খাবার খরচ কাটছাঁট করছে মধ্য ও নিম্ন আয়ের মানুষেরা
ঢাকার পল্টনে গত বৃহস্পতিবার ভরদুপুরে রুটি-কলা খাচ্ছিলেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের বিক্রয়কর্মী হেদায়াতুল ইসলাম। দুপুরে ভাত না খেয়ে রুটি-কলা কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, রাস্তার সাধারণ কোনো রেস্তোরাঁতে এক বেলা সবজি, ডাল ও ভাত খেতেও ১০০ টাকা লেগে যায়। সংসারের অতি প্রয়োজনীয় খরচের টাকা বাঁচাতে তিনি দুপুরে রুটি-কলা খেয়ে কাটানো শুরু করেছেন।
হেদায়াতুল ইসলাম বলেন, "গত জানুয়ারি মাসে বাসাভাড়া ৫০০ টাকা বেড়েছে। ছেলের স্কুলে যাওয়া-আসার জন্য দিনে রিকশাভাড়া লাগত ২০ টাকা করে ৪০ টাকা। এখন লাগে ৬০ টাকা। চাল, ডাল, তেল, চিনিসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যে ৫০০০ টাকার স্থলে ৮০০০ হাজার টাকা লাগছে। অফিসে যাওয়া-আসা করতেও বাসভাড়া বেশি দিতে হচ্ছে। কিন্তু আমার আয় এক বছর আগে যা ছিল, এখনো তা-ই আছে। ফলে সংসারের অনেক প্রয়োজনীয় খরচ কমাতে হয়েছে।"
তিনি বলেন, "আগে প্রতি সপ্তাহে একবার গরুর গোশত কেনা হতো, এখন সেটি পুরোপুরি বন্ধ। প্রতিমাসে এক কেজি গুঁড়াদুধ কেনা হতো সেটিও বন্ধ করেছি। ছেলের প্রাইভেটের জন্য ৩০০০ টাকা ব্যয় হতো সেটি বন্ধ রেখেছি। ছোটখাটো রোগে ওষুধ কেনাও বন্ধ করেছি। তবুও ধার-কর্জ করে সংসার চালাতে হচ্ছে।"
ঢাকার নিম্নআয়ের মানুষের বসবাসস্থল খ্যাত ডেমরার বাসিন্দা আনোয়ার হোসেন চাকরি করেন একটি ডেভেলপার কোম্পানিতে। তার দুইজনের পরিবারের বর্তমান ব্যক্তিগত খরচের হিসাব তুলে ধরেছেন এই প্রতিবেদকের কাছে।
তিনি বলেন, "শনিবারের বাজারদর অনুযায়ী হিসাব করে দেখেছি চলতি মাসে আমার পরিবারের জন্য এক বস্তা চাল, পাঁচ লিটার তেল, মাছ, সবজি, ডাক্তারের ওষুধ, খুব প্রয়োজনীয় কসমেটিকস, মুদিবাজার, গ্যাস বিল, পানি বিল, বিদ্যুৎ ও বাসা ভাড়ায় ২৬,৩০০ টাকা দরকার হবে। কিন্তু আমার বেতন ২২,৫০০ টাকা।"
"গোশত, দুধ ও ফলসহ প্রোটিন খাওয়া এবং কোনো ধরনের পোশাক-আশাক না কিনলেও বেতনের চেয়ে ৪০০০ টাকা বেশি খরচ হবে। এক মাস আগেও সব খরচ বাদ দিয়ে প্রতিমাসে ২-৩ হাজার টাকা হাতে থাকতো। খরচ কমিয়েও এখন টিকে থাকা সম্ভব হচ্ছে না," যোগ করেন আনোয়ার হোসেন।
আনোয়ার হোসেন এবং হেদায়াতুল ইসলামের মতোই সংকটে পড়েছে সাড়ে ৩ কোটির বেশি নিম্নআয়ের মানুষ। এমনই একজন ময়মনসিংহের গৌরিপুরের মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষক মোঃ আব্দুল মালেক সৌরভ।
জ্বালানী তেলের মূল্যবৃদ্ধির বিপাকে পড়েছেন এ শিক্ষক। বাড়ি থেকে প্রায় ৪৫ কিলোমিটার দূরের স্কুলে বাইকে চলাচল করেন তিনি।
তিনি বলেন, "জুলাই মাসে বেতন বাড়লো ৮৮৫ টাকা। চলতি মাসে তেলের দাম বাড়াতে শুধু মোটরসাইকেলের খরচই বাড়ছে ১০০০ টাকা। এছাড়াও সবকিছুর দাম বেড়ে সংসার খরচ বেতনের দ্বিগুণ হয়েছে। গোশত, ফল খাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে। পোশাক, কসমেটিকসও কিনছি না। ঋণের বোঝাও বাড়ছে।"
