আমেরিকা মূল্যস্ফীতি রপ্তানি করছে, ফেডের সুদহার বৃদ্ধিতে পরিস্থিতির আরো অবনতি
ভোক্তা চাহিদা অর্থনীতির প্রাণ ভোমরা। বিশ্ব অর্থনীতির সংকটকালে পরিত্রাণের পথও সেখানেই। কয়েক দশক ধরে মার্কিন ভোক্তারা এভাবে বৈশ্বিক অর্থনীতির পরিত্রাতার ভূমিকা পালন করেছেন। কিন্তু, আমেরিকার (যুক্তরাষ্ট্র) সরকারের সাম্প্রতিকতম মুক্তকচ্ছ খরচ আশীর্বাদ না হয়ে, বিশ্ব অর্থনীতিতে হেনেছে আঘাত।
মহামারিকালে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও নাগরিকদের বিপুল প্রণোদনা ও অর্থ সহায়তা দিয়েছে মার্কিন সরকার। উন্নত অন্যান্য দেশও দিয়েছে। ফলে এ সময় বিশ্বব্যাপী টেলিভিশন, ল্যাপটপসহ ঘরে থেকে শরীরচর্যার উপকরণসহ হাজারো পণ্যের বহুল বিক্রিবাট্টা হয়েছে। অন্য ধনী দেশগুলোর চেয়ে মার্কিন ভোক্তারাই এসবের পেছনে বেশি অর্থ ব্যয়ও করেছেন।
ভোক্তা চাহিদার এমন পুনরুদ্ধার দেখে খুচরা পণ্যের বৃহৎ বিক্রেতা- টার্গেট কর্পোরেশন এবং ওয়ালমার্ট ইনকর্পোরেশনের মতো প্রতিষ্ঠান তাদের পণ্যসম্ভারে আরও বিপুল মজুদ যুক্ত করে। এসব পণ্য বিশ্ববাজার থেকে আমেরিকামুখী হওয়ায় এবং মহামারির কারণে সরবরাহ চক্রের ব্যাঘাতের ফলে– আদতে মার্কিন চাহিদা অন্য দেশগুলিতে পণ্যগুলির দাম বহুলাংশে বৃদ্ধি করে।
অর্থাৎ, নিজ অর্থনীতির মহামারির অভিঘাত থেকে পুনরুদ্ধার শুরুর সময় থেকে মূল্যস্ফীতিকে রপ্তানি করছে আমেরিকা।
এতে বিশ্ব অর্থনীতির এক আমূল পরিবর্তনের আভাসও মেলে। যেমন প্রাক-মহামারিকালে পণ্যের সরবরাহ ছিল বিপুল, সে তুলনায় ক্রেতা খুঁজে পাওয়াই ছিল চ্যালেঞ্জের। জার্মানি ও চীনের মতো যেসব দেশের বৈদেশিক বাণিজ্যে বিপুল উদ্বৃত্ত ছিল–তাদের প্রতি অন্যদের অভিযোগ ছিল যে, দেশদুটি পৃথিবীর অন্য দেশের বাজার থেকে ফায়দা লুটছে এবং সে তুলনায় নিজেরা যথেষ্ট আমদানি করছে না।
সে তুলনায়, আমেরিকার বাণিজ্য ঘাটতিকে অন্যান্য অর্থনীতির জন্য বরাবর আশীর্বাদ হিসেবে দেখা হয়েছে। পরিতাপের বিষয় হলো- সব পণ্যের সংকটের এই কালে সে কাহিনি উল্টে গেছে।
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক জেসন ফারম্যান বলেন, 'সবকিছু আজ পাল্টে গেছে। আগে চাহিদার কমতিটা ছিল স্বাভাবিক। এখন সরবরাহই নগণ্য। আর কম যোগানের এই বিশ্বে যে দেশটি অর্থাৎ আমেরিকা চাহিদা সৃষ্টি করতো– সে এখন নিজের সমস্যা মূল্যস্ফীতিকে অন্যত্র রপ্তানি করছে।'
আমেরিকায় মূল্যস্ফীতি কমাতে ও অর্থনীতিতে চাহিদার জোয়ার নিয়ন্ত্রণে সুদহার বৃদ্ধি করছে দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক- ফেডারেল রিজার্ভ। আর তাতে করে, মার্কিন ভোক্তাদের চাহিদা কমে আসারই ইঙ্গিত মিলছে।
