দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি: টিকে থাকার লড়াইয়ে হিমশিম খাচ্ছেন পোশাক শ্রমিকরা
রাজধানীর অদূরে নারায়ণগঞ্জে রাসেল গার্মেন্টস নামে একটি কারখানায় কাটিং হেলপার হিসেবে কাজ করেন রহিমা। দুই সন্তানে জন্য মাঝেমধ্যে বাজারের অপেক্ষাকৃত সস্তা মাছ আর ব্রয়লার মুরগি কিনতেন তিনি। কিন্তু এই দুর্মূল্যের বাজারে মাসিক ৯ হাজার টাকা বেতনে এখন আর মাছ-মুরগি খাওয়ার সামর্থ্য নেই তার।
সম্প্রতি দ্রব্যমূল্য অনেক বেশি বেড়ে যাওয়ায় ব্রয়লার মুরগি কেনা বাদ দিয়েছেন তিনি। মাছও কিনছেন না গত ১৫ দিন ধরে। ডিমের হালি ৫০ টাকা পার হলেও ডিমই কিনতে হচ্ছে।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের সঙ্গে আলাপকালে রহিমা বলেন, "গত মঙ্গলবার বাজারে গিয়ে তিনটি ডিম কিনেছি। আগে ব্রয়লার মুরগি ১২০ টাকায় কিনতাম, এখন ২০০ টাকা দিয়ে কীভাবে কিনব? এরমধ্যে আবার শুনছি, বাড়িওয়ালা ভাড়া বাড়াবে। গ্রামে বাবা-মাকে কিছু টাকা পাঠাতাম। গত ৪ মাস ধরে আর পাঠাতে পারছি না।"
ঢাকার আশপাশের এলাকার ৫ জন শ্রমিকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তারাও দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির সঙ্গে লড়াই করছেন। পণ্যমূল্য বেড়ে যাওয়ায় তাদের আমিষ চাহিদা পূরণে ব্যয় কমিয়ে দিতে হয়েছে, গ্রামে টাকা পাঠানোর পরিমাণ কমেছে বা বন্ধ হয়ে গেছে। যারা কিছু সঞ্চয় করছিলেন, সেই পরিমাণও কমে গেছে বা বাদ দিতে হয়েছে।
দেশের কয়েকটি বড় পোশাক কারখানা শ্রমিকদের বাজার মূল্যের চেয়ে কিছুটা কম দামে পণ্য দেওয়ার লক্ষ্যে বিভিন্ন নামে 'ফেয়ার প্রাইস শপ' বা ন্যায্য মূল্যের দোকান চালু করেছে। তবে পণ্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে ওইসব প্রতিষ্ঠানেও দাম যথারীতি বেড়েছে। বরং জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধির কারণে ফেয়ার প্রাইস শপ চালানোর জন্য তাদের অপারেটিং কস্ট বেড়েছে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ।
এসব শ্রমিকদের কেউই সরকারের দেওয়া ভর্তুকি মূল্যের পণ্য কেনার জন্য ফ্যামিলি কার্ড পাননি বলে জানিয়েছেন।
গত কয়েক মাস ধরেই পণ্যমূল্য বাড়ছিল, যা স্বাভাবিকভাবেই সার্বিক মূল্যস্ফীতিকে বাড়িয়ে তুলেছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)-এর সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, দেশে গত ৮ বছরে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি হয়েছে।
এর মধ্যেই চলতি মাসের শুরুর দিকে জ্বালানি তেলের দাম এক লাফে সর্বোচ্চ ৫১ বাড়ায় সরকার, যা এ যাবতকালের সর্বোচ্চ। ফলে লাফিয়ে বাড়তে থাকে প্রায় সব পণ্যের দাম। এর ফলে কেবল পোশাক শ্রমিকই নয়, সব শ্রেণির স্বল্প আয়ের মানুষের নাগালের বাইরে চলে যায় নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য।
