ত্রিমুখী সমস্যায় টেক্সটাইল মিলাররা
ইয়ার্নের দরপতন, গ্যাসের চাপ কম থাকা ও জ্বালানি তেলের রেকর্ড মূল্যবৃদ্ধি—এই ত্রিমুখী ধাক্কায় জেরবার স্থানীয় টেক্সটাইল মিলাররা।
এর সঙ্গে যোগ হয়েছে কারখানাগুলোর অঞ্চলভিত্তিক সাপ্তাহিক ছুটি এবং বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির সম্ভাবনার মতো নতুন দুই সমস্যা।
যুদ্ধ পরিস্থিতিতে বিশ্বজুড়ে মূল্যস্ফীতির ধাক্কায় আন্তর্জাতিক বাজারে তৈরি পোশাকের চাহিদা এবং এর প্রধান কাঁচামাল ইয়ার্নের চাহিদাও কমছে। একই সময়ে কমছে তুলার দামও। এর ফলে স্থানীয় টেক্সটাইল মিলগুলোর উৎপাদিত ইয়ার্নের দাম গত তিন মাসে প্রায় ২০ শতাংশ কমে গেছে।
শিল্প সংশ্লিষ্টরা স্থানীয় বলছেন, কটনের দামের তুলনায় বেশি হারে কমছে ইয়ার্নের দাম, যার মূল কারন বিশ্ববাজারে পোশাকের চাহিদায় ভাটা। তিন মাস আগে প্রতি কেজি ইয়ার্নের (৩০ কাউন্ট কার্ডেড, যা সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয়) দাম ছিল ৫.২ ডলার, যা বর্তমানে ৪ ডলারে বিক্রি হচ্ছে।
এর ফলে বর্তমানে প্রতি কেজি ইয়ার্নে ০.৫০ থেকে ০.৭০ ডলার লোকসান গুনতে হচ্ছে। এভাবে ক্রমাগত লোকসান গুণতে থাকলে অনেক উদ্যোক্তাদের পক্ষে সময়মত ব্যাংক ঋণের অর্থ পরিশোধও কঠিন হয়ে যাবে বলে খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন।
এর মধ্যেই টেক্সটাইল খাতে নতুন করে এ খাতে আরো ৩ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ তাদের মধ্যে আরো উদ্বেগ তৈরি করেছে।
স্পিনিং মিল মালিকরা বলছেন, অনেক পোশাক কারখানা প্রোফরমা ইনভয়েস (পিআই) নেওয়ার পর নির্দিষ্ট সময় পর ঋণপত্র (এলসি) খোলার শর্ত মানছে না। আবার এলসি খুললেও ইয়ার্ন নিচ্ছে না। ক্রমাগত দর কমতে থাকায় ঠিক হওয়া দরের চেয়েও কম দর দিতে চায়।
পিআই হচ্ছে প্রাথমিক দরকষাকষি মূল্য ও পরিমাণ যার ভিত্তিতে একটি নির্দিষ্ট সময় পর ক্রেতার পক্ষে এলসি ইস্যু করা হয়। পিআই পাওয়ার পর একজন ক্রেতাকে সাধারণত ৭ থেকে ১৫ দিনের মধ্যে এলসি নিশ্চিত করতে হয়।
বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ আলী খোকন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'আমাদের কাছে অনেক স্পিনিং মিল মালিক অভিযোগ করছেন, পিআই দেওয়ার পর নির্দিষ্ট সময়ে এলসি খুলছে না, আবার এলসি খুললেও পণ্য নিচ্ছে না বিভিন্ন অজুহাতে। আমরা এ বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করছি।'
বিটিএমএর অপর একজন নেতা নাম না প্রকাশের শর্তে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান, শিগগিরিই তারা ইস্যুটি নিয়ে পোশাক শিল্প মালিকদের দুই সংগঠনের সঙ্গে বৈঠক করার কথা ভাবছেন।
গত আট থেকে নয় মাস আগে ঠিক উল্টো ঘটনা ছিল। তখন চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় অনেক স্পিনিং মিল মালিক পিআই দিলেও দাম বাড়তে থাকায় ইয়ার্ন নেই বলে এলসি দিচ্ছিলেন না কিংবা বাড়তি দাম পাওয়ায় অন্য কারো কাছে বিক্রি করেছিলো।