ফেডের সুদহার বৃদ্ধিতে বিনিময় দর বেড়েছে মার্কিন ডলারের। বিশ্ব বাণিজ্যের প্রধানতম মুদ্রা হওয়ায় শক্তিশালী মার্কিন ডলারই এখন বিশ্বের অন্যান্য দেশের কাছে প্রধান উদ্বেগের। কারণ এপথেও এখন আমেরিকা মূল্যস্ফীতিকে ছড়িয়ে দিচ্ছে।
ইউরো জোন ও জাপানের তুলনায় মার্কিন নীতিনির্ধারণী সুদহার বৃদ্ধি দ্রুতলয়ে হওয়ায় ডলারের দর ক্রমে ঊর্ধ্বমুখী। গত সপ্তাহে মুদ্রাটি দুই দশকের মধ্যে প্রথমবারের মতো ইউরোর সাথে সমমূল্যতাকে ছাড়িয়ে যায়। ফলস্বরূপ; আমেরিকা থেকে আমদানি করা পণ্যের পাশাপাশি জ্বালানি তেলের মতো যেসব পণ্যের দাম ডলারে পরিশোধ করতে হয়–সেসব আমদানির খরচ অন্য দেশগুলির জন্য আরও ব্যয়বহুল হয়ে উঠেছে।
ফারম্যান বলেন, 'আমেরিকার চাহিদাও কমবে, কিন্তু যে ব্যবস্থার মাধ্যমে এটিকে কমানো হচ্ছে–তা আরও শক্তিশালী ডলার সৃষ্টির জন্য দায়ী হবে। এর ফলে অন্য দেশে আমেরিকার রপ্তানি করা মূল্যস্ফীতি পরিস্থিতির সমাধান হবে না'।
অর্থাৎ, আমেরিকার পদক্ষেপ যে বিশ্বের ঘাড়ে উভয় সংকটের বিষফোঁড়া হয়ে উঠেছে সেদিকেই ইঙ্গিত করেছেন এ বিশেষজ্ঞ।
তা ছাড়া, ভোক্তাচাহিদা বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ফীতির একমাত্র কারণ নয়– এমনকি তা যুক্তরাষ্ট্রেও প্রধান কারণ নয়, যেখানে করোনার প্রণোদনা সবচেয়ে বেশি দেওয়া হয়েছে। মূখ্য ভূমিকা আরও রাখছে রাশিয়া ও ইউক্রেনের যুদ্ধ। এতে করে, ইউরোপসহ বিশ্বের অন্যান্য স্থানে খাদ্য ও জ্বালানির আকাশচুম্বী দর মূল্যস্ফীতির নয়া-চালিকাশক্তি হয়ে উঠেছে। যুদ্ধের কারণে এসব পণ্যের বিশ্ববাজারে সরবরাহ বিচ্ছিন্নতাও সেজন্য দায়ী।
তারপরও কিছুটা মূল্যস্ফীতি আটলান্টিকের ওপাড় (আমেরিকা) থেকেই ইউরোপ ও অন্যত্র ছড়াচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন লন্ডন-ভিত্তিক বেরেনবার্গ ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ হোল্গার স্কিমিডিং।
তিনি বলেন, 'এর মানে সরাসরি এই নয় যে, আমরা (ইউরোপীয়রা) আমেরিকা থেকে বেশি দামের জিনিস কিনে এটা সৃষ্টি করছি। আসলে মার্কিন সরকার তার নাগরিক ও ব্যবসাগুলোকে যে বিপুল প্রণোদনা দেয় (কোভিড রিলিফ প্যাকেজ) তাতে সেদেশের ভোক্তাদের ব্যয় সক্ষমতা বাড়ে। তারা বেশি বেশি ক্রয় করতে শুরু করলে বিশ্বব্যাপী সরবরাহ চক্রে একমুখী জটের সৃষ্টি হয়– যা মূল্যস্ফীতিকে উস্কে দেয়'।
গত বছরে মহামারি-জনিত মূল্যস্ফীতি দেখা দেয় পৃথিবীময়। ইউরোপের চেয়ে তা বেশি হয়েছে আমেরিকাতে। সাম্প্রতিক সময়ে সে ব্যবধান কমতে দেখা গেলেও–তা সম্পূর্ণ চিত্র তুলে ধরে না।