সরকারি প্রতিষ্ঠান ট্রেডিং কর্পোরেশন অফ বাংলাদেশ (টিসিবি)-এর প্রকাশিত গত বৃহস্পতিবারের (১৭ আগস্ট) তথ্য অনুযায়ী, গত এক বছরের ব্যবধানে চালের দাম বেড়েছে প্রায় ১২ শতাংশ, আটা ৭৫ শতাংশ, মশুর ডাল ৪১ শতাংশ, অ্যাংকর ডাল ৫৩ শতাংশ, সয়াবিন তেল ৪১ শতাংশ, মুরগি (ব্রয়লার) ৫৬ শতাংশ এবং ডিমের দাম বেড়েছে ৫৪ শতাংশ।
কাঁচপুর এলাকায় এসএফ ওয়াশিং লিমিটেডের শরীফ কর্মী টিবিএসকে বলেন, "গত ৩/৪ মাস ধরে মুরগি কিনি না। এখন তেলাপিয়া আর পাঙ্গাস মাছ কিনি, তাও পরিমাণে কম।"
তিনি বলেন, "এই সময়ে বেতন বাড়ার খুব দরকার, কিন্তু বাড়ছে না।"
শ্রমিক নেতারাও শ্রমিকদের নতুন করে মজুরি বাড়ানোর দাবি জানিয়ে আসছেন। এই দাবিতে গত মার্চে হঠাৎ করেই শ্রমিকরা রাজধানীর মিরপুরসহ কিছু এলাকায় অবরোধ করে।
বাংলাদেশ সেন্টার ফর ওয়ার্কার্স সলিডারিটির নির্বাহী পরিচালক কল্পনা আক্তার মনে করেন, বর্তমান বাস্তবতায় শ্রমিকদের টিকে থাকার জন্য মজুরি বৃদ্ধি করা উচিত।
টিবিএসকে তিনি বলেন, "বছরে পোশাক শ্রমিকদের বেতন বাড়ে মূল বেতনের ৫ শতাংশ। কিন্তু পণ্যমূল্য বাড়ছে তার চেয়ে অনেক বেশি হারে। এ অবস্থায় মজুরি বাড়ানো দরকার। নিদেনপক্ষে বাজার মূল্যের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ডিয়ারনেস অ্যালাউন্স এবং রেশনিং (ভর্তুকি মূল্যে পণ্য সরবরাহ) দেওয়া দরকার। অন্যথায়, দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে তারা সামনে এগুবে, যেটা মিরপুরে দেখা গিয়েছিল।"
পোশাক খাতের মালিকরা পণ্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে শ্রমিকের ওপর চাপ বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি স্বীকার করলেও বেতন বাড়াতে রাজি নন। যদিও ডলারের মূল্য বৃদ্ধির কারণে আমদানি পণ্যের দাম বেড়েছে, রপ্তানিকারকরা প্রতি ডলারের বিপরীতে (কাঁচামাল আমদানিসহ অন্যন্য ব্যয় বাদ দিয়ে একচ্যুয়াল রিটেনশনের ওপর) ১০ টাকা বা তারও বেশি আয় করছেন।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, "ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে আমরা হয়ত ১০ টাকা বাড়তি পাচ্ছি, কিন্তু জ্বালানি তেলের দাম, বিদ্যুৎ-গ্যাসের দাম বৃদ্ধি, ৫ শতাংশ ইনক্রিমেন্টসহ অন্যান্য খরচ বেড়ে যাওয়ায় ১৫ টাকা খরচ হয়ে যাচ্ছে। ফলে এই মুহূর্তে নতুন মজুরি কিংবা ডিয়ারনেস অ্যালাউন্স দেওয়া সম্ভব নয়।"
"কেবল গার্মেন্টস শ্রমিকরাই নন, সব মানুষই চাপে রয়েছে", যোগ করেন তিনি।
বিজিএমইএর ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শহীদুল্লাহ আজিম টিবিএসকে বলেন, বর্তমানে প্রায় সব কারখানায় অর্ডারের পরিমাণ ২০ থেকে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত কমেছে।
