১৫৯ পোশাক কারখানায় শ্রম অসন্তোষের শঙ্কা
সময়মত শ্রমিকদের বেতন ভাতা পরিশোধ করে না এমন ১৫৯টি পোশাক কারখানার তালিকা তৈরি করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মনে করছে, এসব কারখানার শ্রমিকরা যাতে সঠিক সময়ে বেতনভাতা পায়, তা মালিকপক্ষসহ সংশ্লিষ্টদের সমন্বয়ে নজরদারি করা প্রয়োজন। অন্যথায় শ্রম অসন্তোষের আশঙ্কা রয়েছে। কারখানাগুলোতে শ্রমিক সংখ্যা এক লাখের উপরে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, এসব কারখানার তালিকা সম্বলিত একটি গোপন প্রতিবেদন গত ২৬ অক্টোবর বাণিজ্য মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে রপ্তানি কমে যাওয়া, ক্রেতা সংকট, আর্থিক সংকট, ক্রয়াদেশ বাতিল, কাজের অর্ডার কম পাওয়া, মূলধন স্বল্পতা, ঋণসহ প্রণোদনা না পাওয়ার 'অজুহাতে' এ কারখানাগুলো প্রতিমাসে সময়মত বেতন ভাতা পরিশোধ করতে পারে না।
তবে তালিকায় থাকা কারখানা মালিকদের মধ্যে কয়েকজনের সঙ্গে কথা বললে তারা এর যথার্থতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তাদের মধ্যে কেউ কেউ জানিয়েছেন, তাদের কোন বেতন ভাতা বকেয়া নেই। কেউ কেউ জানিয়েছেন, তাদের কারখানায় কোন ধরণের শ্রম অসন্তোষও নেই।
তবে তালিকায় কিছু প্রকৃত সমস্যার চিত্রও উঠে এসেছে।
তালিকায় থাকা গাজীপুরের স্টাইল ক্রাফট কারখানার শ্রমিকরা বকেয়া টাকা পরিশোধের দাবিতে গত পাঁচ দিন ধরে রাজধানীর বিজয়নগরের শ্রম ভবনের সামনে অবস্থান করছেন। দফায় দফায় মালিকপক্ষের সঙ্গে শ্রম মন্ত্রণালয় সভা করলেও শ্রমিকের বকেয়া আদায়ে কূলকিনারা হচ্ছে না।
শিল্পাঞ্চল পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, আলোচ্য কারখানাটিতে ৩২০০ শ্রমিক রয়েছেন। আন্দোলনরত শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাদের চার মাস থেকে নয় মাসের বেতন বকেয়া রয়েছে।
আফরিন নামে কারখানাটির একজন শ্রমিক দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "আমরা গত মঙ্গলবার থেকে এখানে অবস্থান করছি। পাওনা না আদায় হওয়া পর্যন্ত অবস্থান করবো।"
তিনি বলেন, "আমাদের মোট পাওনা ৭০ কোটি টাকার উপরে, কারখানা মালিক এখন আড়াই কোটি টাকা দিতে চায়। এটি তো অযৌক্তিক।"
অসন্তোষের তালিকায় রয়েছে সম্প্রতি বন্ধ হয়ে যাওয়া ওপেক্স গ্রুপের নারায়ণগঞ্জের কাঁচপুরের গার্মেন্টস ইউনিটসহ মিরপুরের একই মালিকের অপর একটি কারখানাও। দুটি কারখানায় শ্রমিকের সংখ্যা ১৪ হাজার ৫০০।
ওই কারখানার শ্রমিকদের পাওনার বিষয়টিও এখনো সুরাহা হয়নি। ইতোমধ্যে শ্রমিক নেতারা শিগগিরই আন্দোলনে নামার ঘোষণা দিয়ে রেখেছেন।
তালিকা অনুযায়ী, রাজধানীর মিরপুরের পল্লবীর ৪০০ শ্রমিকের নুরুন্নাহার নিট এপারেলসের গত সেপ্টেম্বর মাসের বেতন ভাতা এখনো পরিশোধ হয়নি। অবশ্য কারখানার মালিক মোশাররফ হোসাইনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে তিনি জানান, সেপ্টেম্বর মাসে কিছু শ্রমিকের বেতন দেওয়া হয়েছে।
তবে তার কারখানার আর্থিক সমস্যার চিত্র তুলে ধরে তিনি বলেন, "কোভিডের সেকেন্ড ওয়েভের সময় গত মে মাসের দিকে সাত লাখ মার্কিন ডলারের অর্ডার ক্যানসেল হওয়ার পর সমস্যা তৈরি হয়। ব্যাংকে ডিফল্টার হয়ে যাই।"