বাংলাদেশের নিটওয়্যার পোশাক তৈরিতে মূলত স্থানীয় টেক্সটাইল মিলগুলোর ইয়ার্ন বেশি ব্যবহার হয়ে থাকে। বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের নির্বাহী প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ হাতেম বলেন, 'ইয়ার্নের দাম গত তিন মাসে প্রায় এক ডলার কমে গেছে, এটি সত্য।' শুধু তাই নয়, স্পিনিং মিলগুলো বর্তমানে লোকসানে পড়েছে বলে যে কথা বলা হচ্ছে, তার সঙ্গেও একমত প্রকাশ করেন তিনি।
নারায়ণগঞ্জের নিট পোশাক কারখানা এমবি নিট ফ্যাশনসের মালিক মোহাম্মদ হাতেন চাহিদা কমার কারণ ব্যাখ্যা করে বলেন, 'একদিকে আমাদের প্রধান রপ্তানি বাজারে ২০ শতাংশের মত পোশাকের চাহিদা কমছে। আবার ইয়ার্নের দাম কমতে থাকায় বিদেশী বায়াররাও অর্ডার ধরে রাখছেন, যার কারণে আমাদের পোশাক শিল্প মালিকরা পুরো পণ্যের হয়তো এলসি খুলতে পারছেন না।'
নিজের কারখানার উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, তার ইউরোপের একজন ক্রেতার ৫ মিলিয়ন ডলারের পোশাকের অর্ডার চূড়ান্ত করার পর অর্ডার শিট দিয়েছে এক লাখের। বাকি ৪ মিলিয়ন ডলারের অর্ডার শিট হাতে ধরে রেখেছে, ইয়ার্নের দাম কমার আশায় যা অনৈতিক।
কিন্তু তাদেরও করার কিছু নেই বলে মন্তব্য করেন মোহাম্মদ হাতেম।
অর্ডার শিট হলো, যে পরিমাণ পণ্য তৈরি করা হবে, তা নিশ্চিত করা। এর ভিত্তিতে মূলত ক্রেতা রপ্তানিকারকের পক্ষে এলসি খোলেন।
সূত্র জানায়, চাহিদা কমায় স্পিনিং মিলগুলোতে স্বাভাবিকের চাইতে তিন থেকে চারগুণ ইয়ার্ন জমে গেছে। অন্যদিকে ইয়ার্নের মূল কাঁচামাল কটনের দাম গত এক মাস ধরে কমছে না, কিন্তু ইয়ার্নের দাম কমতে থাকায় এবং আগে বেশি দামে ইয়ার্ন কেনায় তাদের এখন প্রতি কেজি ইয়ার্নে ০.৫০ থেকে ০.৭০ ডলার লোকসান গুনতে হচ্ছে।
দেশের অন্যতম বৃহৎ টেক্সটাইল মিল মোশারফ কম্পোজিট টেক্সটাইল মিলস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মোশারফ হোসেন বলেন, গত এক মাসের কিছু বেশি সময়ে তার অন্তত ৫ জন ক্রেতাকে পিআই দেওয়ার পর তারা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে এলসি খোলার শর্ত মানেনি। আবার একজন ক্রেতা এলসি খোলার পরও পণ্য গ্রহণ করেনি।
তিনি বলেন, পিআই দেওয়ার পরও তারা ১০থেকে ২০ সেন্ট দাম কমিয়ে দেওয়ার শর্ত দেয়। এ পরিস্থিতিতে সবাই লোকসানে পড়েছে।
তিনি বলেন, এভাবে চলতে থাকলে, কারখানার মূল ব্যয় বিশেষত স্পেয়ার পার্টস ক্রয় আর গ্যাস-বিদ্যুতের অর্থ পরিশোধ করতে হবে সবার আগে। সেক্ষেত্রে অনেকের পক্ষেই সময়মত ব্যাংক লোনের অর্থ শোধ করা সম্ভব না-ও হতে পারে।
বাংলাদেশ বিশ্বের দ্বিতীয় শীর্ষ তুলা আমদানিকারক। ২০২১ সালে বাংলাদেশ প্রায় ৮.২ মিলিয়ন বেল তুলা আমদানি করেছে। টেক্সটাইল মিলাররা আশা করছেন, এ বছর তুলা আমদানি ৯ মিলিয়ন বেলে পৌঁছাবে।
বিটিএমএর তথ্যমতে, দেশে স্পিনিং, ফেব্রিক, ডাইং-প্রিন্টিং এবং ফিনিশিংসহ ১ হাজার ৫০টিরও বেশি টেক্সটাইল মিল রয়েছে, যেগুলো সংস্থাটির সদস্য। আরও প্রায়১ হাজার মিল আছে যেগুলো তুলনামূলকভাবে ছোট।
বিটিএমএর তথ্যানুযায়ী, দেশে টেক্সটাইল মিলগুলোর মোট বিনিয়োগ প্রায় ৭ বিলিয়ন ডলার।