"অন্যদিকে, গত চার-পাঁচ মাসে উৎপাদন খরচ প্রায় ৮ শতাংশ বেড়েছে। তাই মজুরি বাড়ানোর এখনই সঠিক সময় নয়। নিয়ম অনুযায়ী, পরের বছর মজুরি বোর্ড গঠন হওয়ার কথা।"
তিনি দাবি করেন, কিছু কারখানা এখন ঋণ নিয়ে শ্রমিকদের বেতন পরিশোধ করছে।
ডলারের দাম বাড়ায় রপ্তানিকারকরা বাড়তি আর্থিক সুবিধা পাচ্ছে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, ডলারের মুনাফা মূলত ব্যাংক পাচ্ছে, রপ্তানিকারকরা নয়।
অগ্রগতি নেই শ্রমিকদের রেশনিংয়ের দাবি বাস্তবায়নে
শ্রমিকদের ভর্তুকি মূ্ল্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য দেওয়ার দাবি গত কয়েক বছর ধরে জোরালো হলেও সরকার বা মালিকপক্ষ তার উদ্যোগ নিচ্ছে না। বরং পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনস (বিজিএমইএ) বল ঠেলে দিয়েছে সরকারের কাছে।
চলতি বছরের ১৫মার্চ বেশিরভাগ পোশাক কারখানা রয়েছে, এমন জায়গায় ট্রেডিং কর্পোরেশন অফ বাংলাদেশ (টিসিবি) কে ৪০ ট্রাক ভর্তুকিযুক্ত পণ্য বিক্রির ব্যবস্থা করার অনুরোধ করেছিল বিজিএমইএ। তবে এখনো কোনো অগ্রগতি হয়নি বলে বিজিএমইএ সূত্রে জানা গেছে।
এ ব্যাপারে মোহাম্মদ হাতেম বলেন, "আমরা আবার চিঠি দেব।"
বাংলাদেশ টেক্সটাইল গার্মেন্টস ওয়ার্কার্স ফেডারেশনের সভাপতি তাওহিদুর রহমান টিবিএসকে বলেন, গার্মেন্টস শিল্প অধ্যুষিত এলাকায় শ্রমিকদের জন্য সহজলভ্য উপায়ে রেশনিংয়ের ব্যবস্থা করা দরকার।
ফেয়ার প্রাইস শপেও বেড়েছে পণ্যমূল্য
পোশাক কারখানাগুলো শ্রমিকদের জন্য স্বল্পমূল্যে পণ্য সরবরাহের উদ্দেশ্যে চালু করা ফেয়ার প্রাইস শপ গুলোতেও পণ্যমূল্য বেড়েছে। ঊর্মি গ্রুপ, প্রতিষ্ঠানটির প্রায় ১৪ হাজার শ্রমিকের জন্য চালু করেছিল এই উদ্যোগ। তবে প্রতিষ্ঠানটির চলতি আগস্টের পণ্যমূল্যের হিসাব অনুযায়ী, গত পাঁচ মাসের ব্যবধানে সয়াবিন তেল ১৭ শতাংশ, আটা ২৫ শতাংশ, লবণ ৩১ শতাংশ, মশুর ডাল ২১ শতাংশ এবং মোটা চালের দাম ১২ শতাংশ বেড়েছে। তবে এসব পণ্য বাজার মূল্যের চেয়েও কম দামে পাচ্ছেন শ্রমিকরা।
ডিবিএল গ্রুপ, ফকির ফ্যাশন, মোহাম্মদী গ্রুপ, অনন্ত গ্রুপ, এপিলিয়ন গ্রুপ, কিউট ড্রেস, এসকিউ সেলসিয়াস এবং নর্দান অ্যাপারেল ছাড়াও পোশাক খাতের বাইরে স্কয়ার গ্রুপ, মেঘনা গ্রুপ, আকিজ গ্রুপের এ ধরনের কার্যক্রম রয়েছে বলে জানা গেছে।
ব্যয় বেড়ে যাওয়া সত্ত্বেও ডিবিএল গ্রুপ তার ৩০ হাজারেরও বেশি শ্রমিকের জন্য এ উদ্যোগটি চালু রেখেছে। ডিবিএল গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান এম এ রহিম ফিরোজ টিবিএসকে বলেন, "আমরা যেই দামে কিনছি, ওই দামেই বিক্রি করছি। কোনো মুনাফা করছি না । কিন্তু সম্প্রতি ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় আমাদের অপারেটিং কস্ট প্রায় ১৫ শতাংশ বেড়েছে।"
সব কারখানায় এমন উদ্যোগ চালু হওয়া উচিত উল্লেখ করে, এক্ষেত্রে সরকারকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি।