অ্যাপার্টমেন্টের দাম আকাশছোঁয়া, কিন্তু ধনীরা পাত্তা দিচ্ছে না
'নিজের বাড়ির মতো আর কোনো জায়গা-ই হয় না'- আপনি আমজনতা হলে প্রচলিত এই কথাটি শুনে ইদানীং হয়তো আর হৃদয় জুড়ায় না। বরং কপালে বাড়ে চিন্তার ভাঁজ।
একটি বিষয় দিবালোকের মতো স্পষ্ট– কোভিড-১৯ মহামারি সাধারণ মানুষের আর্থিক সক্ষমতা কমিয়েছে; তার সাথে এখন মূল্যস্ফীতি চরমে নিয়ে যাচ্ছে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের অভিঘাত। ফলে জীবনের সবচেয়ে বড় বিনিয়োগ– নিজের একটি আবাস– কেনার আগে অনেক ভেবেচিন্তে পদক্ষেপ নিচ্ছে ভোক্তারা।
তার ওপর আবার প্রায় সব ধরনের নির্মাণ সামগ্রীর মহাকাশ ছোঁয়া দামের প্রভাবে– হু হু করে বেড়েছে অ্যাপার্টমেন্টের দাম। ফলে আরও দুঃসাধ্য হয়ে উঠেছে নির্দিষ্ট আয়ের মানুষের পক্ষে এ ধরনের নিবাস ক্রয়।
এরমধ্যেই গত কয়েক বছরের তুলনায় সর্বনিম্ন অবস্থানে নেমেছে সাধারণ অ্যাপার্টমেন্ট বিক্রি।
তবে ধনীরা তাদের স্বপ্নের বাড়ির সন্ধানে ছুটতে থাকায়– এই মন্দার প্রভাব পড়েনি বিলাসবহুল/ অভিজাত অ্যাপার্টমেন্ট বিক্রিতে।
অবিক্রিত প্রায় ১২ হাজার এপার্টমেন্ট
শুধু ঢাকাতেই প্রায় ১২ হাজারের বেশি বিক্রির জন্য প্রস্তুত অ্যাপার্টমেন্ট অবিক্রিত অবস্থায় রয়েছে বলে জানিয়েছে আবাসন ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অভ বাংলাদেশ- রিহ্যাব। চট্টগ্রামসহ সারাদেশে আরো প্রায় ২০ হাজার রেডি অ্যাপার্টমেন্ট অবিক্রিত রয়েছে। এর প্রায় ৮৫ শতাংশই হলো- সাধারণ অ্যাপার্টমেন্ট।
রিহ্যাব বলছে, এগুলির মোট বাজারমূল্য আনুমানিক দেড় লাখ কোটি টাকা।
এ বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সারাদেশে ১৬ হাজার কোটি টাকার অ্যাপার্টমেন্ট বিক্রয় হয়েছে বলে জানিয়েছে নিবন্ধন অধিদপ্তর, যা গত বছরের প্রায় অর্ধেক। এরমধ্যে মধ্যে প্রায় সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকার বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট বিক্রয় চুক্তির নিবন্ধন হয়েছে।
নিবন্ধন অধিদপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক শেখ মো. আনোয়ারুল হক এবং বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অভ প্লানার্স- বিআইপি'র সূত্রগুলি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানিয়েছে, চলতি বছর অভিজাত আবাসনের বিক্রি গত বছরের সমান হতে পারে।
দামি এপার্টমেন্টের বিক্রিবাট্টা চাঙ্গা
বিআইপি'র তথ্য বলছে, গত বছর প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ হয়েছে বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্টে।
জীবনযাপনের সর্বাধুনিক সব বিলাসিতার সুযোগ-সুবিধা সম্পন্ন করে গড়ে তোলা হয় এসব আবাসন। এসব বাড়িতে থাকে বাগান, খেলার মাঠ, সুইমিং পুল, ব্যায়ামাগার, পরিপাটি লন এবং উচ্চ প্রযুক্তিসম্পন্ন নিরাপত্তা ব্যবস্থা।
সর্বাধুনিক সুবিধা সম্বলিত এসব এপার্টমেন্ট ২০০০ বর্গফুট থেকে ৫০০০ বর্গফুট পর্যন্ত হয়ে থাকে। ডুপ্লেক্স এপার্টমেন্টগুলি সাধারণত ৭,৪৪০ বর্গফুটের হয়।
রাজধানীর অভিজাত এলাকা যেমন- গুলশান, বনানী, ধানমন্ডি, বারিধারা, ডিওএইচএস, উত্তরা, ওয়ারী এলাকায় গড়ে তোলা হয় বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট। মান ও বর্গফুটের ওপর নির্ভর করে বর্তমানে এগুলির দাম ৫ থেকে ৩৫ কোটি টাকা পর্যন্ত হয়। ডুপ্লেক্স হলে দাম আরো বেশি হয়।
আবাসন খাতের কোম্পানিগুলোর মতে, নির্মাণ উপকরণের বাজারদর বাড়ায়– বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্টের দামও ৩০- ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে।
