মার্কিন ডলার বৈশ্বিক রিজার্ভ মুদ্রার আসন হারালে কী হবে
যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক– ফেডারেল রিজার্ভের ব্যাংকের ২০২১ সালের অক্টোবরে প্রকাশিত তথ্যমতে, ওই সময়ে বিশ্বের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো তাদের মোট বৈদেশিক মুদ্রা মজুদের প্রায় ৬০ শতাংশ রেখেছিল মার্কিন ডলারে।তথ্যটি অবশ্য ঘোষিত সম্পদের হিসাব অনুসারে। এর বাইরেও অন্যান্য সম্পদ হিসেবে রয়েছে, বিপুল পরিমাণ ডলারের মজুত।
ডলার আন্তর্জাতিক স্তরে সবচেয়ে বেশি অংকের লেনদেন হয় এমন দুটি পণ্য– অস্ত্র ও জ্বালানি বাণিজ্যের প্রধানতম নিয়ামক। মার্কিন মুদ্রার স্থিতিশীলতার বিচারে সম্পদমূল্য ধরে রাখতেও সরকার আর কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলি ডলারে আস্থা রেখে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূরাজনৈতিক প্রতিপত্তি এবং আর্থিক খাতের সুবিশাল বিস্তারও এর পেছনে অবদান রেখেছে।
তবে ডলারের আলোচিত দুটি বৈশিষ্ট্যই বর্তমানে বদলাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে চড়াভাবে সুদহার বাড়াচ্ছে ফেডারেল রিজার্ভ। এতে ডলারের মানে উত্থান ঘটেছে নাটকীয়ভাবে; অন্যদিকে, অন্যান্য মুদ্রা তার বিনিময় দর হারাচ্ছে। বৈশ্বিক ঋণ সহায়তা থেকে শুরু করে পণ্য বাণিজ্যে ডলার একটি প্রধান মাধ্যম হওয়ায়– কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলিকে আমদানি ব্যয় মেটাতে চাপের মুখে পড়তে হচ্ছে। বাংলাদেশসহ বিভিন্ন উন্নয়নশীল দেশে পড়তির মুখে মুদ্রা রিজার্ভ। এসব ঘটনায় প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে ডলারের উপযোগিতা।
আবার যুক্তরাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত আর্থিক ব্যবস্থার ভিত্তি দুর্বল করতে চায় চীন ও রাশিয়া। বেইজিং চায় ইউয়ানকে ডলারের আসনে বসাতে। এবং তার মাধ্যমে আমেরিকার আর্থিক নিষেধাজ্ঞার শক্তিকে খর্ব এবং নিজ আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে। ডলার সংকটে অন্যান্য দেশও রিজার্ভে বাড়াচ্ছে বিকল্প মুদ্রার অংশ। দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যে নিজস্ব মুদ্রার ব্যবহারও বাড়াচ্ছে তারা। যেমন- চীন-রাশিয়া ইউয়ান ও রুবলে এবং রুবল ও রুপিতে বাণিজ্য করছে ভারত- রাশিয়া।
এসব ঘটনার প্রেক্ষাপটে, ডলারের ভবিষ্যত নিয়ে সম্প্রতি আলোচনা করেন ক্রিপ্টোকারেন্সি বিটকয়েনে সহজে বিনিয়োগের সুবিধা দেওয়া সুইজারল্যান্ড-ভিত্তিক অ্যাপ রিলাই এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা জুলিয়ান লিঙ্গার।
বিটকয়েন ম্যাগাজিনকে দেওয়া তার ওই সাক্ষাৎকারের নির্বাচিত অংশ তুলে ধরা হলো—
১. বি. ম্যাগ– আন্তর্জাতিক আর্থিক খাতের কিছু ঘটনায় অবহিত মানুষ মনে করছে, ডলার রিজার্ভের প্রধান মুদ্রার আসন হারাতে চলেছে। এমনটা কী অদূর ভবিষ্যতেই দেখা যাবে? আমেরিকাতেও অনেকে এনিয়ে উদ্বিগ্ন। এসবের যথাযথতা কতখানি– এই পরিস্থিতিতে বিটকয়েনেরই কী ভূমিকা?
