ টন মাছ বিক্রি হয়। প্রায় সাত বছর ধরে জেলা ও জেলার বাইরে থেকে আসা বিভিন্ন পাইকাররা এই হাট থেকে মাছ ক্রয় করে নিয়ে যান। বর্তমানে বাগেরহাট মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রে ১৮ জন আড়তদার রয়েছেন।বাগেরহাটের এই মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রটি ১৯৮৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়।