১২ বছরে ৭৩০ কোটি ডলারের ভারতীয় লাইন অভ ক্রেডিটের মাত্র ১৬ শতাংশ ছাড় হয়েছে
তিনটি লাইন অভ ক্রেডিট-এর (এলওসি) আওতায় ভারত বাংলাদেশকে ৭৩০ কোটি ডলারের ঋণ প্রতিশ্রুতি দিলেও, অর্থছাড় করেছে মাত্র ১২০ কোটি বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে প্রথম ঋণচুক্তিটি ১২ বছর আগে এবং তৃতীয়টি ৫ বছর আগে সই হয়েছিল।
ছাড়কৃত ঋণ মোট প্রতিশ্রুত ডেভেলপমেন্ট-ক্রেডিট লাইনের ১৬.৬ শতাংশ। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) হালনাগাদ প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
ভারতীয় ঋণের প্রকল্পে অর্থছাড়ে বিলম্বের কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ইআরডি ও বিভিন্ন বাস্তবায়নকারী সংস্থার কর্মকর্তারা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান, এলওসি চুক্তি হওয়ার পর এসব প্রকল্প নির্বাচন হয়। এর পর প্রকল্পগুলোকে এলওসিভুক্ত করতে ভারতের সম্মতি নিতে হয়।
আবার দরপত্র আহ্বান থেকে দরদাতা নিয়োগ পর্যন্ত বিভিন্ন পর্যায়ে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সম্মতি নিতে সময়ক্ষেপণ হয়। এতে প্রকল্প বাস্তবায়ন পর্যায়ে যেতেও দেরি হয় বলে জানান তারা।
এলওসির শর্ত অনুযায়ী, ভারতীয় ঋণের প্রকল্পে কেবল সে দেশের ঠিকাদাররাই কাজ করতে পারে। কিন্তু, অনেক ক্রয় কাজে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানগুলো প্রাক্কলনের চেয়ে বেশি দর প্রস্তাব করে। এতে সৃষ্ট জটিলতা তৈরি হয়, যার ফলে জটিলতা সৃষ্টি হয় এবং সময়মতো কাজ শুরু করা যায় না।
ভারতীয় ঋণের কঠিন শর্তের কারণেও বেশ কয়েকটি প্রকল্প বাস্তবায়নের মাঝপথে এলওসি তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। বাস্তবায়নকারী সংস্থাগুলোর আবেদনের প্রেক্ষিতে তালিকা থেকে এসব প্রকল্প বাদ যাচ্ছে। এর প্রভাব পড়েছে অর্থছাড়ে।
এছাড়া, বাস্তবায়ন পর্যায়ে ভারতীয় ঠিকাদারদের অবহেলার কারণেও বাস্তবায়ন কাজ ধীর গতিতে হয়। বাংলাদেশ রেলওয়েসহ বিভিন্ন সংস্থার প্রতিবেদনে বিষয়টি উঠে এসেছে।
কঠিন ঋণশর্ত
ঋণের কঠিন শর্ত এবং বিভিন্ন জটিলতার কারণে ভারতীয় এলওসিতে প্রকল্প বাস্তবায়নের আগ্রহ হারাচ্ছে বিভিন্ন বাস্তবায়নকারী সংস্থা।
যেমন ভারতীয় ঋণের শর্ত অনুযায়ী, যেকোনো প্রকল্পের ৭৫ শতাংশ পণ্য ও সেবা ভারত থেকে কেনা বাধ্যতামূলক। মাত্র ২৫ শতাংশ পণ্য ও সেবা বাংলাদেশ বা আন্তর্জাতিক বাজার থেকে ক্রয় করা যায়।
তবে পূর্ত কাজ-সংক্রান্ত প্রকল্পের ক্ষেত্রে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের অনুমোদন সাপেক্ষে ৬৫ শতাংশ পর্যন্ত ভারতীয় পণ্য ক্রয় করা যায়। কিন্তু এ সুবিধা কেবল সড়ক প্রকল্পের ক্ষেত্রে দেওয়া হয়। বিদ্যুৎ, নৌপরিবহন বা রেল অবকাঠামো প্রকল্পে ভারত এ সুযোগ দেয় না।
