ডলারের মুসিবত উন্নয়নশীল থেকে উন্নত দেশেও ছড়িয়ে পড়ছে
আমেরিকার কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভ চড়া হারে বাড়িয়েছে নীতিনির্ধারণী সুদহার। তাতে বাড়বাড়ন্ত শক্তিশালী হয়েছে দেশটির মুদ্রা- ডলার। অন্তত দুই দশকের মধ্যে ডলারের মূল্যমান বাড়ার এই উত্থানে, বিপাকে পড়ে উন্নয়নশীল বিশ্ব। আন্তর্জাতিক বাজারে যখন খাদ্য, জ্বালানি থেকে শুরু করে সকল পণ্যের দামই রকেট সওয়ারী–তখন আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য নিয়ে অশেষ দুর্গতি হয়েছে তাদের। ডলার সংকট নাজুক করেছে ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা, নিত্যপণ্যের সংকট শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান-সহ উন্নয়নশীল অনেক অর্থনীতিতে চরমভাবে অনুভব করছে জনতা।
ডলার বিশ্ববাণিজ্যের লেনদেনে প্রধানতম মুদ্রা হওয়ায় এতে করে, স্বল্পোন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশে লাফিয়ে বেড়েই চলেছে মূল্যস্ফীতি। শক্তিমান ডলারের বিপরীতে স্থানীয় মুদ্রা বিনিময় দর হারাতে থাকায়, প্রচণ্ড ক্ষতির মধ্যেই দেশগুলি।
তবে ডলার দানোর পদাঘাত এবার উন্নত দেশগুলির বুকেও চাপছে। এরমধ্যেই আগুনের ছোঁয়াচও লাগতে শুরু করেছে তাদের অর্থনীতিতে। ডলারের সংক্রামক মূল্যস্ফীতি থেকে তারাও সুরক্ষিত থাকতে পারছে না। আর্থিক নীতিও কঠোর করতে হচ্ছে নিয়ন্ত্রকদের।
নিজ নিজ মুদ্রার মান ধরে রাখতে বাকি বিশ্বের মতো ইউরোপের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলির ওপরও বাড়ছে সুদহার বৃদ্ধির চাপ। জ্বালানি সংকট ও ভোক্তাপণ্যের দামের অতল ঘূর্ণি নিয়ে যখন তাদের ভোক্তারা চোখে অন্ধকার দেখছে, সে সময়েই নিতে হবে সুদহার বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত। 'এ যেন শ্যাম রাখি, না কূল রাখি' অবস্থা।
শুধু ইউরোপ নয়, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা ও নিউজিল্যান্ডের মতো পশ্চিমা দুনিয়ার অন্য দেশকেও স্বস্তিতে রাখেননি 'মহামান্য ডলার'। সবুজাভ মার্কিন মুদ্রারাজের প্রতিপত্তি হ্রাসে তাদের সক্ষমতাও সীমিত, ফলে ডলারের দহন থেকে অচিরে নিস্তারও পাবে না; অন্তত স্বল্প-মেয়াদে তো নয়ই।
বাজারে তারল্য কমাতে ফেডারেল রিজার্ভ বা ফেড সুদের হার বাড়িয়ে আসলে মুদ্রাস্রোতে লাগামই দিতে চাইছে, যাতে কমে আসে মূল্যস্ফীতি, স্বস্তি পায় মার্কিন ভোক্তা। আর তাতেই দুনিয়াজুড়ে আরও আরাধ্য হয়ে উঠেছে ডলার।
তবে সমষ্টিগতভাবে দেখলে, মুদ্রাধিরাজের মান বৃদ্ধি বেশি উল্লেখযোগ্য হারে হয়েছে– উন্নয়নশীল আর উদীয়মান অর্থনীতির দেশের চেয়ে– উন্নত দেশগুলির মুদ্রার বিপরীতে।
চিন্তক-সংস্থা পিটারসন ইনস্টিটিউট ফর ইন্টারন্যাশনাল ইকোনমিক্সের জ্যেষ্ঠ ফেলো মরিস অবসফেল্ড বলেন, 'যুক্তরাষ্ট্রে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি সুদহার বৃদ্ধির মধ্যে দিয়ে ডলারের বাহুবল বাড়ে; আবার বিশ্ববাজার অস্থিতিশীল হলেও বিনিয়োগকারীরা মার্কিন মুদ্রার দিকে ঝোঁকেন সম্পদের নিরাপত্তার আশায়। এখন দুনিয়াজুড়ে মন্দার শঙ্কা উঁকি দিচ্ছে, আর্থিক বাজার সংকোচনের এসব হালহকিকত উন্নত অর্থনীতিগুলোর বিকাশের গতি কেড়ে নিচ্ছে '।
উন্নত দেশগুলির রিজার্ভে ডলার সংকটের দুর্ভাবনা অনেকটাই কম, কিন্তু ডলার শক্তিশালী থাকায় তাদের অর্থনীতি থেকেও পুঁজি চলে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রে। আর তাতে কমছে স্থানীয় উদ্যোগে পুঁজি লগ্নীর সুযোগ। মূল্যস্ফীতির এই সময়ে যখন কর্মসংস্থান ও বেতন বৃদ্ধির সুযোগ সৃষ্টি সবচেয়ে দরকারি–তখনই আগ্রাসী ডলার সে সুযোগ কেড়ে নিচ্ছে।