জুলিয়ান লিঙ্গার:
যারা এমন কথা বলছেন, সহজভাবে ব্যাখ্যার সুবিধায়– তাদের তিনটি দলে ভাগ করতে চাই। সবাই উদ্বেগ করছে এমন নয়। একদল আছে আশাবাদী। যেমন বিটকয়েন লেনদেনের পক্ষের মানুষেরা। তারা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতে শুরু করেছেন, যে বৈশ্বিক রিজার্ভে মার্কিন ডলার তার আসন অবশ্যই হারাবে। মার্কিন সরকারের সিদ্ধান্ত ও বিদেশি কর্তৃপক্ষের প্রতিক্রিয়াকে তারা এরই উদাহরণ বলছেন।
বর্তমান সময়ে জ্বালানির চড়া দাম- সবার জন্যই একটি বড় মাথাব্যথা। এটা সব ধরনের মূল্যস্ফীতিকে সমর্থন দিচ্ছে।
আমি মনে করি, শুধু ডলারে নয়– সব দেশেরই নিজস্ব মুদ্রায় জ্বালানি কেনার সুযোগ থাকা উচিত। এনিয়ে আনুষ্ঠানিক ঘোষণার দরকার নেই। যেমন বলা যায়– ওপেক বা ইউরোপীয় ইউনিয়ন ঘোষণা দিয়ে, শুধু ইউরোতে জ্বালানি লেনদেন করবে সেটি নিষ্প্রয়োজন। কিন্তু, দাম পরিশোধের ক্ষেত্রে ক্রেতা দেশের মুদ্রাকে বিনিময় মাধ্যমের মর্যাদা দিতে হবে।
আর এটা করা খুবই দরকার। কারণ আমার মতে, জ্বালানি তেল বাণিজ্যে যে মুদ্রা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি পাবে—মধ্যমেয়াদে সেটিই পাবে বৈশ্বিক রিজার্ভে প্রধান মুদ্রার আসন। কিন্তু, প্রায় সকল দেশের টাকাকড়িতে এই বাণিজ্য করার সুযোগ থাকলে, একদিকে ডলারের আধিপত্য কমবে–অন্যদিকে একটি ভারসাম্য আসবে। উন্নয়নশীল দেশগুলি ডলার নিয়ে চিন্তাগ্রস্ত না হয়ে নিজেদের টাকায় দরকারি জ্বালানি কিনতে পারবে। অর্থনৈতিক অগ্রগতির চাকা সচল রাখতে পারবে। উদ্যোগ নিলে, বিটকয়েনের মতো ডিজিটাল মুদ্রার প্রচলন এইক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে।
আবার এর ফলে, চীনের ইউয়ানও তার রাজনৈতিক–অর্থনৈতিক লক্ষ্য পুরোপুরি অর্জন করতে পারবে না।
২.বি. ম্যাগ– এই ভারসাম্যের প্রভাব কেমন হবে?
জুলিয়ান: ডলারের মান চড়া থাকার একটি প্রভাবের কথা বলা যাক । যেমন ধরুন– এখন বিপুল পুঁজি লগ্নী হচ্ছে আমেরিকার আর্থিক খাতে। কারণ, সেখানে পুঁজি বিনিয়োগে সুদহারও ভালো। ইউরোপ থেকে বিপুল পুঁজি চলে যাওয়ায়– সম্ভাব্য ধসের মুখে এখানকার বন্ড বাজার। উন্নয়নশীল দেশগুলিতে আমরা আরও বেশি বেশি এ ঘটনা দেখতে পাব।
স্বল্পমেয়াদে ডলারের মান আরও বাড়বে বলে মনে করছি। কিন্তু, এই বৃদ্ধির সাথে সাথে চাপ বাড়তে থাকবে অন্যান্য দেশে। তখন এসব দেশের নীতিনির্ধারকরা বলবেন, যারা (মার্কিনীরা) স্বার্থপরের মতো সিদ্ধান্ত নিয়ে আমাদের এই পরিস্থিতিতে ফেলছে– তাদের ওপর কেন আর আস্থা রাখব? বিপদ থেকে পরিত্রাণ পেতে তাদের একক সিদ্ধান্তের মুখাপেক্ষী থাকারই বা কী অর্থ?
অর্থাৎ, তারা নিজ মুদ্রার ব্যবহার কীভাবে আরও বাড়ানো যায়– তা নিয়ে সহযোগী দেশগুলির সাথে আলোচনা ও চুক্তিকে জোরালো করবে। সেই অনুসারে, সহযোগী দেশের মুদ্রাসহ রিজার্ভে ডলারের বিকল্প হিসেবে অন্যান্য মুদ্রার অংশ বাড়াবে।
৩.বি. ম্যাগ– তাহলে আমেরিকানদের উদ্বেগ সঙ্গত?
জুলিয়ান: আমার মতে, বৈশ্বিক রিজার্ভের প্রধান মাধ্যম- নিজ দেশের মুদ্রা হওয়ার সুবিধা ও তার সাথে সংশ্লিষ্ট দায় কতখানি– আমেরিকার বেশিরভাগ মানুষই সেটি বোঝেন না। অনেকে বুঝেও বুঝতে চান না– এর মুদ্রণ অধিকার তাদের সরকারের হাতে থাকা কত বড় সুবিধা। এক কথায়, বৈশ্বিক আর্থিক খাতের প্রাণভোমরা বন্দি আমেরিকার টাকশালে।
তাই বিদেশিদের সমস্যা বললে মার্কিনীরা গা করেন না। সব জেনে বুঝেও অনায়সে বলে দেন–তাতে আমাদের কী? বা এসব কোনো বিষয়ই না? কেউ কেউ বলেও বসে, "আমার সারা জীবন ডলারের আধিপত্য দেখেছি, আর এটি বজায় থাকবে"।
দায়ের এই অস্বীকার আছে ব্যাপকভাবে। আমার অনেক ঘনিষ্ঠ মার্কিন বন্ধুও আছেন এই দলে। তাদের কেউ কেউ আমাকে এ ধরনের কথাবার্তা বলেন– "আশা করি, মার্কিন সরকার এই সমস্যাগুলোর সমাধান করবে। কিন্তু, ডলার ছিল এবং থাকবে"।
ডলার তার আন্তর্জাতিক মর্যাদা হারালে- এই মানুষগুলির কষ্টই হবে বেশি। অনিবার্য এই ঘটনা যখন ঘটবে– তারা হতবাক হয়ে যাবে।
- সূত্র: বিটকয়েন ম্যাগ ডটকম অবলম্বনে