রাজধানীর মগবাজারে বেসরকারি কোম্পানির চাকরিজীবি আবু বকর বলেন, "দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে খরচ অনেক কমিয়েও কয়েক মাস ধরে পারিবারিক খরচ বেড়েছে তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকা। আর জ্বালানীর মূল্য বৃদ্ধিতে তা গিয়ে দাঁড়ালো সাড়ে চার হাজার টাকায়।"
সংকটে সরকারি ছোট চাকরিজীবিরাও
নন-ক্যাডার সরকারি চাকরিজীবিদের ফেসবুকে প্রাইভেট গ্রুপে দেয়া একটি পোস্টে উঠে এসেছে তৃতীয় শ্রেণী ১০-২০তম গ্রেডের কর্মচারীদের সংকটের কথা। দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির কারণে সংসার চালানো যাচ্ছে না উল্লেখ করে সেখানে অসহায়ত্বের প্রকাশ ঘটিয়েছেন এক পুলিশ সদস্য।
২০তম গ্রেডের একজন কর্মচারী ৮২৫০ টাকা বেতন পান উল্লেখ করে তিনি বলেন, "দ্রব্যমূল্যের এ বাজারে বেতনের টাকায় শুধু চাল আর সবজি কিনতেই বেতনের টাকা শেষ হয়ে যায়। বর্তমান বাজার পরিস্থিতি বিবেচনা করলে ৮২৫০ টাকা বেতনের কর্মচারীরা কতটা অসহায়ভাবে দিনযাপন করছে তারা ছাড়া কেউ বুঝবে না। আমার ৮০% বন্ধুবান্ধব সহকর্মী লোন তুলে সংসারের খরচ মেটাচ্ছে, কেউ কেউ টপআপ লোন মানে দ্বিতীয়বার লোন তুলেছে।"
তিনি বলেন, "আমরা ১১-২০ গ্রেডের বেতন বৈষম্য নিয়ে আন্দোলন করতে পারি না। আমাদের সমস্যার সমাধানও হয় না। বড় বড় কর্তারা ৮ গুণ পর্যন্ত বেশি বেতন পান, তাই তারা আমাদের কথা ভাবেন না।"
নিম্ন আয়ের বিপদ আরো বেশি
রিক্সাচালক জহিরুল হক (৪২) ময়মনসিংহ থেকে জীবিকার তাগিদে ঢাকায় আসেন ২০০৭ সালে। চলমান মুদ্রাস্ফীতিতে রাজধানীতে আগের মতো তেমন যাত্রী পাচ্ছেন না, কমেছে দৈনিক আয়ও। আগে দৈনিক ৫০০-৭০০ টাকা আয় হলেও বর্তমানে তা হয়ে গেছে ৪০০-৫০০ টাকা। ঢাকায় মেসভাড়া, খাওয়া খরচ ও গ্রামে পরিবারকে টাকা পাঠাতে হিমশিম খাচ্ছেন জহিরুল।
জহিরুল হক টিবিএসকে বলেন, "মানুষের হাতে টাকা না থাকায় ও জিনিসপত্রের দাম বাড়ায় মানুষ আগের মতো রিক্সায় আর তেমন প্রয়োজন না হলে ওঠে না, একটু কাছের রাস্তা হলে ইদানিং হেঁটেই চলে যায়, তাই আমাদেরও আয় কমে গেছে। কিন্তু জিনিসপত্রের দামে বাজারে আগুন, আমাদের তো সব জিনিস দুইগুণ বেশি দামে কিনতে হচ্ছে।"
কল্যাণপুর বস্তিতে প্রায় ২৫ বছর ধরে সপরিবার থাকেন দিনমজুর মো. ফরিদ উদ্দিন। পরিবারের বড় ছেলের বউ ব্যতীত সবাই-ই ছোটখাট কাজ করে। এরপরেও মাসের খরচ মেটাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাদের। জ্বালানী তেলের মূল্য বৃদ্ধির পরে নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় শাকসবজিই খেয়ে যাচ্ছেন গত এক মাস ধরে।
ফরিদ উদ্দিন টিবিএসকে বলেন, "এক ছেলে আর আমি লেবারের কাজ করি। সপ্তাহে ১ দিন কাজ পেলে ২ দিন বসে থাকতে হয়। দৈনিক হাজিরা ৬০০ টাকার বেশি দেয় না। স্ত্রী বাসাবাড়িতে কাজ করে মাসে ৫ হাজার টাকার মতো উপার্জন করে। পরিবারের ৫ জন সদস্যের মধ্যে ৪ জনে মাসে ২৫ হাজার টাকার মতো আয় করি। এ টাকা দিয়ে বাসা ভাড়া, বিদ্যুত বিল, গ্যাস, চাল-ডালেই চলে যায় ২০ হাজার টাকার মতো। ঈদের পরে আর মুরগি কিংবা গরুর মাংস খেতে পারিনি। মাঝে মাঝে ডিম খেতাম কিন্তু গত ১০ দিন ধরে ডিমও খেতে পারছি না। শাক-সবজি আর আলু দিয়েই খাচ্ছি গত কয়েকদিন ধরে।"