অন্যান্য উন্নত দেশের মুদ্রার সাথে ডলার বিনিময় বাণিজ্যের একটি সূচক রয়েছে ফেডের, যা এ বছর বেড়েছে ১০ শতাংশ বা ২০০২ সালের পর সবচেয়ে বেশি। সে তুলনায় উদীয়মান বাজার অর্থনীতির দেশগুলির সাথে ডলার বিনিময় সূচক বেড়েছে মাঝারি ধাঁচে ৩.৭ শতাংশ। ২০২০ সালে মহামারির পর এসব দেশের মুদ্রার বিপরীতে ডলার যে সর্বোচ্চ অবস্থানে ছিল, সূচকে অবস্থান তার চেয়ে কমই রয়েছে।
অবশ্য চলতি বছর সবচেয়ে বাজে পারফর্ম করা মুদ্রাগুলির বেশিরভাগই হচ্ছে উন্নয়নশীল দেশের, যেমন শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানের। বিপাকে আছে অন্যান্য আরও অনেক দেশও। কিন্তু, সামগ্রিক বিচারে উদীয়মান বাজারের বিনিময় সূচক ডলারের বিপরীতে বেশি নিচে নামেনি ব্রাজিলের রিয়াল ও রাশিয়ার রুবলের মতো পণ্য-বাণিজ্য সমর্থিত মুদ্রা শক্তিশালী থাকায়।
কেইও বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং জাপানের ব্যাংক অব জাপানের (কেন্দ্রীয় ব্যাংক) সাবেক বোর্ড সদস্য সায়ুরি শিরাই বলেন, 'নীতিনির্ধারণী সুদহার বাড়িয়ে অন্যান্য (বিশেষত উন্নত) দেশও এখন তাদের মুদ্রার মান বাড়াচ্ছে, খুব শিগগিরই তারা অবমূল্যায়নের কথা হয়তো ভাবতে পারবে না'।
তিনি ব্যাখ্যা করেন, 'ডলারের শক্তিশালী মান শুধু ফেডারেল রিজার্ভের প্রদত্ত আমানতের সুদহার আরও বৃদ্ধির সম্ভাবনাকেই তুলে ধরছে না, তার সাথে যুক্তরাষ্ট্রে স্থায়ী আমানত রাখলে তার আয়বৃদ্ধির সম্ভাবনাকেও তুলে ধরে। ফেডের পদক্ষেপে বিশ্বের অন্যান্য অর্থনীতিও সুদহার বৃদ্ধির পথে হাঁটছে– যা মন্দার ঝুঁকিকেও আগের চেয়ে অনেকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে'।
ইউরোপীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক (ইসিবি) ৭৫ বেসিস পয়েন্টের মতো রেকর্ড হারে বাড়াতে চাইছে সুদহার। ফলে আগামী দিনে মূল্যস্ফীতি কমানোর সঙ্গেসঙ্গে মন্দাও এড়ানো আরও দুরূহ হয়ে উঠতে চলেছে।
ডলারের বিপরীতে ইউরোর বিনিময় দরে সমতা ফেরানোও এ পদক্ষেপের আরেকটি প্রধান উদ্দেশ্য। সম্প্রতি একইহারে বাড়ানোর ইঙ্গিত দিয়েছে ব্যাংক অব কানাডা। রিজার্ভ ব্যাংক অব অস্ট্রেলিয়াও এরমধ্যে অর্ধ-শতাংশ পয়েন্ট বাড়িয়েছে সুদহার।
মন্দার কালোমেঘে এরমধ্যেই ঢাকা পড়েছে যুক্তরাজ্যে– এমনটাই বলেছে সেখানকার একটি ব্যবসায়িক লবি। তাদের অনুমান, আগামী ১৫ সেপ্টেম্বর তারল্য নীতি কঠোর করবে ব্যাংক অব ইংল্যান্ড। এছাড়া অবশ্য উপায়ও নেই, ১৯৮৫ সালের পর বর্তমানেই সবচেয়ে কম দরে বিনিময় হচ্ছে ব্রিটিশ পাউন্ড।
ডলারের বিপরীতে ২৫ বছরের মধ্যে সবচেয়ে দুর্বল অবস্তানে জাপানি ইয়েন-ও। ফলে ব্যাংক অব জাপানের গভর্নর হারুহিকো কুরোদার সামনে এখন পর্বতপ্রমাণ চ্যালেঞ্জ। একদিকে তাকে দিতে হবে দেশের অর্থনীতির জন্য প্রয়োজনীয় বিপুল সমর্থন, কিন্তু ইয়েন দুর্বল থাকায় তা আবার মূল্যস্ফীতিকে চরমে নিয়ে যেতে পারে।
আমেরিকায় মূল্যস্ফীতি কমাতে- ফেডকে আসছে দিনে আরও সুদহার বাড়াতে হবে। এই অবস্থায় রাতের ঘুম হারাম হওয়ারই যোগাড় দুনিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংকারদের। আমেরিকার মূল্যস্ফীতি রপ্তানি তারা ঠেকাতে পারছেন না এই মুহূর্তে। তাই উন্নয়নশীল হোক বা উন্নত দেশ– ডলার নিয়ে দুর্ভাবনায় দিন কাটছে সব দেশেরই নীতিনির্ধারকদের।
- সূত্র: ব্লুমবার্গ থেকে সংক্ষেপিত