ডলারের মূল্যবৃদ্ধিতে আয় বেড়েছে বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশন, এপেক্সের
মার্কিন ডলারের দাম বৃদ্ধি আশির্বাদ হয়ে এসেছে কিছু স্থানীয় ব্যবসার জন্য, বিশেষ করে যারা ডলারে আয় করেন।
যেসব কোম্পানির রপ্তানি পণ্য তৈরির জন্য কাঁচামাল আমদানি করতে হয় না, মূলত তারাই এ থেকে উপকৃত হয়েছে। কিন্তু যাদের কাঁচামাল আমদানি করতে হয়, তাদের এতে আরও লোকসান হয়েছে।
২০২২-২৩ অর্থবছরের আর্থিক প্রতিবেদনের তথ্য ও কোম্পানির কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
২০২১-২২ অর্থবছরে সরকারি মালিকানাধীন বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনের (বিএসসি) রেভেনিউ ছিল ৩৭৩ কোটি টাকা আর মুনাফা ছিল ২২৫ কোটি টাকা। আটটি জাহাজ পরিচালনা থেকে এই রেভেনিউ ও মুনাফা অর্জন করে শিপিং কর্পোরেশন।
এর তুলনায় সদ্য শেষ হওয়া ২০২২-২৩ অর্থবছরে শিপিং কর্পোরেশনের রেভেনিউ বেড়েছে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা বা প্রায় ৭৯ শতাংশ। আর মুনাফা বেড়েছে ২০ কোটি টাকা বা প্রায় ৯ শতাংশ।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ইউক্রেনিয় বন্দরে নোঙর করা অবস্থায় বাংলার সমৃদ্ধি জাহাজ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় সাতটি জাহাজ থেকে এই রেভেনিউ ও মুনাফা করেছে শিপিং কর্পোরেশন।
শিপিং কর্পোরেশনের হিসাব বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, মূলত উচ্চ মূল্যের ডলারের কারণে কারেন্সি কনভার্সনে বেশি টাকা পাওয়া গেছে, যার কারণে একটি জাহাজ কম থাকলেও রেভেনিউ বৃদ্ধি পেয়েছে।
তারা জানান, জাহাজের ভাড়া বৃদ্ধিও রেভেনিউ বাড়াতে ভূমিকা রেখেছে তবে বড় ভূমিকা রেখেছে উচ্চমূল্যের ডলার।
শুধু শিপিং কর্পোরেশনই নয়, স্থানীয় কাঁচামাল ব্যবহার করে পণ্য রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান ও সার্ভিস সেক্টরের প্রতিষ্ঠানের জন্য আর্শীবাদ হয়েছে উচ্চমূল্যের ডলার।
কারণ উদ্যোক্তারা আগে এক ডলারের বিপরীতে যে টাকা পেতেন, এখন পাচ্ছেন তার চেয়ে অনেক বেশি।
ডলারের বিনিময়ে লোকাল কারেন্সিতে বেশি টাকা পাওয়ায় রপ্তানিকারক ও ডলারে আয় হয় এমন তালিকাভুক্ত কোম্পানির রেভেনিউ ও মুনাফা উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে।
তবে ম্যানুফ্যাকচারিং খাতের প্রতিষ্ঠান যারা কাঁচামাল আমদানির করে ভ্যালুএডিশনের পর পণ্য রপ্তানি করে, তারা খুব বেশি উপকৃত হতে পারেননি। কারণ ডলারের চড়া দামের কারণে কাঁচামাল আমদানিতে ব্যয় বেড়েছে অস্বাভাবিক হারে।
ফলে যারা কেবলমাত্র লোকাল কাঁচামাল ব্যবহার করে পণ্য রপ্তানি করছে তারাই সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়েছে।
বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনের রেকর্ড রেভেনিউ
১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠার পর ২০২২-২৩ অর্থবছরে সর্বোচ্চ রেভেনিউ অর্জন করেছে বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশন।
স্থানীয় বাজারে ডলারের দাম বৃদ্ধিতে বড় সুবিধাভোগী আন্তর্জাতিক জাহাজ পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠানটি।
