স্বল্প আয়ের মানুষদের জন্য কঠিন হয়ে উঠেছে জীবিকা
বাইতুল মোবারক মসজিদের সামনের রাস্তায় জুতা সেলাই করে জীবিকা নির্বাহ করেন ৪৫ বছর বয়সী শান্তি চন্দ্র দাস। চলমান মুদ্রাস্ফীতি ও জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির আগে তার দৈনিক রোজগার ছিল ৬০০ থেকে ৫০০ টাকা, এখন তা কমে গিয়ে সারাদিনে আয় হয় ৩৫০ থেকে ৪৫০ টাকা। এই টাকায় সংসার খরচ বহন কঠিন হয়ে উঠেছে। ফলে বাধ্য হয়েই নিজের ৬ষ্ঠ শ্রেণি পড়ুয়া ছেলেকে কাজে পাঠিয়েছেন শান্তি।
শান্তি চন্দ্র দাস দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "আমার ইচ্ছে ছিল আমার ছেলে পড়ালেখা করুক, কিন্ত বাসাভাড়া ও মা-বাবা, স্ত্রী-সন্তানসহ ৬ জনের সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছি। তাই চোখে-মুখে কোনো পথ না দেখে বাধ্য ছেলেকে সংসারে বাড়তি কিছু টাকা আয়ের জন্য গ্যারেজ ওয়ার্কশপে কাজে লাগিয়ে দিয়েছি।"
আয়-ব্যয়ের এই অসামঞ্জস্য নিদারুণ যন্ত্রণায় শান্তি চন্দ্র দাসের সংসারে শান্তি নেই বললেই চলে। তাই নিরুপায় হয়ে গত ১৫ দিন আগে ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র ছেলে ঋতিক চন্দ্র দাসের পড়াশোনা বন্ধ করতে বাধ্য হন তিনি।
শান্তি চন্দ্র দাসের মতই চলমান মুদ্রাস্ফীতির নিদারুণ কষ্টে ভুগছেন রিক্সাচালক মোহাম্মদ আবলু। থাকেন রায়েরবাগ বস্তিতে; সংসারে বৃদ্ধা মা, স্ত্রী-সন্তানসহ ৭ জন। চলমান দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির প্রভাবে আবুলের আয় কমে যাওয়া ও সংসারে খরচ বড়ে যাওয়ায় দিন দিন তার অর্থনৈতিক পরিস্থিতি অনুকূলের বাহিরে চলে যাচ্ছে।
মোহাম্মদ আবুল টিবিএসকে বলেন,"মানুষের হাতে টাকা না থাকায় ও জিনিসপত্রের দাম বাড়ায় মানুষ আগের মতো আর রিক্সায় খুব প্রয়োজন না হলে উঠে না। একটু কাছের রাস্তার হলে হেঁটেই ইদানিং চলে যায়, তাই আমাদেরও ইনকাম কমে গেছে। কিন্তু জিনিসপত্রের দাম বাজারে তো আগুন, আমাদের তো সব জিনিস আগের তুলনায় দুই গুণ দামে কিনতে হচ্ছে।"
মুদ্রাস্ফীতি ও আয় কমে যাওয়ায় সংসারের বাড়তি ব্যয় মেটাতে না পারা দিশেহারা মোহাম্মদ আবুল বাধ্য হয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, মেয়ে ( নবম শ্রেণির ছাত্রী, এখন পড়াশোনা বন্ধ) ও স্ত্রীকে কোনো গার্মেন্ট কারখানায় কাজে পাঠাবেন।
"কাজ খুঁজতেছি, কিন্তু ৭-৮ দিন চেষ্টা করার পরেও এখন পর্যন্ত কোনো কাজ জোগাড় করতে পারিনি", বলেন আবুল।
বাজারে সব পণ্যের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় খেটে-খাওয়া, নিম্ন, স্বল্প ও মধ্য আয়ের মানুষদেরও ইদানিং রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ওএমএসের দোকানগুলোতে ভিড় করতে দেখা যাচ্ছে। এসব দোকান থেকে শুধু চাল ও আটা কিনতে পারলেও মাছ, মাংস, শাকসবজিসহ সংসারের বাজার তালিকার অন্য সবকিছুই বাইরে থেকে বেশি দামে কিনতে হিমশিম খাচ্ছেন স্বল্প আয়ের মানুষেরা।
২০২১ সালের ৩১ মার্চ থেকে ৫ এপ্রিল পর্যন্ত ব্র্যাক পরিচালিত এক সমীক্ষায় দেখা যায়, সমাজে চরম দারিদ্র্যের হার আগের তুলনায় বেড়েছে ৬০ শতাংশ।
সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)-এর ২০২০ সালের মার্চ থেকে অক্টোবর পর্যন্ত আরেকটি জরিপে দেখা গেছে, করোনাকালীন দেশে মানুষের আয় কমেছে ২০ শতাংশ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সায়মা হক বিদিশা টিবিএসকে বলেন, "বিবিএসের তথ্যে যা উঠে এসেছে, তার থেকেও মানুষ বেশি বিপদের মধ্যে আছে। বর্তমানে দেশের বাজারে দ্রব্যমূল্য অস্বাভাবিক।"
"এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য সরকারকে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে আরও বেশি বরাদ্দ দিতে হবে। নিম্ন আয়ের লোক যেন কম মূল্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কিনতে পারে, এজন্য টিসিবির মাধ্যমে প্রত্যন্ত অঞ্চলে পণ্য বিক্রি করতে হবে", যোগ করেন তিনি।