ইআরডির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এলওসিভুক্ত প্রকল্পে ভারত থেকে পণ্য কেনার শর্তের কারণে বাস্তবায়ন জটিলতা বাড়ছে। কারণ প্রথম এলওসির ১৫টি প্রকল্পের মধ্যে ১১টি ছিল পণ্য কেনার বা সরবরাহ প্রকল্প। কিন্তু, দ্বিতীয় এলওসির ১৫ প্রকল্পের মাত্র দুটি সরবরাহ এবং বাকি ১৩টি পূর্ত কাজ-সংশ্লিষ্ট। তৃতীয় এলওসির ১৬ প্রকল্পের মধ্যে কোনো সরবরাহ প্রকল্প নেই।
ইআরডির কর্মকর্মকর্তারা জানান, বিভিন্ন সময় বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষ ভারতের কাছে ঋণের শিথিলের প্রস্তাব দিলেও প্রতিবেশী দেশটি এতে রাজি হয়নি।
ইআরডির একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম না প্রকাশের শর্তে বলেন, ভারতীয় ঋণের শর্তে পরিবর্তন আনতে হলে দুই দেশের পক্ষ থেকে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত আসা প্রয়োজন।
তবে এবিষয়ে পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান সম্প্রতি বলেছেন, 'আমার অভিজ্ঞতায়, এটি আমলাতান্ত্রিক কাজ এবং এটি নিয়ে সামনে এগোতে সময় লাগে। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক ও বিশ্বব্যাংক এত আমলাতান্ত্রিক না'।
পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, ভারতীয়রা তাদের নিজস্ব স্বার্থ আদায়ের ক্ষেত্রে অত্যন্ত সচেতন। এ কারণে রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকলেও আমলাতন্ত্র বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
তিনি বলেন, 'এ কারণে ভারতীয় ঋণের কোনো সুফল পাচ্ছে না বাংলাদেশ। স্বাধীন সংস্থার মাধ্যমে ভারতীয় ঋণের মূল্যায়ন করার সময় এসেছে। এই মূল্যায়নে বোঝা যাবে ভারতীয় ঋণ নিয়ে আমরা কতটুকু লাভবান হচ্ছি। কারণ ভারতীয় এলওসি ঋণের প্রকল্পে নির্মাণ উপকরণও ভারত থেকে আনতে হয়'।
'আবার ভারতীয় ঠিকাদাররাই শুধু দরপত্রে অংশ নিতে পারে। এ সুযোগে ভারতীয় ঠিকাদাররা ঠিকমতো ও সময়মতো কাজ করে না।'
প্রকল্প চলছে কচ্ছপ গতিতে, অর্থছাড় ধীর
ইআরডির তথ্য অনুযায়ী, ভারতীয় কর্তৃপক্ষ চলতি বছরের ২০ আগস্ট পর্যন্ত অর্থছাড় করেছে ৭২৭.৬১ মিলিয়ন ডলার, যা প্রথম এলওসির ৮৪.৪ শতাংশ। প্রথম এলওসিতে ৮৬২ মিলিয়ন ডলার ঋণের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে।
২০১০ সালের ৭ আগস্ট চুক্তি হওয়া প্রথম এলওসি ঋণে ১৫টি প্রকল্পের মধ্যে বাস্তবায়ন কাজ শেষ হয়েছে ১২টি প্রকল্পের। শেষ হওয়ার প্রকল্পগুলোর বেশিরভাগই ভারত থেকে বাস-ট্রাক বা অন্যান্য পণ্য কেনার প্রকল্প।
প্রথম এলওসিতে নেওয়া রেল অবকাঠামা নির্মাণের বড় তিন প্রকল্পের বাস্তবায়ন কাজ চলছে এক দশকের বেশি সময় ধরে।
যেমন কুলাউড়া-শাহবাজপুর রেলওয়ে লাইন প্রকল্পের বাস্তবায়ন কাজ শুরু হয় ২০১১ সালের জুলাইয়ে। এ পর্যন্ত প্রকল্পটির ভৌত অগ্রগতি মাত্র ২৫ শতাংশ। ভারতীয় কর্তৃপক্ষের বিভিন্ন অনুমোদন প্রক্রিয়া শেষ করে ভারতীয় প্রতিষ্ঠান– কালিন্দী রেল নির্মাণ-এর (কেআরএন) সঙ্গে নির্মাণ চুক্তি হয় ২০১৭ সালের ৫ নভেম্বর।
ঠিকাদারের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী, নির্মাণকাজ ২০২০ সালের মে মাসে শেষ করার কথা ছিল। এর পর ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত মেয়াদ বাড়ানো হয়।