বিলাসবহুল আবাসন কেনার ক্ষেত্রে এই বাড়তি দাম কোনো প্রভাবই ফেলেনি, কারণ এগুলির ক্রেতা প্রধানত ধনী ব্যবসায়ী, প্রবাসী, রাজনীতিবিদ ও আমলারা।
নাম না প্রকাশের শর্তে একটি রিয়েল এস্টেট কোম্পানির কর্মকর্তা টিবিএসকে জানান, তাদের রেডি বা বিক্রয়ের জন্য প্রস্তুত ৪০০ অ্যাপার্টমেন্টের মধ্যে ২০০টি বিক্রি হয়েছে, যার অর্ধেকের বেশি বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট। কিন্তু, সাধারণ অ্যাপার্টমেন্ট বিক্রি সেভাবে হচ্ছে না।
র্যাংগস প্রপার্টি লিমিটেডের (আরপিএল) মহাব্যবস্থাপক এবং হেড অফ সেলস- অমলেন্দু বিশ্বাস জানান, তাদের গুলশান, বনানী, মিরপুর, উত্তরার কয়েকটি অভিজাত অ্যাপার্টমেন্ট প্রকল্পে এবছরও ভালো বেচাবিক্রি হয়েছে।
সাধারণ অ্যাপার্টমেন্টের ক্রেতার অভাব
রিমি ডেভেলপমেন্ট নামক একটি আবাসন কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক খায়রুল আলম চৌহান জানান, তাদের প্রায় ৪৩টি সাধারণ অ্যাপার্টমেন্ট অবিক্রিত অবস্থায় পড়ে আছে, ক্রেতারাও তেমন আগ্রহ দেখাচ্ছেন না।
কোম্পানিটি রাজধানীর মধ্যবাড্ডা এলাকায় চারটি ভবন নির্মাণের প্রকল্প নেয় ২০১৮ সালে। চারটি ভবনে মোট ৭২টি এপার্টমেন্ট বানিয়েছে তারা। এ বছরের জুনে নির্মাণকাজ শেষ হয় বলে জানান তিনি।
দেশের একটি শীর্ষস্থানীয় আবাসন কোম্পানি শান্তা হোল্ডিংস লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটির সিনিয়র জেনারেল ম্যানেজার এবং হেড অভ সেলস অ্যান্ড কাস্টমার সার্ভিস– শিহাব আহমেদ টিবিএসকে জানান, এবছর আশানুরূপ অ্যাপার্টমেন্ট বিক্রয় হচ্ছে না তাদের-ও।
"আমাদের বেচাবিক্রিতে বেশ ধীরগতি এসেছে। আশা করি, খুব দ্রুত পরিস্থিতির উন্নতি হবে।"
রিহ্যাব সভাপতি আলমগীর শামসুল আলামিন (কাজল) জানান, রাজধানীতে যে সমস্ত রেডি অ্যাপার্টমেন্ট রয়েছে বিক্রয়ের জন্য, তার একটি তালিকা জমা দিয়েছে আবাসন কোম্পানিগুলো। এগুলো এখন গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে এখাতের ব্যবসায়ীদের জন্য। সেভাবে ক্রেতাও পাওয়া যাচ্ছে না। আর দাম কমিয়ে বিক্রয়ের সুযোগ সীমিত। কারণ নির্মাণ সামগ্রীর দাম অনেক বেশি। কিছুটা দাম কমিয়েও ক্রেতাদের আকৃষ্ট করা যাচ্ছে না বলে উল্লেখ করেন তিনি।
রিহ্যাবের চট্টগ্রাম অঞ্চলের সভাপতি আবদুল কাইয়ুম চৌধুরী বলেন, চট্টগ্রামে প্রায় ৫০০ আবাসন কোম্পানি রয়েছে। তাদের অনেকেই প্রায় সাড়ে ৪ হাজার রেডি অ্যাপার্টমেন্ট নিয়ে বিপাকে রয়েছে।
সিলেট অ্যাপার্টমেন্ট অ্যান্ড রিয়েল এস্টেট গ্রুপ (সারেগ) সভাপতি শফিউল আলম চৌধুরী নাদেল বলেন, সিলেটে আবাসন খাতে সবচেয়ে বেশ বিনিয়োগ করে প্রবাসীরা। কিন্তু বিশ্ব মন্দার কারণে সেটি হচ্ছে না। ফলে সিলেটেই প্রায় ৩ হাজার রেডি অ্যাপার্টমেন্ট এখন রয়েছে বিক্রয়েরে অপেক্ষায়। তবে বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট বিক্রি ভালোই হচ্ছে।
"স্ট্যাগফ্লেশনের দিকে এগিয়ে চলেছে আবাসন খাত"
বিশ্বব্যাপী আবাসন খাত করোনা মহামারি এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের অভিঘাতে 'স্ট্যাগফ্লেশনের' (যখন মূল্যস্ফীতি উচ্চ, প্রবৃদ্ধির হার কম) দিকে এগিয়ে চলেছে বলে উল্লেখ করেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর।
এতে নির্দিষ্ট আয়ের মানুষ চড়াদামে নিত্যপণ্য কিনতেই হিমশিম খাচ্ছে। তারা এখন আবাসনের চেয়ে খেয়ে-পরে বাঁচার চিন্তায় রয়েছে। তবে ধনীরা এপর্যন্ত তেমন সমস্যার সম্মুখীন না হওয়ায় বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট আর বাড়ির বেচাবিক্রি চলছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।