আমেরিকা ও ইউরোপের অর্থনীতিতে এখন সমতালে মূল্যস্ফীতি ঘটলেও, উভয়ে ভিন্ন ভিন্ন ধাঁচের। ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলি কীভাবে তা নিয়ন্ত্রণ করবে– সেটাও বড় প্রতিকূলতা। মূল্যের চাপ কতোটা স্থানীয়ভাবে সৃষ্টি আর কতোটা বৈদেশিক বাণিজ্যের মাধ্যমে ঘটছে- তার মাধ্যমেই পার্থক্যটির বেশিরভাগ ব্যাখ্যা করা যায়।
যেমন আমেরিকায় গৃহস্থালি পর্যায়ে পণ্যের চাহিদা–সিংহভাগ ভূমিকা রেখেছে। ব্লুমবার্গের অর্থনীতিবিদ আনা লুইস আন্ড্রেড বলেন, 'এ ধরনের মূল্যস্ফীতি নিজে থেকেই দূর হয় না'। আর ঠিক সেকারণেই ইউরোপীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলি যতটুকু সুদহার বাড়াতে ইচ্ছুক ছিল–তার চেয়ে বেশি বাড়িয়েছে ফেডারেল রিজার্ভ।
কারণ, স্থানীয় চাহিদা বা মার্কিন ভোক্তারাই যদি মূল্যস্ফীতির চালিকাশক্তি হন–অন্তত সেটা সংশোধনের সাধ্য ফেডের আছে।
আসলে কঠোর মুদ্রানীতি হচ্ছে- বাজারে অর্থপ্রবাহ সীমিত করে স্থানীয় চাহিদায় লাগাম দেওয়ার এক প্রাথমিক হাতিয়ার। কিন্তু, যখন বৈদেশিক উৎস থেকে মূল্যস্ফীতি আসে–যেমনটা এখন ইউরোপে ঘটছে, তখন বিপত্তি অন্যখানে। ইউরোপীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক- ইসিবি'র উচ্চ সুদহার অর্থনীতির বিকাশের গতিকে মন্থর করে তুলবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
'এতে ইউরোপে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দায়িত্ব আরও কঠিন হয়ে উঠেছে' বলে মন্তব্য করেন স্পেনের বার্সেলোনা স্কুল অব ইকোনমিক্সের বিশেষজ্ঞ লুকা ফোরানারো। মহামারিকালে পণ্য ক্রয়ের বাহুল্য, বাণিজ্যের ব্যালান্স ও বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতির মধ্যেকার আন্তঃসম্পর্ক নিয়ে সাম্প্রতিক এক গবেষণা নিবন্ধেরও সহ-লেখক তিনি।
লুকা বলেন, 'অর্থনৈতিক কার্যক্রম কিছুটা গতিহীন করতে হতো ফেডকে, সেজন্য ক্ষতি কমাতে সুদহার বাড়ালে তাদের উচ্চ হারেই শুরু করতে হবে-তাও ছিল নিশ্চিত। কিন্তু, ইউরো জোনে আমাদের সংকট দুই দিক থেকেই সবচেয়ে বাজে। মূল্যস্ফীতি এতটাই চড়া যে সেটি নিয়ন্ত্রণে মুদ্রানীতি কঠোর করা উচিত বলেই মনে হচ্ছে; কিন্তু ইউরো জোনের অর্থনীতি এই মুহূর্তে লাগাম পরানোর মতোও শক্তিশালী নয়'।
ইসিবির পরিচালক বোর্ড সদস্য ইসাবেল স্নাবেল মনে করছেন, এই মুহূর্তে তারা হাত গুটিয়ে বসে থাকতে পারেন না এবং চড়া মূল্যস্ফীতি বল্গাহীন হওয়ার আগেই তাতে বাধা দিতে হবে।
বাস্তবতা এটাই যে, আমেরিকায় ফেডের কল্যাণে চাহিদা কমলে, সরবরাহ চক্রের ওপর চাপ কমব্বে–আর তখনই কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারবে ইউরোপ এবং বাকি বিশ্বও হয়তো।