রেলওয়ে ও ইআরডির একাধিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বৈশ্বিক পরিস্থিতির অজুহাতে ২০২১ সালের মার্চ থেকে প্রকল্পের কাজ প্রায় বন্ধ রয়েছে।
প্রকল্প পরিচালক সুলতান আলী টিবিএসকে জানান, প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ চলছে একেবারেই কচ্ছপ গতিতে।
২০২২ সালের ২১-২২ জুন নয়াদিল্লিতে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে ২০তম দ্বিপাক্ষিক লাইন অভ ক্রেডিট (এলওসি) রিভিউ মিটিং অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভায় ইপিসি ঠিকাদারের সক্ষমতা, আন্তরিকতা ও দায়বদ্ধতা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে ইআরডি। পাশাপাশি পরামর্শ দেয়, তাদের কাজে কোনো উন্নতি দেখা না গেলে উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে।
একই অবস্থা ঢাকা-টঙ্গী-জয়দেবপুর রেললাইন প্রকল্পেও। প্রথম এলওসির আওতায় এ প্রকল্পের বাস্তবায়ন কাজ শুরু হয় ২০১২ সালে। প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয় ১ হাজার ১০৭ কোটি টাকা। এরমধ্যে ভারতের ৯০৩ কোটি টাকা ঋণের প্রতিশ্রুতি রয়েছে। এখন পর্যন্ত এ প্রকল্পের ভৌত কাজ ৫০ শতাংশও সম্পন্ন হয়নি।
এদিকে ২ বিলিয়ন ডলারের দ্বিতীয় এলওসি থেকে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ ছাড় করেছে প্রায় ২৩৩ মিলিয়ন ডলার বা ১১.৬ শতাংশ অর্থ।
ভারতের সঙ্গে দ্বিতীয় এলওসির ঋণচুক্তি হয় ২০১৬ সালের ৯ মার্চ। এর আওতায় বাস্তবায়ন হবে মোট ১৫টি প্রকল্প। এরমধ্যে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্পোরেশন (বিআরটিসি)'র জন্য গাড়ি কেনার দুটি প্রকল্প ইতিমধ্যে শেষ হয়েছে।
দ্বিতীয় এলওসির আওতায় আরও চারটি প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন আছে, একটি প্রকল্প দরপত্র প্রক্রিয়ায় রয়েছে। অন্যদিকে, ৫টি প্রকল্প রয়েছে প্রকল্প প্রস্তাব অনুমোদন বা পরামর্শক নিয়োগ পর্যায়ে।
গত বছর হাসপাতাল নির্মাণের চলমান দুটি প্রকল্পের মাঝপথে ভারতীয় ঋণ না নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। পরবর্তীতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের আবেদনের প্রেক্ষিতে প্রকল্প দুটি দ্বিতীয় এলওসি তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়।
প্রকল্পটি দুটির একটি হলো জামালপুরে শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল এবং নার্সিং কলেজ নির্মাণ। অন্যটি যশোর, কক্সবাজার, পাবনা ও নোয়াখালিতে ৫০০ শয্যার হাসপাতাল ও সহায়ক ভবন নির্মাণ।
তালিকায় থাকলেও পরে বাস্তবায়নকারী সংস্থার আগ্রহ না থাকায় বিভিন্ন পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে অতিরিক্ত ছাত্র ভর্তির জন্য দরকারি অবকাঠামো নির্মাণের প্রকল্পও দ্বিতীয় এলওসি থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে।