কিন্তু এ ভরপুর ক্রয়াদেশের সময়েও কেন তিনি অর্ডার পাচ্ছেন না, এমন প্রশ্নে অপেক্ষাকৃত ছোট পুঁজির এ উদ্যোক্তা বলেন, "ব্যাংকে দায় দেনা থাকায় ব্যাংক তো মাস্টার এলসির বিপরীতে ব্যাক টু ব্যাক এলসি খুলছে না। সেক্ষেত্রে আমি অর্ডার নিয়ে এক্সিকিউট করবো কীভাবে? কারণ আমার তো ক্যাশ ক্রাইসিস হওয়ায় নগদ টাকায় কাঁচামাল কিনতে পারছি না।"
বিদেশী ক্রেতা কর্তৃক মূল এলসির বিপরীতে ব্যাংক সাধারণত ৬০ থেকে ৭৫ শতাংশ পর্যন্ত কাঁচামাল ও এক্সেসরিজ বাকীতে ক্রয়ের সুযোগ দিয়ে থাকে, যা ব্যাংক টু ব্যাক এলসি নামে পরিচিত।
পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ গার্মেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) সদস্য কারখানার এই মালিক বলেন, "এ কারণে এখন সরাসরি অর্ডার না নিতে পেরে সাব কন্ট্রাক্টে কাজ করাচ্ছি। আগে ৪০০ প্লাস শ্রমিক থাকলেও এখন দেড় থেকে দুই'শ শ্রমিক রয়েছে।"
সাব কন্ট্রাক্টের ক্ষেত্রে সাধারণত মূল অর্ডার পাওয়া কারখানার দেওয়া ফেব্রিক ও এক্সেসরিজ নিয়ে নিজের কারখানার মেশিন ও শ্রমিক দিয়ে পোশাক তৈরি করা হয়।
তিনি বলেন, এখনো কোন শ্রমিক অসন্তোষ নেই। তবে তিনি চিন্তিত।
তালিকা অনুযায়ী, গাজীপুরের কোনাবাড়ির মধ্যপাড়া এলাকার জেড স্টার লিমিটেড কারখানার শ্রমিক ৫০ জন। কিন্তু কারখানা মালিক রাজিব হায়দার দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান, তার কারখানায় শ্রমিক ১২০ এর উপরে।
সাব কন্ট্রাক্ট ভিত্তিতে কাজ করা এ কারখানা মালিক দাবি করেন, তার কারখানায় শ্রমিকদের সেপ্টেম্বরের বেতন পরিশোধ হয়েছে, কেবল কয়েকজন কর্মচারীর বেতন বকেয়া রয়েছে।
তালিকায় থাকা একই এলাকার র্যাডিসন এপারেলস লিমিটেডের মালিক মো. মজিবুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, কারখানাটির নাম র্যাডিসন ওয়াশিং প্ল্যান্ট। তার কারখানায় কোন শ্রমিকের বেতন ভাতা বকেয়া নেই।
অনেকটা রাগত স্বরে তিনি বলেন, "বাংলাদেশে একটি কারখানা যদি ঠিকঠাক শ্রমিকের বেতন দেয়, সেটি আমার কারখানা। আপনি কীসের তালিকা নিয়ে এসেছেন।"
মেন এপারেলস লিমিটেড নামে তালিকায় থাকা গাজীপুরের বোর্ড বাজার এলাকার একটি কারখানার মালিক আরিফুল হকের মোবাইল ফোনে কল করা হলে তিনি বলেন, ওই কারখানা তিনি ২০১৯ সালে অপর অংশীদারের কাছে হস্তান্তর করেছেন।
তার এ তথ্য সঠিক হলে, বলা যায়, প্রায় দুই বছর ধরে কারখানার তথ্য হালনাগাদ হয়নি।
তালিকার যথার্থতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) এক্সিকিউটি প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ হাতেম।
মিনটেক্স এপারেল এবং অ্যালপাইন নিট ফেব্রিকস লিমিটেড নামে দুটি কারখানার নাম উল্লেখ করে তিনি বলেন, কারখানা দুটি কোভিডের ধাক্কায় এক বছর আগেই বন্ধ হয়ে গেছে। অথচ তালিকা অনুযায়ী, কারখানা দুটির গত আগস্ট পর্যন্ত বেতন পরিশোধ হয়েছে বলে বলা হয়েছে।
তিনি বলেন, "বেশকিছু ভালো বেতন ভাতা পরিশোধ করে এমন কারখানার নামও ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশের তালিকায় চলে আসে। তালিকা তৈরির সময় আমাদের সাথে ক্রস চেক করে নিলে এ ধরণের সমস্যা হতো না।"