সদ্য শেষ হওয়া অর্থবছরে শিপিং কর্পোরেশনের রেভেনিউ হয়েছে ৬৬৭.২৩ কোটি টাকা, যা ঠিক দুই বছর আগে ২০২০-২১ অর্থবছরে ছিল ২৪৩ কোটি টাকা।
করোনা মহামারির সময় ফ্রেইট চার্জ বেড়ে যাওয়ায় ওই অর্থবছরে রেভেনিউ বাড়ে।
কোম্পানির হিসাব বিভাগের এক কর্মকর্তা টিবিএসকে জানান, "টাকা ডিভ্যালুয়েশনের কারণে ডলারের বেশি দাম পাওয়া গেছে। আগের অর্থবছরে প্রতি ডলার ৯০ টাকা বা তার কমে পাওয়া গেলেও এখন ১০৯ টাকা বা এর বেশিতে পাওয়া যাচ্ছে। ফলে রেভেনিউ বেড়েছে।"
কোম্পানির রাজস্বের একটি বড় অংশ বৈদেশিক মুদ্রায় ফ্রেইট কার্যক্রম থেকে আসে।
তিনি জানান, "বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের জন্য ক্রুড অয়েল আমদানি করে বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশন। কোম্পানির হিসাব থেকেই ডলার পরিশোধ করা হয়। কারণ কোম্পানির আয় হয় ডলারেই। পরবর্তীতে পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন তেলের মূল্য ডলারে পরিশোধ করে। এই বছর বিপিসি বেশি পরিমাণ তেল আমদানি করেছে। সেখান থেকেও আয় বেড়েছে।"
এপেক্স- এর রপ্তানি আয় বেড়েছে ৩৫%
মূল্যস্ফীতি ও অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যেও সর্বোচ্চ রেভেনিউ অর্জন করেছে দেশের শীর্ষস্থানীয় পাদুকা উতপাদনকারী ও রপ্তানিকারক এপেক্স ফুটওয়্যার লিমিটেড।
২০২২-২৩ অর্থবছরে রপ্তানি আয়েও বড় উল্লম্ফন দেখেছে এপেক্স। পণ্য রপ্তানি থেকে তাদের রেভেনিউ বেড়েছে ৩৫%।
যদিও এপেক্সের মোট রেভেনিউ ২৭ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ১৬৫৩.৫৯ কোটি টাকা আর নীট মুনাফা ২১ শতাংশ বেড়ে ১৬.৭১ কোটি টাকা।
মোট রেভেনিউ বাড়ার বিষয়ে কোম্পানি জানায়, এক অর্থবছরে তিনটি ঈদ উৎসব পাওয়ায় কোম্পানির ইতিহাসে সর্বোচ্চ বিক্রি হয়েছে। এক অর্থবছরে দুটি ঈদ-উল আযহা ও একটি ঈদ-উল ফিতর উৎসব পালিত হয়েছে, যাতে পণ্য বিক্রি উল্লেখযোগ্যহারে বেড়েছে।
রপ্তানি থেকে এপেক্স ফুটওয়্যারের রেভেনিউ এসেছে ৭১৩ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি থেকে রেভেনিউ বেড়েছে ১৮৫ কোটি টাকা।
রপ্তানি থেকে আয় বাড়ার বিষয়ে কোম্পানির ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর দিলীপ কাজুরি বলেন, "ডলারের দাম বেশি থাকায় টাকায় কনভার্সনে রেভেনিউ বেড়েছে।"
এপেক্স ফুডসের মুনাফা বেড়েছে ৭৩ শতাংশ
ডলারের বাড়তি দামের কারণে মুনাফায় বড় চমক দেখিয়েছে শতভাগ রপ্তানিমুখী কোম্পানি এপেক্স ফুডস লিমিটেড। ২০২২-২৩ অর্থবছরে কোম্পানিটির মুনাফায় প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৭৩%।
কোম্পানিটি বলেছে, খরচ কমানোর এবং ডলারের মূল্যবৃদ্ধি মুনাফা বাড়াতে ভূমিকা রেখেছে।
চিংড়ি রপ্তানিকারক কোম্পানিটি ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৫.০৮ কোটি টাকা লাভ করেছে, যা আগের অর্থবছরে ২.৯৩ কোটি টাকা ছিল।
কোম্পানির শেয়ার প্রতি আয় (ইপিএস) এর আগের অর্থবছরের ৫.১৪ টাকা থেকে বেড়ে ২০২২-২৩ এ ৮.৯১ টাকা হয়েছে।
কোম্পানির এক কর্মকর্তা টিবিএসকে বলেন, "রপ্তানির কারণে কোম্পানি ডলারে পেমেন্ট পায়। দেশের বাজারে ডলারের দাম বেশি থাকায় কারেন্সি কনভার্সনে বেশি পরিমাণ টাকা পাওয়া গেছে, যা রেভেনিউতে প্রভাব ফেলেছে।"