অন্যদিকে ভারতের সঙ্গে ৪.৫ বিলিয়ন ডলারের তৃতীয় এলওসির চুক্তি হয় ২০১৭ সালের মার্চে ।
এর আওতায়, কেনাকাটার দুটি প্রকল্প– বিআরটিসির জন্য ৬০০টি ডাবল ডেকার ও সিঙ্গেল ডেকার বাস ক্রয় ইতিমধ্যে শেষ হয়েছে।
শেষ হওয়া দুটি প্রকল্পের কারণে ২০২২ সালের ২০ আগস্ট পর্যন্ত তৃতীয় এলওসির অর্থছাড় হয়েছে প্রায় ২৬৪ ডলার বা ৩.৮ শতাংশ।
এই এলওসির আওতায় নেওয়া ১৬টি প্রকল্পের মধ্যে, একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন পর্যায়ে পৌঁছেছে। ৬টি প্রকল্প দরপত্র পর্যায়ে এবং ৫টি প্রকল্প অনুমোদন বা পরামর্শক নিয়োগ পর্যায়ে আছে।
ভারতীয় এলওসির প্রকল্প থেকে বাস্তবায়নকারী সংস্থাগুলিকে পিছু হঠতে হচ্ছে
প্রাক্কলনের চেয়ে ভারতীয় ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানগুলোর বেশি দর প্রস্তাব করা নিয়ে সৃষ্ট জটিলতায় তৃতীয় এলওসিভুক্ত টেলিটকের ৪জি প্রযুক্তি সম্প্রসারণের কাজ অসমাপ্ত রেখেই প্রকল্প সমাপ্ত করার প্রস্তাব দিয়েছে টেলিটক।
পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো এক চিঠিতে টেলিটকের প্রকল্পের বিষয়ে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ বলছে, 'ভারতীয় ঋণের শর্ত অনুযায়ী, প্রকল্পে যেসব যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হবে তার ৭৫ শতাংশ ভারত থেকে আমদানি করতে হয়। প্রকল্প অনুমোদনের চার বছর পর গত বছর দরপত্র আহ্বান করা হলে বেশি দর প্রস্তাব করে ভারতীয় ঠিকাদাররা'।
এতে আরও বলা হয়েছে, প্রথমবার দরপত্রে অংশগ্রহণকারী প্রি-কোয়ালিফাইড ইপিসি (ইঞ্জিনিয়ারিং, প্রোকিউরমেন্ট অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন) ঠিকাদারদের মতামত অনুযায়ী, ভারতীয় পণ্য (কনটেন্ট) ৭৫ শতাংশ থেকে ৩০ শতাংশ বা ৪০ শতাংশ করা না হলে দরপত্রে দাখিল করা মূল্য কমানোর সম্ভবনা অত্যন্ত সীমিত। ফলে দ্বিতীয়বার দরপত্র আহ্বান করা হলেও দরপত্রে সফল হওয়া যাবে কি না, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে।
ভারতীয় ঠিকাদারদের প্রস্তাবিত দরে প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হলে প্রকল্পের ব্যয় ২০ শতাংশ বাড়বে। ৫ বছর আগে শুরু হওয়া প্রকল্পটির ব্যয় বাড়ানো যৌক্তিক হবে না বলে মনে করছে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ।
এদিকে তৃতীয় এলওসির প্রকল্প তালিকায় থাকলেও– ভারতীয় ঋণে বাস্তবায়ন যৌক্তিক হবে না বলে বে টার্মিনাল প্রকল্পের প্রস্তাব পাঠানো হচ্ছে না। এই প্রকল্পে ৪০০ মিলিয়ন ডলার ঋণ দেওয়ার কথা রয়েছে ভারতের।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের একজন কর্মকর্তা জানান, তাদের পর্যালোচনায় বে কন্টেইনার প্রকল্পটি ভারতীয় ঋণে বাস্তবায়ন না করার সিদ্ধান্ত ইতিমধ্যে সরকারের ঊর্ধ্বতন মহলে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, ভারতীয় ঋণের প্রকল্পে তাদের আগ্রহ নেই। কারণ বাস্তবায়ন পর্যায়ে অনেক জটিলতায় পড়তে হয়।