তবে তিনি বলেন, "এর মধ্যে যাদের প্রকৃত অর্থেই সমস্যা রয়েছে, বা তালিকায় নাম রয়েছে, তারা গাফিলতি করে কিংবা অভ্যাসবশত টাকা পরিশোধ করছেন না, তা নয়। সব চেষ্টা করে যখন ফেল করে, তখনই বকেয়া পড়ে যায়।"
মন্ত্রণালয়ের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ঢাকা মহানগর, সাভার, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম ও ময়মনসিংহ এলাকার ৪ হাজার ৩৪৭টি কারখানার তথ্যের ভিত্তিতে ওই প্রতিবেদন তৈরি করা হয়। গত ২৬ তারিখে পাঠানো ওই চিঠিতে বলা হয়, আলোচ্য সময় পর্যন্ত কারখানাগুলো আগের মাসের বেতন পরিশোধ করেনি।
যদিও শ্রম আইনের বিদ্যমান ধারা অনুযায়ী, শ্রমিকের বেতন পরবর্তী মাসের সাত কার্যদিবসের মধ্যে পরিশোধ করতে হয়।
এতে বলা হয়, বিজিএমইএ, বিকেএমইএ, সরকার, শ্রমিক সংগঠনের সমন্বয়ে শ্রমিকরা যাতে বেতন-বোনাস ও অন্যান্য ভাতাদি সঠিকভাবে ও সময়মত পায়, সে বিষয়টির প্রতি নজরদারি আবশ্যক। গার্মেন্টস মালিকপক্ষ কোনো কারখানা বন্ধ করলে বা শ্রমিক ছাঁটাই করলে সেটি আগেই যাতে যথাযথ প্রক্রিয়ায় ঘোষণা করা হয়, তা নিশ্চিত করা দরকার।
এসব বিষয়ে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া না হলে কারখানাগুলোতে শ্রম অসন্তোষের আশঙ্কার কথাও জানানো হয়।
শ্রম মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের যুগ্মমহাপরিদর্শক মো. শামসুল আলম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওই তালিকা সম্বলিত প্রতিবেদন এখনো হাতে পাইনি (শনিবার পর্যন্ত)। তালিকা পেলে তথ্য সংগ্রহ করে প্রকৃতপক্ষে যেসব কারখানার সমস্যা রয়েছে, সেগুলো তদারকি করবো।"
তবে তিনি বলেন, "শিল্পাঞ্চল পুলিশের দেওয়া তালিকা পুরোপুরি ঠিক থাকে না। বিগত কয়েক বছর ধরে আমরা সেটি দেখে আসছি।"
শিল্পাঞ্চল পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক শফিকুল ইসলাম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "আমরা চেষ্টা করে অনেক কারখানার মালিককে প্রেশার দেওয়ায় অনেক শ্রমিক তাদের পাওনা পাচ্ছে।"
এছাড়া তাদের তালিকা সব সময় হালনাগাদ করা থাকে বলেও দাবি করেন তিনি।
শ্রমিক নেত্রী ও গার্মেন্ট ওয়ার্কার্স ট্রেড ইউনিয়ন সেন্টারের সাধারণ সম্পাদক জলি তালুকদার দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, কয়েকটি কারখানায় বর্তমানে আন্দোলন চলছে।
তিনি বলেন, "কিছু কারখানা মালিক অন্য জায়গায় কারখানা স্থানান্তর করে, কিংবা অন্য ব্যবসায়ে টাকা সরায়। আবার কেউ কেউ বিদেশে পাচার করার কারণে শ্রমিকের টাকা ঠিকমতো দিতে পারে না।"
কিন্তু বর্তমানে বিদেশী বায়ারদের কাছ থেকে প্রচুর অর্ডার আসার মৌসুমেও কেন কারখানাগুলো শ্রমিকের টাকা দিতে পারছে না, সে প্রশ্ন তোলেন তিনি।
শিল্পাঞ্চল পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, দেশে আরএমজি ও নন আরএমজি মিলিয়ে মোট কারখানার সংখ্যা ৭ হাজার ৪৯১, যেখানে শ্রমিক সংখ্যা ৩৯ লাখের কিছু বেশি। এর মধ্যে ৩ হাজার ৪৪৫টি আরএমজিতে শ্রমিক সংখ্যা ১৮ লাখের কিছু বেশি।
অবশ্য ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের আওতাধীন এলাকার শিল্প ও শ্রমিক শিল্পাঞ্চল পুলিশের হিসাবভুক্ত নয়।