অর্থনীতিবিদ হোল্গার স্কিমিডিং বলেন, 'আমাদের (ইউরোপ ও বাকি বিশ্বে) বেশিরভাগ মূল্যস্ফীতি হচ্ছে জ্বালানি, খাদ্য ও নিত্যপণ্যের চড়া দামের কারণে। আমেরিকায় চাহিদা কমলে স্বস্তি সামান্যই মিলবে। এতে আগামী ১২-১৮ মাসে মূল্যস্ফীতি (ইউরো জোনে) দশমিক ৫০ শতাংশীয় পয়েন্ট কমতে পারে'।
আমেরিকায় চাহিদা কমার এই সম্ভাবনাকে অবশ্য অন্যপথে নিতে চলেছে শক্তিশালী ডলার। মুদ্রাটির বিপরীতে বিশ্ববাণিজ্যের অন্য বহুল প্রচলিত মাধ্যম ইউরো ও জাপানি ইয়েনের দরপতন ঘটছে। ফলে আমেরিকার জন্য আমদানি করা হয়ে উঠছে আরও সস্তা– এতে আমেরিকায় মূল্যস্ফীতির চাপও কমছে–কিন্তু অন্য দেশগুলির জন্য আমদানি হয়ে উঠছে ব্যয়বহুল এবং তা তাদের মূল্যস্ফীতির পালে হাওয়া দিচ্ছে।
লুকা ফোরানারো এই পরিস্থিতিকে 'রিভার্স কারেন্সি ওয়ার' বা উল্টো মুদ্রাযুদ্ধ বলে আখ্যায়িত করেন। এমনটা বলার কারণ- মহামারির আগে রপ্তানি বাড়াতে বড় অর্থনীতিগুলোর মধ্যে (বিশেষত আমেরিকা ও চীন) নিজ মুদ্রা অবমূল্যায়নের এক প্রতিযোগিতা দেখা গিয়েছিল। বর্তমানে ঘটছে ঠিক তার বিপরীত। ফেডের সুদহার বৃদ্ধি আমেরিকার আমদানি চাপ কমালেও, ডলার শক্তিশালী হওয়ায়, অন্যান্য দেশকে তাদের সুদহার বৃদ্ধিতে বাধ্য করছে।
তিনি বলেন, 'এখন সব দেশ যা করবে তা হলো নিজস্ব মুদ্রাকে শক্তিশালী করার চেষ্টা এবং সহনীয় বাণিজ্য ঘাটতি বজায় রাখা; এতে তাদের অভ্যন্তরীণ মূল্যস্ফীতি মোকাবিলা সহজ হবে'।
'মুদ্রাকে মূল্যায়নের এ প্রতিযোগিতায় এপর্যন্ত স্পষ্ট বিজয়ী যুক্তরাষ্ট্র। অন্যদিকে, ইউরোপের মতো জ্বালানি চাহিদা মেটাতে সিংহভাগ আমদানির ওপর নির্ভরশীল এশিয়ার দেশগুলোও পড়েছে ঝুঁকিতে। ঝুঁকিতে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ অর্থনীতি এবং জ্বালানি তেলের সবচেয়ে বড় আমদানিকারক চীনও। গত সপ্তাহে চীনের প্রধানমন্ত্রী লি কেকিয়াং সতর্ক করে বলেন, 'আমদানি হয়ে আসা এই মূল্যস্ফীতি' নিয়ন্ত্রণে চীনা কর্মকর্তাদের অবশ্যই উদ্যোগ নিতে হবে।
নোমুরা হোল্ডিং ইনকর্পোরেশনের বিশ্ববাজার গবেষণা শাখার প্রধান রব সুব্রাহ্মণ জানান, ফেড যে হারে নীতিনির্ধারণী সুদহার বাড়িয়েছে, সে তুলনায় বাড়াতে এখনও সংযম দেখাচ্ছে এশিয়ার প্রধান প্রধান অর্থনীতির কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো। এতে শক্তিশালী ডলারের প্রভাব আরও বহুগুণে বাড়তে পারে।
এখানে প্রধান ঝুঁকি হিসেবে তিনি বলেছেন, সুদহারের ক্রমবর্ধমান ব্যবধানকে, 'যা (আমেরিকায়) পুঁজি চলে যাওয়াকে উৎসাহিত করছে এবং তাতে করে ডলারের বিপরীতে এশীয় মুদ্রাগুলি শিকার হতে পারে আরও খাড়া দরপতনের, বাড়বে মূল্যের চাপ।'
ইতোমধ্যেই, বাংলাদেশ, ভারত, শ্রীলঙ্কাসহ এশিয়ার অনেক দেশেই বেড়েছে ডলারের মান। যা উস্কে দিচ্ছে মূল্যস্ফীতির সংকটকেই।
- সূত্র: ব্লুমবার্গ অবলম্বনে